মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের দেশগুলোতে যখন বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়ে সংকট তৈরী হয়েছে, তখন আটলান্টিকের ওপারে ল্যাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে উদ্বেগ ও হতাশা দেখা দিয়েছে অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশি বন্দিদের নিয়ে।উন্নত জীবন আর অর্থ আয়ের নেশায় অভিবাসীরা যখন ইউরোপ পাড়ি দিচ্ছে। ঠিক তখন কিছু বাংলাদেশি জীবন বাঁজি রেখে দালালদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। অবৈধ পথে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখা গেছে এইসব অভিবাসীরা ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে বন্দি জীবনযাপন করছে। যাদের বেশিরভাগই মেক্সিকো, পানামা, এলসানভেদর, ভেনিজুয়েলা এবং নিকারাগুয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের কারাগারে বন্দি রয়েছে। আটক এসব বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অগ্রগতিও দেখা যাচ্ছে না তেমন। আর এ কারণে এসব বাংলাদেশিরা বন্দিশালায় মানবেতর জীবন যাপন করছে বছরের পর বছর।
অবৈধ পথে ল্যাটিন আমেরিকায় প্রবেশ করা অভিবাসন প্রত্যাশী নোয়াখালীর সুজন আলম। যিনি যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের প্রত্যাশায় ২০১৪ সালে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন করেছিলেন সুদীঘ পথ । লাতিন আমেরিকার দেশ বলিভিয়া থেকে তার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের যাত্রাপথ শুরু হয়। এরপর পেরু, একুয়েডর, কলম্বিয়া ও পানামা হয়ে পৌঁছেন মেক্সিকোয়। এর মধ্যে একুয়েডর ও পানামার রেইনফরেস্টের পুরোটাই তাকে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয়। এই দুর্গম ও বিস্তীর্ণ জলরাশি পাড়ি দিয়ে গিয়ে তাকে কখনো কখনো মৃত্যুর কিনারে উপনীত হতে হয়েছে। সুদীর্ঘ্ এই পথ পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কিনারে পৌঁছাতে তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে ১১টির মত দেশ। সর্বশেষ মেক্সিকো সীমান্ত পার হতে গিয়ে আটক হন দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে।
সুজন আলমের মত এভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের নেশায় ছুঁটতে গিয়ে অনেক অভিবাসী বাংলাদেশীর ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে ল্যাটিক আমেরিকার কারাগারকে। অভিবাসন প্রত্যাশার নেশায় অবৈধ পথে এসব বাংলাদেশিরা দালাল কিংবা মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে টাকা পয়সা খুঁইয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে দিনের পর দিন। পরিসংখ্যনগত দিক দেখা দেখা গেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের পথে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি আটক রয়েছে প্রতিবেশি দেশ মেক্সিকোর কারাগারে।
ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রত্যাশী ১৪৯ জন বাংলাদেশী লাতিন আমেরিকা, বিশেষ করে মেক্সিকোয় আটক হয়েছেন। ২০১২ সালে আটকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬৭। পরের বছরগুলোয়ও মেক্সিকোর কারাগারগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ পথে গমনের দায়ে আটক অভিবাসন প্রত্যাশীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ২০১৩ সালে আটক হয়েছিলেন ৩২৮ জন, ২০১৪ সালে ৬৯০, ২০১৫ সালে ৬৪৮ ও ২০১৬ সালে ৬৯৭ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১২০ জন আটক হওয়ার কথা জানা গেছে। এরা সবাই বর্তমানে মেক্সিকোর কারাগারে বন্দিদশা পার করছেন।
এর বাইরে কলাম্বিয়া,পানামা,কোস্টারিকা,নিকারাগুয়া,এলসানভেদর,ভেনিজুয়েলাসহ আরও বিভিন্ন দেশে বহু বাংলাদেশি বন্দিশালায় মানবেতর জীবনযাপন করছে।
অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন কমকর্তারা জানিয়েছে, ল্যাটিন আমেরিকায় বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের বন্দি থাকার কারণ হলো- অবৈধ পথে অভিবাসীদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে দালাল কিংবা মানব পাচারকারীরা রুট হিসেবে ১০-১২ টি দেশকে ব্যবহার করে। এক দেশে থেকে আরেকে দেশের সীমান্ত পার করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির পুলিশ কিংবা সীমান্তরর্ক্ষী বাহিনীর হাতে আটক হয়।
অভিবাসন কর্মীরা আরও জানিয়েছে, যেসব বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রত্যাশার জন্য ছুঁটছে, তাদেরকে পাচারকারীরা সাধারণত জনবহুল এলাকা এড়িয়ে মরুভূমি, পাহাড় কিংবা জঙ্গলপথ বেছে নেয়। কারণ এসব স্থানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি কম থাকে। তবে এই দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন অনেকেই। কেউ কেউ অসুস্থও হয়ে পথ অতিক্রম না করতে পেরে ধরা পড়েন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।
মার্কিন সীমান্তরক্ষী বাহিনী ১৯৯০ সালের পর থেকে শুধু মেক্সিকোর সীমান্ত এলাকায়ই ছয় হাজারের বেশি মরদেহ উদ্ধার করেছে । এর মধ্যে কতজন বাংলাদেশী, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যানও নেই।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো অভিবাসন প্রত্যাশীরা আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের কবলে পড়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রে তারা মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রত্যাশীদের জিম্মি করে মোটা অংকের অর্থ আদায় করা হয়। অর্থ আদায়ের কৌশল হিসেবে অভিবাসন প্রত্যাশী দু-একজনকে হত্যা করে বাকিদের ভয় দেখায় অপরাধী চক্র। মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে অনেকেই তাদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকার সংস্থান করতে বাধ্য হন।
স্বাধীনতার পর থেকেই কিছু বাংলাদেশি রাজনৈতিক আশ্রয়ের পাশাপাশি শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কাজের চাহিদায় যুক্তরাষ্ট্রে যেতে অনুমতি পায়। এরপর ১৯৯০ সালের দিকে ডিভি লটারির সূত্র ধরেও অনেক মানুষ দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ পান। ডিভি লটারি প্রোগ্রামের আওতায় গ্রিন কার্ড পেয়ে দেশটির নাগরিকত্বও পেয়েছেন অনেকে। সেই নেশায় অনেকে বিভোর হয়ে অনেকে অবৈধ পথে আমেরিকায় পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত।
No comments:
Post a Comment