বিজয় আনন্দের। কিন্তু যে বিজয় আতঙ্কের, যে বিজয় গণতন্ত্রকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়, সে বিজয় কতখানি সাধারণের আর কতখানি ক্ষমতালিপ্সু শাসকের? যে বিজয় মানুষের কণ্ঠকে রোধ করে সে বিজয় আর যা–ই হোক জনগণের থাকে না। সেটা নাগরিকের ভোটেই হোক আর জোর করেই হোক। ব্রাজিলের সদ্য দায়িত্ব গ্রহণ করা প্রেসিডেন্ট ‘ট্রপিকালের ট্রাম্প’ বলে পরিচিত জাইর বোলসোনারোর কথা বলছিলাম। গেল অক্টোবরে বোলসোনারো নির্বাচিত হওয়ার পরপরই ব্রাজিলকে ঘিরে ফিসফাস, ওখানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত কী? ব্রাজিলের রাজনীতি কোন পথে যাবে। বোলসোনারো কর্মকাণ্ড কেবল ব্রাজিলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকলেই হতো। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, দক্ষিণ আমেরিকা ও বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে বোলসোনারোর ক্ষমতায় আরোহণ। ১৯৯৩ সালে তিনি প্রকাশ্যে স্বৈরতন্ত্রের পক্ষে বলেন। বলেন নির্যাতনের পক্ষে। এমনকি তিনি ভোটেও বিশ্বাসী নন। তাই প্রশ্ন, জিতলেন কীভাবে?
ফুটবলের জন্য বিখ্যাত ব্রাজিল। স্বৈরশাসনের জন্যও দৃষ্টি কাড়ে ব্রাজিল। অনেকেই শঙ্কায় আছেন ব্রাজিলে কি এবার নির্বাচিত একনায়কত্ব ফিরে আসবে। ইতিহাসের অনেক ফ্যাসিস্ট শাসকেরাই কিন্তু নির্বাচিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে জার্মানির হিটলার ও ইতালির মুসোলিনি উল্লেখযোগ্য। তাই নির্বাচিতরা যে কখোনই ফ্যাসিস্ট হতে পারেন না বা হবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে ইতিমধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন ট্রাম্পপন্থী একজন।
বোলসোনারো ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়ে অক্টোবরে নির্বাচিত হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়ার্কার্স পার্টির ফার্নান্দো হাদ্দাদ পেয়েছিলেন ৪৪ শতাংশ ভোট। নির্বাচনে তেমন অনিয়মের তথ্য পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে পাওয়া যায়নি। কিন্তু বোলসোনারোর বিজয়ের সঙ্গে অস্বস্তিও বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বোলসোনারো ব্রাজিলের অভ্যন্তরীণ নীতিতে বিভিন্ন পরিবর্তন আনবেন। আক্রান্ত হতে পারে আমাজন বন। এই আমাজনের ওপর পশ্চিমের মুনাফালোভী কোম্পানিগুলোর শ্যেনদৃষ্টি রয়েছে অনেক কাল ধরেই। আদিবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নির্বাচনী প্রচারণায় বোলসোনারো বিভিন্ন বর্ণবাদী, নারীবিরোধী উত্তেজক বক্তব্য দিয়ে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে তাঁকে ছুরিকাঘাত করা হলে তাঁর জনপ্রিয়তা ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ওদিকে ওয়ার্কার্স পাটির লুলা ডি সিলভা দুর্নীতির দায়ে জেলে থাকায় বোলসোনারো নির্বাচনে বলতে গেলে ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছেন। তেমন কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হয়নি।
জার্মানির বন শহরে বসে একবার ব্রাজিলের পরিবেশমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছিল ২০১২ সালে। ওই মন্ত্রী বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছিলেন, ‘ব্রাজিল থেকে আমরা দারিদ্র্যতা হটিয়ে দিয়েছি। ব্রাজিলে আর কোনো দরিদ্র লোক নেই। সবাই কমপক্ষে দিনে দেড় ডলার খাদ্যের জন্য ব্যয় করতে পারে। সামাজিক নিরাপত্তার পরিধি বেড়েছে। বেকার ভাতা দেওয়া হচ্ছে। বিনা মূল্যে শিক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। দমন–নিপীড়ন কমেছে। মানুষ এখন স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে।’ সামরিক শাসনামলের মত কেউ হারিয়ে যায় না। লুলা ডি সিলভার হাত ধরে ব্রাজিল বদলে গিয়েছে। কিন্তু ২০১১ সালে দিলমা রুসেফ ক্ষমতায় এসে লুলার আমলের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ধরে রাখতে পারেনি। বিশেষ করে সাম্প্রতিক মন্দার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি ব্রাজিল। সঙ্গে যুক্ত হয় দুর্নীতির অভিযোগ। জনঅসন্তোষ বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমাদের চাপও জেঁকে ধরে ব্রাজিলকে।
