তুরস্কের সংসদের পাঁচ দলের বাইরেও আরো সাতটি দল লড়ছে এবারের নির্বাচনে। নির্বাচনী প্রচারণার একটি চিত্র। ছবি: সংগৃহীত
প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি ভোটার আগামী রোববার তুরস্কের স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সংসদের পাঁচ দলের বাইরেও আরো সাতটি দল লড়ছে এবারের নির্বাচনে। তুরস্কে স্থানীয় নির্বাচনও হয় দলীয় ব্যানারে।
ভোটে জেতার লড়াইয়ে টিকে থাকতে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলগুলো জোট করে নির্বাচন করছে। নির্বাচনের মাঠ এখন মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। ক্ষমতাসীন জোট এবং বিরোধী জোট।
ক্ষমতাসীন জোটে আছে সরকারি দল একে পার্টি এবং কট্টর জাতীয়তাবাদী দল এমএইচপি। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল সেক্যুলারিস্ট সিএইচপি জোট করছে ডানপন্থী আই পি (IYI Parti) বা সু পার্টির সঙ্গে।
বড় সিটি কর্পোরেশন এবং গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে পার্টিগুলো জোটবদ্ধ হয়ে প্রার্থী দিয়েছে কোথাও আবার জোটের শরিকদের প্রার্থীর সমর্থনে নিজের প্রার্থীকে তুলে নিয়েছে।
অন্যদিকে বিশাল ভোট ব্যাংকের অধিকারী কুর্দী দল কারো সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো জোট করেনি কিন্তু বিরোধী জোটকে সমর্থন দিচ্ছে।
লড়াইটা সিটি মেয়র, পৌর কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান, গ্রাম মেম্বার ইত্যাদি ইত্যাদি পদের প্রাথী নির্বাচনের জন্য হলেও রাজনৈতিক দলগুলো সংসদ নির্বাচনের আদলে প্রচারণা চালাচ্ছে।
ক্ষমতাসীন দলের প্রধান এবং দেশের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোগান নির্বাচনী প্রচারে সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছেন। প্রতিদিন ২-৩ টি নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন।
দলের প্রার্থীর পক্ষে ভোট টানতে সব ধরণের রাজনৈতিক কৌশল তিনি ব্যবহার করছেন। কখনও ধর্মীয় অনুভূতি কখনওবা জাতীয়তাবাদের বুলি কখনও আবার পশ্চিমাদের তুলোধুনো করা।
এমনকি তিনি নির্বাচনী সভায় নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হামলার ভিডিও দেখিয়ে ভোট চেয়েছেন। বিরোধী দলগুলোও কম যায় না। তারাও সরকারকে ঘায়েল করার জন্য সব ধরণের প্রচারণাও চালাচ্ছে।
তবে প্রচার প্রচারণার দিক দিয়ে ক্ষমতাসীন পক্ষ অনেক এগিয়ে। মূলধারার প্রচার মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমান তালে প্রচারণা চালাচ্ছে। এরদোগান প্রেসিডেন্ট হওয়ার কারণে তার প্রতিটা বক্তব্য সব মূলধারার গণমাধ্যমে সরাসরি প্রচার হয়। যা বিরোধী দলের নেতার জন্য প্রযোজ্য হয় না।
নির্বাচনে ইস্তানবুল, আঙ্কারা, ইজমির এর মতো বড় সিটি কর্পোরেশনগুলোতে ক্ষমতাসীন একে পার্টি হেভিওয়েট প্রার্থী দিয়েছে।
যেমন, ইস্তানবুলের প্রাথী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম, আঙ্কারার প্রার্থী সাবেক সাবেক পরিবেশ ও শহর পরিকল্পনা মন্ত্রী মেহমেত ওজহাসেকি, ইজমিরে লড়ছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী নিহাত জেইবেকচি।
অন্যদিকে বিরোধী জোট অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত প্রার্থী নিয়ে এবারের নির্বাচনে লড়ছে।
তবে বিরোধীদের বিশেষ সুবিধা হচ্ছে বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা। গত বছর আগস্ট মাস থেকে আমেরিকার সঙ্গে দ্বন্দ্ব দেশে অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে। সরকার বিভিন্নরকম প্রতিশ্ৰুতি দিয়েও সে অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি করতে পারেনি। আস্তে আস্তে এর প্রভাব পড়তে শুরু করে সাধারণ মানুষের মাঝে।
