জার্মানি ইউরোপের ৭ম বৃহত্তম রাষ্ট্র। উত্তর সাগর ও বাল্টিক সাগরের উপকূলীয় নিম্নভূমি থেকে মধ্যভাগের ঢেউখেলানো পাহাড় ও নদী উপত্যকা এবং তারও দক্ষিণে ঘন অরণ্যাবৃত পর্বত ও বরফাবৃত আল্পস পর্বতমালা দেশটির ভূ-প্রকৃতিকে বৈচিত্র্যময় করেছে। দেশটির মধ্য দিয়ে ইউরোপের অনেকগুলি প্রধান প্রধান নদী যেমন রাইন, দানিউব, এলবে প্রবাহিত হয়েছে এবং দেশটিকে একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করতে সাহায্য করেছে। জার্মানিতে নগরায়নের হার অনেক বেশি। বার্লিন দেশের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। তবে সাবেক পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বন শহরে এখনও বেশ কিছু সরকারী অফিস রয়েছে। জার্মান ভাষা এখানকার প্রধান ভাষা। দুই-তৃতীয়াংশ লোক হয় রোমান ক্যাথলিক অথবা প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টান। জার্মানরা পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বহু অবদান রেখেছে। শিল্পচর্চার ক্ষেত্রেও জার্মানির অবদান অনন্য। জার্মানি বিশ্বের একটি প্রধান শিল্পোন্নত দেশ। জার্মানি লোহা, ইস্পাত, যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম এবং মোটরগাড়ি রপ্তানি করে। মূলত জার্মানিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই জার্মানির ব্যাপারে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষেরে আগ্রহটাও অনেক বেশি।
এশিয়া আফ্রিকাসহ তৃতীয় বিশ্বের অভিবাসন প্রত্যাশীদের প্রথম পছন্দের দেশ এই জার্মানি। জার্মানরাও সব সময় আন্তরিক ভাবে গ্রহণ করেছে অভিবাসীদের। তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায় কী সেই কারণ যার জন্যে অভিবাসীদের গন্তব্যের নাম জার্মানি? শরণার্থী বা অভিবাসন প্রত্যাশীরা যে জার্মানি আসছে তার ঐতিহাসিক ও বাস্তবভিত্তিক কারণ রয়েছে। জার্মানি বরাবরই শরণার্থীদের ব্যাপারে সহানুভুতিশীল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি প্রায় ১২ লাখ জাতিগতভাবে উদ্ভাস্তুকে জার্মান নাগরিককে গ্রহণ করেছিল। এরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছিলো। সেই থেকে মূলত শুরু। এরপর ষাটের দশকে যখন জার্মানি অন্যতম শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়, তখন তাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে কর্মীর, যারা আবাসন খাতে এবং শিল্প কারখানায় কাজ করবে।
ষাটের দশকে তাই জার্মানি, তুরস্ক ভিয়েতনাম ও সাবেক যুগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড থেকে প্রচুর ‘গাস্ট আরবাইটার’ অর্থাৎ অতিথি শ্রমিক গ্রহণ করে। এদের তৃতীয় জেনারেশন যারা এর মধ্যেই জার্মান নাগরিকত্ব পেয়েছে, এখন স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে। এছাড়া তিউনেশিয়া, ইরান ও ইরাকের অনেক নাগরিক জার্মানিতে আছে। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে জার্মানির একটা যোগাযোগ সব সময় ছিল। তাই শরণার্থীদের ক্ষেত্রে তাদের পছন্দের তালিকায় সব সময় জার্মানিই ছিল প্রথম। অন্যদিকে, জার্মানিতে অভিবাসন প্রক্রিয়া অনেক সহজ। ২০০৫ সালে জার্মানিতে নতুন একটি অভিবাসন আইন চালু হয়। তাতে বলা হয় জার্মানি হচ্ছে অভিবাসীদের দেশ। আগে এই আইন ছিল না। জার্মানিতেও অভিবাসন আইন বেশ কড়াকড়ি ছিল। এমনকি নাগরিকত্ব অর্জনের কাজটিও ছিল বেশ কঠিন।
