চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছেন। শুক্রবার বেইজিংয়ে সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের (সিএমসি) এক সভায় তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনীকে অবশ্যই নতুন যুগের কৌশল বের করতে হবে এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি ও যুদ্ধ শুরুর দায়িত্ব নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক ও বাণিজ্য বিরোধ এবং তাইওয়ানের সঙ্গে নতুন করে সৃষ্ট উত্তেজনার মধ্যে চীনা প্রেসিডেন্টের এ ভাষণ নতুন বছরে সামরিক সংঘাতের আভাস দিচ্ছে। খবর সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, দ্য ডিপ্লোম্যাট ও নিউইয়র্ক টাইমস।
শি জিনপিং বলেছেন, ১০০ বছরেও দেখা যায়নি, এমন অনেক বড় পরিবর্তন চোখে পড়ছে। আর চীন এখন উন্নয়নের এক কৌশলগত সুযোগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। জাতীয় নিরাপত্তা ও উন্নয়নের ধরনগুলো সশস্ত্র বাহিনীর সবক’টি ইউনিটকে বুঝতে হবে। একই সঙ্গে যেকোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি, সংকট ও যুদ্ধের বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।
চীনা প্রেসিডেন্ট শুক্রবার দেশটির প্রতিরক্ষাবিষয়ক সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা সিএমসির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। এ সময় তিনি চীনের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য নতুন বছরের নির্দেশনায় আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেন। অনুষ্ঠানে শি জিনপিং পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) স্থল বাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, রকেট ফোর্স ও পুলিশ বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। পরে তার এ বক্তব্য চীনের টেলিভিশনেও সম্প্রচার করা হয়।
বছরের শুরুতে চীনা প্রেসিডেন্টের এ বক্তব্যকে দেখা হচ্ছে ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে বেইজিংয়ের পদক্ষেপ অথবা প্রস্তুতি হিসেবে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের রাজনৈতিক ও বাণিজ্য দ্বন্দ্ব সম্প্রতি বাড়তি উচ্চতা ছুঁয়েছে। গত বছরের শেষদিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনুমোদন করেছেন এশিয়া রিঅ্যাশিউরেন্স ইনিশিয়েটিভ অ্যাক্ট, যা হোয়াইট হাউজের ভাষায়, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও মূল্যবোধ জোরদারের বহুমুখী কৌশল।’ এরিয়া অ্যাক্ট নামে পরিচিত এ আইনের মাধ্যমে চীনের চারপাশের দেশগুলোর নিরাপত্তায় চলতি বছর ১৫০ কোটি ডলার ব্যয়ের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর বাইরে কারিগরি, প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য সহযোগিতাও থাকছে।
এরিয়ার আওতায় রয়েছে তাইওয়ান, ভারত, ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। এর মধ্যে লাওস, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুর ছাড়া সবক’টি দেশের সঙ্গেই চীনের ভূখণ্ডগত ও অন্যান্য বিরোধ চলছে বহুদিন ধরে। সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া সরাসরি বিরোধে না থাকলেও দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের নানা পদক্ষেপে উদ্বেগ জানিয়েছে দুই দেশই।
এরিয়া অ্যাক্ট অনুমোদনের দুদিনের মাথায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার মার্কিন নাগরিকদের চীন ভ্রমণে বাড়তি সতর্কবার্তা জারি করে। চীনের দুই কানাডীয় নাগরিক আটকের জেরে যুক্তরাষ্ট্র এ বার্তা জারি করে। এর আগে মার্কিন সরকারের অনুরোধে কানাডা কর্তৃপক্ষ চীনের অন্যতম প্রযুক্তি জায়ান্ট হুয়াওয়ের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার মেং ওয়ানঝুকে আটক করেছিল। তারই জেরে বেইজিং আটক করে কানাডার সাবেক এক কূটনীতিকসহ দেশটির দুই নাগরিককে।
যুক্তরাষ্ট্রের এরিয়া অ্যাক্ট অনুমোদনের দুদিনের মাথায় চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাইওয়ানকে একীভূত করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। এজন্য প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করতে চীন পিছপা হবে না বলেও তিনি বুধবার এক বক্তৃতায় বলেন। মাও জে দংয়ের পর চীনের সবচেয়ে শক্তিধর নেতা শি তাইওয়ান ইস্যুতে ওইদিনই প্রথম উল্লেখযোগ্য কোনো ভাষণ দেন। তবে বুধবারই তাইপেতে এক বক্তৃতায় তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন শির বক্তব্য নাকচ করে বলেন, তাইওয়ানকে জোর করে কারো সঙ্গে নেয়া যাবে না। চীনের ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নীতিও বাতিল হয়ে গেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তাইপে-বেইজিং বাগ্যুদ্ধের দুদিন পর শি জিনপিং সিএমসির বৈঠকে বললেন, চীনের সশস্ত্র বাহিনীকে অবশ্যই এমন সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে, যা একেবারেই নতুন কোনো জায়গা থেকে শুরু হবে। যুদ্ধের প্রস্তুতি জোরদার করতে হবে, যাতে যেকোনো পরিস্থিতিতে কার্যকর সাড়া দেয়া যায়। পিএলএকে এমন প্রস্তুতি নিতে হবে, যাতে সব ধরনের নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যায় এবং সবক’টি যুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত হয়।
তাইওয়ানের মর্যাদা, দক্ষিণ চীন সাগরে নৌ-চলাচল ও ভূখণ্ডগত দাবিসহ নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বিরোধ কয়েক দশকের পুরনো। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্কে নতুন কাঁটা হয়ে দেখা দেয় বাণিজ্য বিরোধ। পরস্পরের পণ্যে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপের ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার। হুয়াওয়ে, জেডটিইসহ প্রযুক্তি খাতে চীনের কয়েকটি কোম্পানির ওপর এরই মধ্যে পড়েছে মার্কিন নজরদারি ও নিষেধাজ্ঞার খড়্গ। তবে নীতিকাঠামোয় এসব চাপান-উতোর সত্ত্বেও আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ ও বৈঠকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও শি জিনপিং একে অন্যের প্রতি প্রকাশ্য হূদ্যতা দেখাতে পিছিয়ে থাকেননি।
No comments:
Post a Comment