স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় আসার সময় গত চার বছরে পানিতে ডুবে অথবা গভীর অরণ্যে হিংস্র জানোয়ারের পেটে গেছে শতাধিক বাংলাদেশিসহ চার হাজার অভিবাসীর প্রাণ।
মানবাধিকার সংস্থা, ফেডারেল স্বাস্থ্য ফতর এবং কমিউনিটিভিত্তিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সর্বশেষ ৪ ডিসেম্বর কাজী আবুল আজিজ (২০) নামক এক বাংলাদেশি তরুণের লাশ শনাক্ত করা হয়েছে। তার বাড়ি নোয়াখালী জেলার রাম নারায়ণপুর ইউনিয়নের গোমাতলী গ্রামে। বাবার নাম কাজী আবদুল্লাহ।
দালালকে ২৮ লাখ টাকা দিয়ে মেক্সিকো হয়ে দুর্গম পথে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে রায়ো গ্র্যান্দি নদী পাড়ি দিতে ডুবে মরেন আজিজ। গত ১১ অক্টোবর ডুবে যাওয়া আজিজের লাশ উদ্ধার করা হয় ১৬ অক্টোবর। এরপর শনাক্ত করা সম্ভব হলো ৪ ডিসেম্বর। লাশটি এখনো টেক্সাসের ওয়েবকাউন্টি মেডিকেল
এক্সামিনারের হিমঘরে রাখা হয়েছে। একই দলে থাকা কয়েক তরুণ নদী সাঁতরে টেক্সাসে এসে অভিবাসন পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর আজিজ ডুবে যাওয়ার তথ্য জানানো হয়। এ নিয়ে নিউইয়র্কে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘দেশীজ রাইজিং আপ অ্যান্ড মুভিং’ তথা ‘ড্রাম’র সংগঠক কাজী ফৌজিয়া যোগাযোগ রাখছিলেন অভিবাসন দফতর এবং মেডিকেল এক্সামিনার অফিসে। ৪ ডিসেম্বর লাশ শনাক্ত হওয়ার পর কাজী ফৌজিয়ার অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর নোয়াখালী সোসাইটির সেক্রেটারি জাহি মিন্টু দায়িত্ব নিয়েছেন লাশ নিউইয়র্কে এনে জানাজার পর বাংলাদেশে মা-বাবার কাছে পাঠিয়ে দিতে। কয়েক মাস আগে হৃদয়, নাঈম এবং আরমান নামক আরও তিন বাংলাদেশির লাশ শনাক্তের পর নিউইয়র্কে এনে জানাজা শেষে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। তারাও ছিলেন নোয়াখালীর সন্তান। এসব তথ্য সংগ্রহকালে ৪ ডিসেম্বর আরও জানা গেছে, টেক্সাস, ফ্লোরিডা, আলাবামা, মিমিসিপি, মিশিগান, আরিজোনা, পেনসিলভেনিয়া, নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, ক্যালিফোর্নিয়াসহ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের ডিটেনশন সেন্টারে দুই হাজারের অধিক বাংলাদেশি মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তারা সবাই নিজ নিজ এলাকায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে প্রাণ বাঁচাতে দালাল ধরে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন বলে অভিবাসন দফতরে আবেন করেছেন অর্থাৎ স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এসাইলাম চেয়েছেন। এ ব্যাপারে ইউএস সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী ৪ ডিসেম্বর এ সংবাদদাতাকে জানান, প্রাণ বাঁচাতে লোকজন মোটা অঙ্ক দালালকে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসছে। এটি শুভ কোনো লক্ষণ নয়। কারণ, অনেকেই সাপের কামড়ে অথবা হিংস্র জানোয়ারের কবলে পড়ছেন। যারা সাঁতার জানেন না তারা নীতে ডুবে মরছেন। অর্থাৎ নিরাপদ আশ্রয়ের প্রত্যাশা অনেকেরই অধরা থেকে যাচ্ছে। যারা ভাগ্যবান তারা এসাইলাম পাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসার ক্ষেত্রে মেক্সিকোর একটি চক্র জড়িত। এ চক্রের অন্যতম সদস্য হিসেবে মোকতার হোসেন (৩০) নামক এক বাংলাদেশিকে ২৯ নভেম্বর গ্রেফতার করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর পুলিশ যৌথ এক অভিযানে। ৩০ নভেম্বর তাকে হিউস্টনে এনে কোর্টে সোপর্দ করা হয়। এই যুবক মেক্সিকোর মনটেরি সিটিতে হোটেল পরিচালনা করেন। সেই হোটেলটিই মূলত বিভিন্ন দেশ ঘুরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের আগে বিশ্রামকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত বাংলাদেশিদের কাছে। দালাল চক্রের সস্য হিসেবে মোকতার হোসেন