স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য শান্তভাবে আলোচনা করা উচিত। বিশেষভাবে সন্তানের সামনে তর্কে বা বিবাদে জড়ালে তা শিশুর মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ঝগড়া পর্যায়ক্রমে খারাপ শব্দ ব্যবহার ও অপমান-অশ্রদ্ধা উসকে দেয়, যা শিশুর মনে ব্যাপক ক্ষত সৃষ্টি করে। শিশু চারপাশের মানুষের কাছ থেকে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা করতে শেখে, যা মাতা-পিতার বিবাদপূর্ণ পরিবার থেকে সম্ভব নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মাতা-পিতার মধ্যে তর্কে ও বিবাদে লিপ্ত একটি পরিবারে যে শিশু বেড়ে ওঠে, তার মধ্যে এবং তার সহপাঠীদের মধ্যে বিবাদের প্রবণতা থাকে। ঝগড়াটে মনোভাব তার জীবনের একটি অংশে পরিগণিত হয়।
এসব বিবাদের মাধ্যমে শিশু তার ঝগড়াটে মাতা-পিতার ওপর বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে। মাতা-পিতা শিশুর জন্য অনুকরণীয় মডেল। মাতা-পিতার এমন আচরণে তার অনুকরণীয় বলতে তেমন কোনো কিছু আর বাকি থাকে না। এসব বিবাদের ধারাবাহিকতা শিশুকে তার মাতা-পিতার বা কোনো একজনের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি পুরো পরিবারের প্রতি বিরক্ত করে তুলতে পারে। তাই মাতা-পিতা নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত, এ ধরনের পরিবেশ কি একজন সফল ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে উপযোগী সন্তান উৎপাদন করবে?
এ ব্যাপারে হেলওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. ফিফান আহমেদ ফুয়াদ বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বাজে সম্পর্কের দরুন শিশুদের চরিত্রের মধ্যে নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ে। এটি তার মধ্যে সামাজিক ভীতি ও অনিরাপত্তামূলক মনোভাবের বৃদ্ধি ঘটায়। এটি বিদ্যালয়ে তার স্বকীয়তা দুর্বল করে দেয় এবং তার মনোযোগ ও শেখার সক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। যে শিশু এমন পরিবারে বেড়ে ওঠে, যেখানে সাংসারিক বিবাদ নিত্যনৈমিত্তিক লেগে থাকে—তার রুমে বা ঘরের কোনো এক কোণে, ওই শিশুর মধ্যে সব সময় ভয়, আতঙ্ক ও প্রতিশোধমূলক চিন্তা কাজ করে। এতে শিশুর ভয় বেড়ে যায় ও সে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তার শরীরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বেড়ে যায়। পেটের ভ্যাগাস নার্ভক্রিয়া ব্রেনে রক্তের পরিমাণ পৌঁছানো কমিয়ে দেয়। এসব উপসর্গ তার সচেতনতা ও মনোযোগ কমিয়ে দেয়। ফলে শিশুর যথাযথ বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তোমাদের বের করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে এমন অবস্থায় যে তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তর। যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৭৮)
শোনা, দেখা ও হৃদয়ঙ্গম করা—এই তিনটি বিষয় শেখার প্রধান অনুষঙ্গ। এগুলো আল্লাহর নিয়ামত। এগুলোর অপব্যবহারের জন্য কখনো কখনো ব্যক্তি যেমন দায়ী, সমাজ ও পরিবেশও দায়ী। তাই শিশুবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখা জরুরি। শিশুর জীবনে পরিবেশের প্রভাব কত বেশি, এক হাদিস থেকে বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক নবজাতক ফিতরতের ওপর (ইসলাম বা সত্যগ্রহণের যোগ্যতা নিয়ে) জন্মগ্রহণ করে। এর পর তার মাতা-পিতা তাকে ইহুদি বা খ্রিস্টান অথবা অগ্নি-উপাসকরূপে রূপান্তরিত করে। যেমন—চতুষ্পদ জন্তু একটি পূর্ণাঙ্গ বাচ্চা জন্ম দেয়। তোমরা কি তাকে (জন্মগত) কানকাটা দেখেছ?’ (বুখারি, হাদিস : ২৪৪৬)
এ বিষয়ে করণীয় কী—
♦ শিশুদের সামনে স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক বিবাদে না জড়ানো।
♦ যদি স্বামী-স্ত্রী কেউ অনুধাবন করতে পারে যে আলোচনা ঝগড়ায় রূপ নিচ্ছে, তখন তাদের কেউ একজন নীরব স্থানে চলে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু সময় সতেজ বাতাস গ্রহণ বা ড্রিম লাইটসমৃদ্ধ রুমে আরামদায়ক চেয়ারে বসা। যতক্ষণ না তাদের একজন শান্ত ও স্বাভাবিক হয়ে যায়।
♦ আলোচনা ও ধৈর্যের সঙ্গে সাংসারিক বিবাদের একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাধানে পৌঁছার চেষ্টা করা।
♦ মাতা-পিতাকে শিশুদের সামনে একটি আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করা ও তাদের শিক্ষা দেওয়া—কিভাবে চিন্তা ও মতামত শান্তভাবে উপস্থাপন করা যায়। তাকে বোঝাতে হবে যে অন্যের অধিকার কখনো লঙ্ঘন হতে দেওয়া যাবে না।
♦ সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য উপযুক্ত সময় ও পরিবেশ নির্বাচন করা। সমস্যা নিয়ে আলোচনা যেন খাবারের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সময় বা ঘুমের সময় না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা।
♦ মাতা-পিতাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝতে হবে যে সব সময় সাংসারিক বিবাদ শিশুর শারীরিক সমস্যা ও মনস্তাত্ত্বিক অসংগতি বৃদ্ধি করে। এর মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলো, বেড ওয়েটিং (বিছানায় প্রস্রাব) ও দুঃস্বপ্ন।
♦ শিশুদের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের কোনো ভ্রমণে গিয়ে বা শিশুরা ভালোবাসে—এমন কিছু দেখতে গিয়ে চাপ কমানো উচিত।
পরিশেষে মাতা-পিতা উভয়কেই মনে রাখতে হবে যে তাঁরাই হচ্ছেন শিশুর আদর্শ, যাঁদের শিশু অনুকরণ করবে। শিশুদের মনোভাব ও আচরণ রূপায়ণের ওপর তাঁদের গভীর প্রভাব রয়েছে।
লেখক : শিক্ষক, মাদরাসাতুল মদিনা, নবাবপুর, ঢাকা।
No comments:
Post a Comment