Social Icons

Saturday, March 31, 2018

মালয়েশিয়ায় কারাগারে আটক প্রবাসীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন

মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে কুয়ালালামপুর থেকে ঢাকা ফিরছিলাম। ফ্লাইটের একেবারে পেছনের সারিতে আমার সিট। আশেপাশে যাদের সিট পড়েছে তারা সবাই প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক। কিন্তু তাদের বেশভুষা, আচার-আচরণ সবকিছুতে একটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলাম। কঙ্কালসার চেহারা, ছেঁড়া জামাকাপড়। সবাই কেমন যেন উদভ্রান্ত ও উত্তেজিত। মনোযোগ দিয়ে তাদের কথোপকথন শোনার চেষ্টা করলাম। আমার ডানপাশের রো-তে একসিট সামনে বসা বয়স্ক একজন ফ্লাইটে বসেই দেশের বাড়িতে পরিবারের সাথে কথা বলে উত্তেজিতভাবে।  বাকিদেরকে বললেন তার বাড়িতেও দুইজন দালাল গিয়ে একজন ৩০ হাজার আরেকজন ৩৫ হাজার মোট ৬৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আরেকজন হট্টগোল শুরু করে দিয়ে বলেছে দালালরা তার বাড়ীতে গিয়ে মহিলাদের বলেছে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে না আনলে তার ২ বছরের জেল হয়ে যাবে তাই পরিবারের সদস্যরা সেই টাকা দিয়ে দিয়েছে। তারা সবাই মিলে ফ্লাইটে বসেই দালালদের এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের অভিশাপ দিচ্ছিল।
জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম ভিসা অবৈধ হয়ে যাওয়ায় তারা সবাই বিভিন্ন মেয়াদে মালয়েশিয়ায় জেল খেটে আজই মুক্তি পেয়েছে। অবৈধ হয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে অবধারিত জেল এবং তা থেকে মুক্তির নিয়ম হচ্ছে দেশ থেকে জুম্পা(দেশে ফিরার টিকেট) আসতে হবে। কিন্তু তারা বিভিন্ন জায়গায় কাজ থেকে ধরা পড়ার পর দেশে পরিবারকে এই সংবাদ কোনভাবে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তাদের সাথে জেল খাটা কেউ মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসার সময় তারা সবাই হুমড়ি খেয়ে যার যার দেশে আত্মীয়-পরিজনের ঠিকানা দিত এবং কাকুতি-মিনতি করে বলত তার সংবাদটা পরিবারকে পৌঁছিয়ে একটা জুম্পা(দেশে ফিরে আসার ওয়ান ওয়ে টিকেটের দাম ১৪-১৫ হাজার টাকা) আনার ব্যবস্থা করতে। জুম্পাতো দূরের কথা দালালরা বসে আছে এইসব তথ্য যোগাড় করে পরিবার থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতে।
কোন কোন অতি ভাগ্যবান হতভাগার সংবাদ সত্যি সত্যিই দেশের বাড়িতে যায়, জুম্পাও জোটে এবং সেই সুবাদে নরকযন্ত্রনা থেকে মুক্তি মেলে যেভাবে এদের আজ মিলেছে। মালয়েশিয়ার জেলে তাদের নরকযন্ত্রণার বর্ণনা দিচ্ছিল এভাবে- একমুটো ভাত, একটুখানি লাউয়ের মত সবজি এই দিয়ে পুরো দিন পার করতে হত, পেট ভরাতো দূরের কথা দিন দিন কঙ্কালসার হতে হয়।
একটি হাফ প্যান্ট ও একটি জামা এই দিয়ে চলতে হয়। ছোট্ট একটা রুমে ১শ-দেড়শ লোক একটি টয়লেট।  টয়লেটে যাওয়ার জন্য সবসময় ২০-৩০ জনের লাইন। কে কোথায় টয়লেট করছে তার ঠিক নাই, প্রায় ক্ষেত্রেই একজন আরেকজনের শরীরের উপর প্রস্রাব করে দিচ্ছে, একটি মাত্র জামা থাকায় সবার সামনে উলংগ হয়ে গোসল করতে হয়।  জামা-কাপড় ধোয়া বা শুকাতে দেওয়ার ক্ষেত্রে উলংগ হয়ে থাকা ছাড়া কোন উপায় নাই। পুরো রুমে তীব্র উৎকট দুর্গন্ধে জান বের হয়ে আসার উপক্রম। আর পান থেকে চুন খসলেই মালয়েশিয়ান পুলিশের অমানুষিক শারিরীক নির্যাতন।
জেলে প্রায় সবাই নাকি চর্মরোগে আক্রান্ত, কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় এই চর্মরোগ ভয়াবহভাবে দৃশ্যমান। আর মালয়েশিয়ান পুলিশ যখন সেই আক্রান্ত স্থানেই লাঠির আঘাত করে তাদের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়। কথা বলছিল আর লোকগুলো সমানে কান্না করছিল।