এসব যুবক-যুবতীকে ট্রাক অথবা ভ্যানে ভরে মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে পাঠিয়ে দেয়। ইউএস বিচার বিভাগের ক্রিমিনাল ডিভিশনের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ব্রায়ান এ বেঞ্চজয়োস্কি, টেক্সাস সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্টের ইউএস অ্যাটর্নি রায়ান কে প্যাট্রিক এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি তদন্ত সংস্থার স্পেশাল এজেন্ট শ্যান এম ফল্ডেন সম্মিলিত এক সংবাদ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী নেটওয়ার্কের সদস্য হিসেবে মোকতার হোসেনের গ্রেফতারের ঘটনাবলি উপস্থাপন করেন।
উল্লেখ্য, স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় পাড়ি জমানোর পর দীর্ঘদিন ধরে যারা অভিবাসনের ডিটেনশন সেন্টারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন, মুক্তির কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না, তাদেরই কেউ কেউ ক্ষুব্ধচিত্তে মোকতার হোসেনসহ পাচারকারী চক্রের অনেকের তথ্য কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন। এ চক্রের সদস্যরা নিউইয়র্ক, টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া, আরিজোনা, মেক্সিকো, ব্রাজিল, পানামা এবং কুয়েত-কাতারে রয়েছে বলেও জানা গেছে। লনেতা হচ্ছে পাকিস্তানি। তবে বাংলাদেশিদের দেখ-ভাল এবং দুর্গম পথে চলতে সহায়তাকারীর অধিকাংশই উপরোক্ত স্থানে বসবাসরত বাংলাদেশি বলেও জানা গেছে।
মোকতার হোসেনের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের অভিযোগ, ২০১৭ সালের মার্চ থেকে এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১৪ বাংলাদেশিকে টেক্সাস সীমান্তে পৌঁছে দেন নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে। মন্টেরিতে নিজের হোটেলে থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করেন সবার জন্য। এরপর পরিচিত ড্রাইভারকে ভাড়া নিয়ে ওদের পাঠিয়ে দেন সীমান্তে। এ পর্যন্তই তার দায়িত্ব। মোকতারকে সাউার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব টেক্সাস ফেডারেল কোর্টে জাজ ডিনা হ্যানভিচ পলারমোর এজলাশে সোপর্দ করা হয়েছিল। তাকে আটকাদেশ দিয়ে জেলে রাখা হয়েছে। এখানে বিচার শেষ হলেই মেক্সিকো পুলিশে হস্তান্তর করা হবে সে দেশে বিচারের সম্মুখীন করতে। কারণ, তার বিরুদ্ধে মেক্সিকোর নিউভো আদালতে আদম পাচারের মামলা রয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকা, আফগানিস্তানসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ৭ শতাধিক নারীসহ সহস্রাধিক মানুষকে যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের অভিযোগ রয়েছে। নিউভো লিয়নের ফোয়েরজা সিভিল এবং মেক্সিকোর ন্যাশনাল ইন্সটিটিউটের সদস্যরা মোকতারের হোটেলে অভিযান চালিয়ে অনেক তথ্য উদ্ধার করেছে। এই হোটেলকে অপরাধ জগতের স্বর্গরাজ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে মেক্সিকো পুলিশ। এ অভিযানে বিস্তারিত সহায়তা দেয় ইউএস হোমল্যান্ড সিকিউরিটির এজেন্টরা। মেক্সিকো কর্তৃপক্ষ এ সংবাদদাতাকে নিশ্চিত করেছে যে, মোকতার হোসেন বেআইনিভাবে বাস করছিলেন মন্টেরিতে। মেক্সিকোর পাবলিক সিকিউরিটি সেক্রেটারি আল্ডো ফাসি আরও জানান, মোকতারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি দেশেই আদম পাচারের মামলা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিচার শেষ হলে মেক্সিকোতে আনা হবে। এরপর তাকে অন্য দেশের বিচারালয়ে সোপর্দ করা হবে। কমপক্ষে এক হাজার নারী-পুরুষ পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে বিভিন্ন দেশে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়েছে। এই মন্ত্রী আরও উলেখ করেন যে, কমপক্ষে ৭০০ নারী এনেছেন বাংলাদেশ থেকে। এর বড় একটি অংশ কাতার, কুয়েত, ব্রাজিল, মেক্সিকোতে অবস্থান করছে। কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকে পড়েছেন।