সাধারণ জনগণ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু তারা যখন সরাসরি এই মন্দাবস্থায় আক্রান্ত হয় তখন সরকারের বিরোধিতা শুরু করে। আস্তে আস্তে দিন যত যায় তাদের আওয়াজ তত সোচ্চার হয়। পরে তা গণ আন্দোলনে রূপ নেয়।
তুরস্ক এখনও ওই পর্যায়ে পৌঁছায়নি। কিন্তু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনমত সকারের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে নেয়া পদক্ষেপগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। সরকার যদিও বলছে নির্বাচনের পর তুরস্কের অর্থনীতি আরো ভালো হবে। তবে এই দুরবস্থা খুব শীঘ্রই কাটিয়ে ওঠার কোনো লক্ষণ নেই।
মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ২০ শতাংশের ঘরে। বেকারত্বের হার ১১ শতাংশ। ব্যাংকে সুদের হার প্রায় ২০ শতাংশ। তুর্কি লিরার দরপতন হয়ে এখন এক ডলারের দাম ৫.৫ লিরা যা এক বছর আগেও ছিল ৩.৬ লিরা।
সরকার নির্বাচনের পরে সব কিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিলেও এমন অলৌকিক কিছু করতে পারে নাই যা দিয়ে তারা একথা জনগণকে বিশ্বাস করাতে পারছে।
তবে সিরিয়াতে কুর্দি গেরিলা বাহিনীর উত্থান, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই কুর্দি গ্ৰুপটিকে অস্র গোলাবারুদ দিয়ে একচেটিয়া সমর্থন, ট্রাম্প প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তুরস্ককে চাপে রাখা এ সব বিষয় নিয়ে জনগণ এরদোগান সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে।
তুর্কি জনগণ খুব ভালো করেই জানে যে এখনও দেশে এরদোগানের প্রতিপক্ষ কেউ নেই। বিরোধী দলও যে রাতারাতি সব ঠিক করে দিবে সে যোগ্যতা এবং কৌশলও তাদের নেই। আর এই স্থানীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের প্রার্থীরা হারলেও যে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হবে তাও না। তবে এরদোগানকে একটা সতর্কবাণী হিসেবে জনগণ এই নির্বাচনে তার দলকে প্রত্যাশিত সমর্থন নাও দিতে পারে।
সর্বশেষ প্রকাশিত জনমত জরিপ গুলোতে দেখা যায়, বড় সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে শুধুমাত্র ইস্তানবুলে এরদোগানের জোট শক্ত অবস্থানে আছে। ইজমির বিরোধী দল সিএইচপির সবচেয়ে শক্তিশালী দুর্গ তাদেরকে সেখানে হটানো অসম্ভব। তবে রাজধানী আঙ্কারা প্রায় ২০ বছর পর এবার ক্ষমতাসীনদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
নির্বাচনের ফলাফলে কুর্দিদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কুর্দিদের বিশাল একটি অংশ এতদিন এরদোগানের একে পার্টিকে সমর্থন দিয়ে আসছে। কিন্তু এই নির্বাচনে কুর্দি বিরোধী কট্টর জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে জোট করায় এরদোগানের পার্টির প্রতি কুর্দিদের সমর্থনে ভাটা পড়েছে।
তবে কুর্দিদের রাজনৈতিক দলটি বিরোধী জোটকে নীরবে সমর্থন দিলেও প্রকাশে কিছু বলতে পারছে না। কারণ বিরোধী জোটে আছে আরেক কুর্দি বিরোধী দল আইপি (IYI Parti)।
সুতরং, সব মিলিয়ে রবিবারের ভোটাভুটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। সরকারি জোট এই নির্বাচনকে তুরস্কের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই বলে ঘোষণা দিয়েছে অন্যদিকে বিরোধীদল এই নির্বাচনকে দেখছে এরদোগানের ক্ষমতার ভিত ধরে টান মারার শেষ সুযোগ হিসেবে। কারণ স্বাভাবিক হিসাব অনুযায়ী আগামী সাড়ে চার বছরে তুরস্কে আর কোনো নির্বাচন হওয়ার কথা না। তবে রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। সবকিছু দেখার জন্য রোববার মধ্যরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।