অস্বাভাবিক আমদানিতে বাড়ছে ডলারের চাহিদা, যা রহস্যজনকও বটে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বাস্তবে এর অনেক কিছুই আদৌ আমদানি হচ্ছে না। আমদানির আড়ালে টাকা পাচার হচ্ছে। তবে এর খেসারত দিতে হচ্ছে সবাইকে।
হু-হু করে দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম। এ সুযোগে কিছু অসাধু ব্যাংকও অতি মুনাফার লোভে বাড়িয়ে দিয়েছে বৈদেশিক এই মুদ্রার মূল্য। এ কারণেই আমদানিতে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। এতে আমদানিকারক এবং ভোক্তা উভয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে যে হারে আমদানি বাড়ছে সে হারে রফতানি ও রেমিটেন্স না বাড়ায় বড় ধরনের অর্থ পাচারের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি সংক্রান্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মোট ৫৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে। এই নয় মাসে এলসি নিষ্পত্তি (সেটেলমেন্ট) হয়েছে ৩৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের।
গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৩৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। আর নিষ্পত্তি হয়েছিল ৩৩ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-মার্চ সময়ে খাদ্যপণ্য (চাল ও গম) আমদানির এলসি বেড়েছে ২১৮ শতাংশ। জ্বালানি তেল আমদানিতে ৩৭ শতাংশ, মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানিতে ৩৩ শতাংশ এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি বেড়েছে ১৪ শতাংশ।
অপরদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) রফতানি আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আর দশ মাসে অর্থাৎ জুলাই-এপ্রিল সময়ে রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছে ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশ। তবে রফতানি এবং রেমিটেন্স কিছুটা বাড়লেও তা আমদানির তুলনায় অনেক কম।
এমন পরিস্থিতির বিশ্লেষণ জানতে চাইলে অর্থনীতির গবেষক ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, ‘টেনশন আছে (দুশ্চিন্তা)। কারণ রফতানি বাড়ছে না। অর্থ সরানোর বিষয়টিও উড়িয়ে দেয়া যায় না। নানা কারণে আমদানির চাপ আছে, তবে নির্বাচনী বছরে ম্যানেজ করার চেষ্টা করবে সরকার।’
এদিকে ক্রমাগতভাবে আমদানি ব্যয় বাড়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা এবং দর বাড়তির দিকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে ৮৩ টাকা ৭০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করছে, যা এক বছর আগের তুলনায় ৩ টাকা ১৬ পয়সা বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, সর্বশেষ গত এক মাসে ডলারের দাম ৭২ পয়সা বেড়েছে।
তবে বাজারের বাস্তবতা খানিকটা ভিন্ন। বেশ কিছু ব্যাংক ডলার সংকটের কারণে পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। কিছু ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের হারের চেয়ে বাড়তি মূল্য আদায় করছে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। আর সাধারণ মানুষকে ডলার কিনতে হচ্ছে ৮৬ টাকা দরে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১০ মাসে ১৯৪ কোটি ৩০ লাখ (১.৯৪ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও ডলার ছাড়তে হবে। ব্যবসা পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছি। তা না হলে ডলারের সংকট প্রকট হবে।’
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ডলার বিক্রি করে বা কেনে তাকে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার বলে। ব্যাংকগুলো এর চেয়ে কিছু বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করে। সর্বশেষ সোমবার আমদানি পর্যায়ে ৮৩ টাকা ৭০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে ব্যাংকগুলো। খুচরা পর্যায়ে ডলারের সর্বোচ্চ দর ছিল ৮৬ টাকা পর্যন্ত। অথচ কিছুদিন আগেও ডলারের দাম ছিল ৭৮ থেকে ৮০ টাকা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেডা) চেয়ারম্যান এবং সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, প্রায় ১০টি ব্যাংক ডলারের দামে বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমা লঙ্ঘন করছে। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে।
ওদিকে আমদানি লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকায় চাপের মুখে পড়েছে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। বাজার স্বাভাবিক রাখতে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল এবার ১৪০ কোটি ডলারে উঠেছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গত জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারি মেয়াদে আকুর বিল ১৫৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারে উঠেছিল।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে তিন হাজার ৩১২ কোটি (৩৩.১২ বিলিয়ন) ডলার ছিল। দ্বিতীয় সপ্তাহে আকুর মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ১৪০ কোটি ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর তা ৩২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ- এই ৯টি দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য।
এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। গত বছরের জুলাই-আগস্ট মেয়াদে ১১৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার আকুর বিল পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদে শোধ করা হয় ১১৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদে আকুর বিল ছিল ১৩৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
No comments:
Post a Comment