মাদকের ভয়াবহ থাবায় বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যাই শুধু বৃদ্ধি পায়নি, আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যাও। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীর কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের বহির্বিভাগে প্রায় তিন দশক আগে মাদকাসক্ত পুরুষের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৯৬৪। সে সময় কোনো নারীই মাদকাসক্ত ছিলেন না। কিন্তু ২০১৬ সালে এসে পুরুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ১১৪-এ। তবে এ সময় মোট ৪৩ জন নারী মাদকাসক্তের কথা উল্লেখ করা হয়। এই হিসাবে পুরুষ মাদকাসক্তদের মতো নারী মাদকাসক্তেরও মাদক নিরাময়ে চিকিৎসার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু খোদ সরকারের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের অন্তর্বিভাগে পুরুষদের চিকিৎসার জন্য ৪০টি আসন থাকলেও নারীদের জন্য কোনো আসনই নেই। অথচ শিশুদের জন্যও এখানে ১০টি আসন আছে। অর্থাৎ সরকারিভাবে নারী মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই! বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে এখন অধিকাংশ নারীর মাদকাসক্তির বিষয়টি ‘সুপ্ত’ অবস্থায় আছে। আবার নারী মাদকাসক্তদের পরিবারও তাদের চিকিৎসায় অনাগ্রহী। বেসরকারিভাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে ঢাকায় ৬৩টি মাদক নিরাময় কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। মূলত এগুলোতেই বেশির ভাগ সেবাগ্রহীতা চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু সামাজিকতা ও লোকলজ্জার কারণে এ কেন্দ্রগুলো নারী মাদকাসক্তদের চিকিৎসাসংক্রান্ত তথ্যও লুকিয়ে রাখে। ফলে সেই নারীরা আসলে কোন ধরনের চিকিৎসা পাচ্ছেন তা জানা যাচ্ছে না। আবার পারিবারিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে অনেক নারীই চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
চিকিসৎক ও সংশ্লিষ্টরা জানান, নারী মাদকাসক্তদের চিকিৎসায় মূল বাধা হচ্ছে তার পরিবার। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে চিকিৎসার ব্যাপারে পরিবার কোনো সহযোগিতা করে না। অন্যদিকে পরিবারের সদস্যদের অনাগ্রহের পাশাপাশি সেই মাদকাসক্ত নারী নিজেও চিকিৎসার ব্যাপারে আগ্রহী নন। বেশির ভাগ ক্ষেত্র্রে মাদক গ্রহণের পর শরীর যখন আর সহ্য করতে পারে না এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন শুরু করেন, তখন নারীরা চিকিৎসা নেন। কিন্তু কিছুদিন বিরতি দিয়ে অনেকে আবারও মাদক গ্রহণ শুরু করেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের ত্রিশোর্ধ্ব বিবাহিত সুমি (ছদ্মনাম) নয় বছর বয়সেই বাবাকে হারান। এরপর সুমির মা আবার বিয়ে করেন। ২৫ বছর বয়সে সুমিকে একজন মাদকাসক্তের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। ছেলেটিও সুমিকে মাদক গ্রহণে উৎসাহিত করে। ফলে বিয়ের পর সেই সম্পর্ক বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। সুমি বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর মা-বাবার সঙ্গে কিছুদিন থাকেন। সে সময় একটি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাও নেন। একসময় সেখান থেকে বের হয়ে আবার বিয়ে করেন। কিন্তু পোড়া কপাল সুমির। এবারও স্বামী মাদকাসক্ত। এক বছরের মাথায় আবার মা-বাবার কাছে ফিরে যান তিনি। এবার সুমির অভিভাবক তাকে রাজধানীর আহ্ছানিয়া মিশনের নারী মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করান। তিন মাসের চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠেন সুমি। এখনো তার নিয়মিত চিকিৎসা চলছে। দেশজুড়ে নারী মাদকাসক্তদের চিকিৎসার বিষয়টি গুরুত্ব না পেলেও মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে আহ্ছানিয়া মিশন ড্রাগ এডিকশন ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড রিহেবিলিটেশন সেন্টারটি নারীদের বিজ্ঞানসম্মতভাবে থেরাপি দিয়ে তাদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। কর্তৃপক্ষ জানায়, এখানে আসা একজন রোগীকে তিন মাসের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ প্রতিষ্ঠানের প্রোগ্রাম অফিসার ও ফোকাল পারসন উম্মে জান্নাত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা তিন মাসের চিকিৎসায় রোগীর ডোপ টেস্ট, বিভিন্ন পরীক্ষা করাই। এ সময় পরিকল্পনামাফিক এমনভাবে সেই রোগীর চিকিৎসা হয় যে তিনি সুস্থ হয়ে নিজেই তার ভালোমন্দ ঠিক করেন।’
No comments:
Post a Comment