এ সুযোগেই এগোতে থাকে চরম দক্ষিণপন্থী নেতা বোলসোনারো। একদিকে বোলসোনারোর পুঁজিবাদী উন্নয়নের মুলো, আরেক দিকে শ্রমিক দলের বৈষম্য থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি। এর মধ্যে বোলসোনারোকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন আদালত। গত বছর লুলা ডি সিলভাকে দুর্নীতির দায়ে আটক করে সাজা দেওয়া হয়। আদালত প্রশ্নবিদ্ধ রায়ে লুলাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেন। ব্রাজিলের লুলাপন্থীদের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনে আন্তর্জাতিক বলয় ব্রাজিলে পালাবদলে ভূমিকা রাখে।
বোলসোনারোর নারীবিরোধী মন্তব্যের পর তাঁর বিরুদ্ধে ‘নট হিম’ বা ‘তিনি নন’ হ্যাশট্যাগ আন্দোলন শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই আন্দোলনে অর্ধকোটি নারী একাত্মতা প্রকাশ করেন। বোলসোনারোর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে প্রচারণায় নামে ব্রাজিলের লাখো জনতা। ভোটের আগে সামাজিক যোগযোগমাধ্যমের জরিপগুলো ধারণা দিচ্ছিল বোলসোনারো পরাজিত হবেন। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত বোলসোনারোই জয়লাভ করেন। ধারণা করা হয়, শুধু ব্রাজিলের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোই নির্বাচনে ভূমিকা রাখেনি। আন্তর্জাতিক চক্রও বোলসোনারোর বিজয়ে ভূমিকা রাখে। বোলসোনারোর এই বিজয় ২০০০ সালের ক্রমেই অবস্থান হারানো যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও দক্ষিণ আমেরিকায় প্রবেশের সুযোগ করে দেবে। সাম্প্রতিক সময়ে নিকারাগুরা, প্যারাগুয়ে, আর্জেন্টিনা ও চিলিতে মার্কিনপন্থীরা জয়লাভ করেছে। দক্ষিণ আমেরিকায় চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্টের কৌশলগত লড়াই আছে। দক্ষিণের প্রাকৃতিক সম্পদ, বাজার দখল করতে, চীনের আগ্রাসী ভূমিকা রোধ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
ব্রাজিল আর জলবায়ু চুক্তিতে সেভাবে সক্রিয় থাকবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। বরং বোলসোনারো আমাজনের বাণিজ্যিকীকরণ করতে আগ্রহী। অথচ ব্রাজিল জলবায়ু রাজনীতিতে চীন, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই স্বল্পোন্নত ও উন্ননয়শীল দেশগুলোর নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। কার্বন নিংসরণ রোধে ব্রাজিল কার্যকর ভূমিকাও রাখতে শুরু করেছিল। জলবায়ু রাজনীতিতে ব্রাজিলের যেকোনো ধরনের নিষ্ক্রিয়তা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এমনিতেই জলবায়ু কূটনীতি ব্যর্থ হয়েছে। ব্রাজিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে যোগ দিলে তা পুরোপুরিই শেষ হয়ে যাবে।
বোলসোনারো পররাষ্ট্রনীতি আরও একটি কারণে সমালোচিত হতে পারে। ইতিমধ্যে ব্রাজিল তাদের দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ব্রাজিলের এই ঘোষণায় গদগদ হয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তামাম দুনিয়ার চরম দক্ষিণপন্থী নেতাদের সঙ্গে ১ জানুয়ারি বোলসোনারোর দায়িত্ব গ্রহণের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, পর্তুগালের চরম দক্ষিণপন্থী বর্ণবাদী নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বোলসোনারোর ক্ষমতা লাভ কোনোভাবেই উদার পররাষ্ট্রনীতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়।
ভালো সংবাদ নয় ব্রাজিলের আদিবাসীদের জন্যও। আমাজনের আদিবাসীরা নীরব গণহত্যার শিকার হচ্ছে। অপরিচিত আততায়ীরা আদিবাসীদের ধরে নিয়ে যাছে। এদের অনেকেই আর ফিরে আসছে না। অজ্ঞাত ব্যক্তিরা আদিবাসীদের গুলি করছে, আবাসভূমিতে আগুন দিচ্ছে। বোলসোনারো আমলে আদিবাসীদের ওপর দমন, নিপীড়ন, হামলা, আগুন আরও বেড়েছে। আমাজনের আদিবাসীদের ভূমিহীন উল্লেখ করে জমি দখল করতে চাইছেন ব্রাজিলের সরকার–সমর্থক ব্যক্তিরা। বোলসোনারো বিজয় আদিবাসীদের দমন–নিপীড়নের পালে আরও হাওয়া দেবে।
ধাতবশ্রমিক লুলার রাজনীতিতে উত্থান শ্রমিকদের সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে। উত্তর-পূর্ব ব্রাজিলের এক গরিব পরিবারে জন্ম নেওয়া শ্রমিক লুলা কথা দিয়েছিলেন ব্রাজিলকে বদলে দেওয়ার। লুলা কতটুকু বদলাতে পেরেছিলেন ইতিহাসই তার সাক্ষী। ইতিহাস আরও সাক্ষী হয়ে থাকবে যে লুলার হাত ধরে সামরিক শাসন–উত্তর ব্রাজিলে যে নতুন ভোরের শুরু হয়েছিল, তারপর আরও এক ভোর ব্রাজিলবাসীর জীবনে নিয়ে এসেছে অনিশ্চয়তার নতুন পর্ব।
ড. মারুফ মল্লিক, ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন
No comments:
Post a Comment