এর মধ্যে রয়েছে আবার মালয়েশিয়ার দুর্নীতিবাজ পুলিশদের নানারকম ব্যবসা। একেকজনকে ২০০ রিংগিটের বিনিময়ে ৩০ সেকেন্ড করে কথা বলার সুযোগ দিত। কেউ ফোন করলে আমি জেলে আছি আর এই নম্বরে ২০০ রিংগিট(প্রায় ৪৩০০ টাকা) ফ্লেক্সি কর এই বলতে না বলতেই মোবাইল নিয়ে গেছে। কারো ক্ষেত্রে রিংগিট না আসলে তার উপর শুরু হত অমানবিক নির্যাতন। ৬২ বছর বয়সের নারায়নগঞ্জের সিরাজ মিয়া(কিন্তু তাকে দেখতে দেখাচ্ছে ৭৫ বছরের বৃদ্ধের মত) বললেন অল্প খাবার আর সার্বিক পরিবেশের কারণে মাসে তিনি ৩/৪ বারের বেশি টয়লেটে যেতেন না। গোসল করতেন প্রতি ১০ দিনে একবার(একই রুমে তার ২ ভাতিজা থাকায় উলংগ হয়ে গোসল করার সময় লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করত)।
তাবলীগ জামাত ভক্ত মাদারীপুরের ৫৭ বছর বয়স্ক লোকমান হেকীম ১৯৯৬ সাল থেকে মালয়েশিয়ায় থাকেন। এই বৎসর চিরতরে দেশে ফিরে যাবেন বলে ভিসা আর নবায়ন করেন নি। তার ভিসার মেয়াদও শেষ হয়নি। এই অবস্থায় ধরে তাঁকে জেলে দিয়ে দিয়েছে। শত অনুনয় বিনয়েও কাজ হয়নি। দেশে ফিরে আসবেন বলে নিজের মেয়ের জন্য অলংকারসহ বেশ কিছু কেনাকাটাও করেছিলেন।  যেখানে কাজ করতেন তার মালিক এবং বিভিন্ন জনের কাছ থেকে তার পাওনাও ছিল প্রায় ১০-১৩ লাখ টাকার মত। সবকিছু ফেলে আসতে হয়েছে তাকে। তবে তিনি সবচেয়ে বড় আঘাতটা পেয়েছেন যেদিন মালয়েশিয়ান পুলিশ তার তাবলীগ জামাতের চিহ্ন, লম্বা দাড়ি ফেলে দেয়। তাঁর শত চিৎকার ও কান্নাকাটিতেও পুলিশ রেহাই দেননি। তিনি তাহাজ্জুতসহ এক ওয়াক্ত নামাজও কাজা করেন নি কিন্তু তার সন্দেহ আদৌ তিনি পরিপূর্ণ পাক হয়ে নামাজ পড়তে পেরেছেন কি না।
তাদের সাথে কথা শুরু হওয়ার একটু পরেই কেবিন ক্রু খাবার সার্ভ করা শুরু করে। তাঁদের অভুক্ত কঙ্কালসার অবস্থা দেখে নিজের খাবারসহ কেবিন ক্রুকে তাদের অবস্থা বর্ণনা করে অনুরোধ করি বাড়তি খাবার থাকলে তাদেরকে দিতে। অতিশয় দয়ালু মালয়েশিয়ান তামিল ছেলেটি তাদের সবাইকে চাহিদামত ২/৩ সেট করে খাবার দেয়। লোকমান হেকিম আমার হাত ধরে বলেন- বাবা, গত ৬ মাসে এই প্রথম পেট ভরে খেলাম।
অসহায় নির্যাতিত এসব প্রবাসীদের  সকল অভিযোগ বাংলাদেশ দূতাবাসের বিরুদ্ধে। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন জেলে এইরকম হাজার হাজার বাংলাদেশি প্রবাসী নরকযন্ত্রণা ভোগ করলেও দূতাবাস তাদের খবর নেয়না। অথচ দূতাবাস চাইলেই এই খবরটি দেশে পরিবারের কাছে পৌছে দিয়ে তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে পারে। নারায়নগঞ্জের সিরাজ মিয়াতো তাঁর আত্মীয় প্রভাবশালী সরকারী দলের নেতাকে নিয়ে ১০ তলা ভবনে গিয়ে(তিনি বাংলাদেশ দূতাবাস কিংবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বুঝিয়েছেন) অবশ্যই কৈফিয়ত চাইবেন। সেই সংকল্প করে গেলেন। লোকমান হেকিম আমার কাছে অনুনয় বিনয় করলেন- সরকারকে বলে এই মানবেতর জীবন যাপনরত বন্দীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে পারি তবে ১০  হজ্জের সমান সওয়াব পাব। ওরা কেউই চোর-বাটপার নয়, ভাগ্যের ফেরে অথবা মালয়েশিয়ান সরকারের নানা নিয়ম-কানুন অথবা কাগজপত্র জটিলতায় অবৈধ হয়েছেন।
লাখ লাখ প্রবাসীর রেমিটেন্সে বাংলাদেশ আজ একের পর এক উন্নয়নের সিঁড়ি পেরিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছে। অথচ তাদের কেউ কেউ যখন ভাগ্যের ফেরে অবৈধ হয়ে যাচ্ছে তখন কি রাষ্ট্রের কাছে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার দাবীটুকুও চাইতে পারেন না ! একসময় আমেরিকার গুয়ানতানামো-কুখ্যাত কারাগারের নাম শুনেছি, কিন্তু এই শ্রমিকদের কাছে মালয়েশিয়ান কারাগারের বর্ণনা শুনে আমার এটাকে তার থেকেও ভয়ংকর মনে হয়েছে।

No comments:

Post a Comment

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি

সম্পাদকীয় কার্যলয়

Rua padre germano mayar, cristo rio -80040-170 Curitiba, Brazil. Contact: +55 41 30583822 email: worldnewsbbr@gmail.com Website: http://worldnewsbbr.blogspot.com.br

সম্পাদক ও প্রকাশক

Jahangir Alom
Email- worldnewsbb2@gmail.com
worldnewsbbbrazil@gmail.com
 
Blogger Templates