এদিকে, গত ৪ বছরের পরিসংখ্যান প্রকাশকালে একটি গণমাধ্যম বলেছে, মেক্সিকোর গভীর জঙ্গল ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সীমানায় আসার পথে অনেকেই নিখোঁজ হয়ে যান। অনেকে খাবারের অভাবে হাঁটতে পারেন না। সে সময় দল থেকে ছিটকে পড়েন। আর যারা কোনোমতে সীমান্ত এলাকায় আসার পর রক্ষীদের বৃষ্টি এড়িয়ে নদী সাঁতরে টেক্সাসে প্রবেশের চেষ্টা করেন, তাদের কেউ কেউ পানির স্রোতে হারিয়ে যান। আত্মীয়-স্বজন এবং সহযাত্রীদের বিবরণ থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী গত চার বছরে যতজন নিখোঁজ/নিহত হয়েছেন, সে সংখ্যা চার হাজারের বেশি। তবে এর আগের চার বছরে মারা যাওয়া অথবা নিখোঁজ হওয়াদের তুলনায় তা ১৫৭৩ জন বেশি। অর্থাৎ দিন যত যাচ্ছে নিহত/নিখোঁজের সংখ্যাও বেড়ে চলছে। গত চার বছরে নিজ দেশ ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয় অথবা সুন্দর ভবিষ্যতের সন্ধানে ভিন্ন দেশে গমনের সময় সারা বিশ্বে মোট ৫৬ হাজার মানুষ নিহত/নিখোঁজ হয়েছেন। এই চার হাজার সেই দলেরই। জাতিসংঘের ‘ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফরম মাইগ্রেশন’ তথা আইওম থেকে আরও উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া গেছে অভিবাসীরে চরম দুর্দশার। এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে প্রায় ২৮৫০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বেআইনি পথে দেশত্যাগের সময়। মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে গত ১০ মাসে মোট ৩৬৪ জনের প্রাণহানী ঘটেছে। এর মধ্যে ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ানের সংখ্যা ৯৭। সেন্ট্রাল আমেরিকানের সংখ্যা ৭৭। ১৮৪ জনের জাতীয়তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে, বাংলাদেশিদের কাছে থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দালালরা টাকা নেয়ার পর ঢাকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যে নেয়া হয়। সেখান থেকে ব্রাজিল। ব্রাজিলে দালালের ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। সেখানে অবস্থানের পর গুয়েতেমালা হয়ে পানামা দিয়ে মেক্সিকোতে নেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তের কাছে দালালরে মাধ্যমেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এখান থেকে সুযোগ বুঝে ঢুকিয়ে দেয়া হয় টেক্সাসের পথে। যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকিয়ে দেয়া পর্যন্তই দালালদের দায়িত্ব। এরপর কেউ মারা গেলে কিংবা লাপাত্তা হলে, সে দায়িত্ব দালালের নয়। অর্থাৎ সৌভাগ্যক্রমে যারা টেহ্নাসে ঢোকার পর অভিবাসন পুলিশের হাতে ধরা পড়েন, তারে অ্যাটর্নি নিয়োগসহ যাবতীয় খরচ বহন করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রবাসে তাদের আত্মীয়-স্বজন অথবা এলাকার লোকজন এগিয়ে যান। সম্প্রতি সেন্ট্রাল আমেরিকার দেশগুলো থেকে হাজার হাজার মানুষের মিছিল মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে এসেছে। তারা ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে না। এসব মানুষের মিছিলে বাংলাদেশিরাও রয়েছে বলে মেক্সিকো থেকে প্রাপ্ত তথ্যে প্রকাশ। অনুসন্ধানকালে আরও জানা গেছে, ২০ থেকে ৩০ বছর বয়েসী যুবকরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্গম পথে পা বাড়াচ্ছেন। এসাইলাম প্রার্থীর সবাই নিজেকে বিএনপি অথবা এলডিপি অথবা ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচিত করেছেন। দেশে ফিরিয়ে দেয়া হলে তারা নির্ঘাত মৃত্যুর মুখে পড়বেন বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার তারা, এমন দাবি করেছেন প্রায় সবাই।