পরবর্তীকালে ২০১২ সালে জার্মানি ইউরোপিয়ান ব্লু কার্ড ল্যাগিসেসন আইনটি বাস্তবায়ন করে। এই আইনের মধ্য দিয়ে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের অথবা বিদেশি ছাত্ররা যারা জার্মানিতে পড়াশোনা করেছেন যেমন আইটি সেক্টর, বিজ্ঞানী ইত্যাদি তাঁদের কাজের অনুমতিপত্রও থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। যা আগে কখনো ছিল না। জার্মানিতে বর্তমানে আইটি সেক্টরে বেশ কিছু চীনা ও ভারতীয় বিশেষজ্ঞ কাজ করছেন। তাঁদের নাগরিকত্বও দেওয়া হয়েছে। ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মানুষের ব্যাপারে জার্মানির আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। যখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন গ্রিস, ইতালি, পর্তুগালের অর্থনীতিতে শ্লথগতি। ফলে সেখানে বেকার সমস্যাও বাড়াছে, শুধুমাত্র জার্মানি ছিল এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। জার্মানি বিশ্বের চতুর্থ বড় অর্থনীতির দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে যেখানে বেকার সংখ্যা প্রায় ২০ ভাগ, সেখানে জার্মানিতে এই সংখ্যা মাত্র পাঁচ ভাগ। ফলে অনেকের কাছেই এই দেশের ব্যাপারে একটা ‘আকর্ষণ’ রয়েছে।
অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে জার্মানির কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী দরকার। সেখানে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়ছে। আর কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হ্রাস পাচ্ছে। অনেক পরিবার সন্তান নিতে চাচ্ছে না। তারা পেশার উন্নয়নের প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দেয় যে সন্তান পালন করার ‘ঝুঁকি’ তারা নিতে চায় না। অথচ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে কর্মী দরকার। ফলে ‘গাস্ট আরবাইটার’ তাদের দরকার। উপরন্তু এমন বেশ কিছু পেশা রয়েছে যেমন-রেস্টুরেন্ট-কর্মী, আবাসন খাতের কর্মী, কনস্ট্রকশন-কর্মী, পরিচ্ছন্নকর্মী ইত্যাদি যেখানে জার্মান নাগরিকরা কাজ করে না বা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। ফলে তাদের কর্মী দরকার। জার্মান-বাংলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি জার্মান প্রবাসী খান লিটনের সঙ্গে ভয়েস বাংলার কথা হয়। তিনি ভয়েস বাংলাকে জানান, ‘ অভিবাসন প্রত্যাশীদের প্রথম পছন্দ জার্মানি এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে।
জার্মানিতে ‘সামাজিক নিরাপত্তার’ বিষয়টি অত্যন্ত শক্তিশালী। অর্থাৎ একজন কর্মী, তিনি যদি বিদেশিও হন এবং তাঁর যদি কাজ করার অনুমতিপত্র থাকে এবং তিনি যদি বেকার থাকেন, তাহলে রাষ্ট্র তাকে বেকার ভাতা দেবে, বাসাভাড়া দেবে, সন্তানদের জন্য আলাদা ভাতা দেওয়া হবে এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে খাবার ভাতা দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে কাজ না করেও একজন তাঁর পরিবারপ্রতি মাসে প্রায় তিন হাজার ইউরো পাবেন। যেকোনো বিবেচনায় জার্মানির প্রতি আগ্রহীদের জন্য এটা বড় পাওয়া। এই সুযোগ তাঁরা নেবেন, এটাই স্বাভাবিক। উপরন্তু অনেকে চিন্তা করেন তাঁর সন্তানদের ভবিষ্যৎ। অভিভাবকরা চিন্তা করেন তাঁদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। উচ্চশিক্ষা নিতেও তাদের কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না। যা আমেরিকা কিংবা ব্রিটেনে চিন্তাও করা যায় না। একজন অভিবাসী তুর্কি পরিবারের সন্তান এখন জার্মান মন্ত্রী। তাছাড়া অনেক বাংলাদেশি পরিবারের সন্তানরা এখন কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও পিএইচডি।
No comments:
Post a Comment