কক্সবাজার-৪ (টেকনাফ-উখিয়া) আসনের আলোচিত সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির সত্ভাই মৌলভি মুজিবুর রহমান টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর। বদির ডান হাত বলে পরিচিত তিনি। এলাকায় প্রচলিত আছে, ‘টেকনাফে মৌলভির ইশারা ছাড়া’ গাছের পাতাও পড়ে না। টেকনাফ শহর থেকে নাফ নদ এবং নীলা, সাবরাং ও শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ৩০টি ‘ইয়াবা ঘাট’ চলে মৌলভি মুজিবুরেরই নামে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) ও গোয়েন্দা সংস্থা ইয়াবা কারবারিদের যে তালিকা করেছে তার শীর্ষে আছে মুজিবুরের নাম। চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে অনেক কারবারি ধরা পড়লেও মৌলভি মুজিবুর আছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
গোয়েন্দা তথ্য ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মুজিবুরের মতোই এমপি বদির আরো চার ভাইয়ের নাম আছে মাদক কারবারিদের তালিকায়, তাঁরাও বহাল তবিয়তে। তাঁদের মধ্যে ফয়সাল ও আবদুল আমিন ঢাকায় থেকে ইয়াবার কারবার করছেন। তালিকাভুক্ত আরো অন্তত ২০ কারবারিকে শনাক্ত করা গেছে, যাঁরা এমপি বদির আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠ। তাঁদের মধ্যে পিএস মং মং সেন ও ভাগ্নে সাহেদুর রহমান নিপু সবচেয়ে প্রভাবশালী। টেকনাফ থেকে কক্সবাজার হয়ে সারা দেশে ইয়াবা কারবারের সঙ্গে ঘুরেফিরে তাঁদেরই নাম আসে। এ কারণে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এমপি বদিকে ইয়াবার গডফাদার বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র মতে, মুজিবুর এলাকায় বদির জনসংযোগের কাজ করেন। মাদক ও হুন্ডি কারবার থেকে সংগ্রহ করা টাকা গরিব মানুষের মধ্যে বিতরণ করেন। এলাকায় বদির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ এটি। একই কারণে বদিও তাঁর সত্ভাইসহ সিন্ডিকেটকে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন।
আবদুর রহমান বদি ইয়াবা কারবারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন। তিনি বলেন, প্রতিপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সংসদ সদস্য বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তথ্য-প্রমাণ নেই। প্রমাণ পাওয়া গেলে যত প্রভাবশালী হোক কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
ডিএনসি গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১৪১ মাদক কারবারির একটি তালিকাসহ প্রতিবেদন দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। ওই প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় বলা হয়, ‘মাননীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি দেশের ইয়াবা জগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী। তাঁর ইশারার বাইরে কিছুই হয় না। দেশে ইয়াবা আগ্রাসন বন্ধের জন্য তাঁর ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট।’ প্রতিবেদনের ভূমিকা অংশে বলা হয়, ‘সরকারদলীয় এমপি হওয়ার সুবাদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুসারী/সহযোগী নিয়ে তিনি ইচ্ছামাফিক ইয়াবা ব্যবসাসহ অন্যান্য উৎস থেকে অবৈধ আয়ে জড়িত আছেন। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জেলার অন্য শীর্ষ মাদক কারবারি বা টেকনাফের যেকোনো চাঁদাবাজ এলাকায় প্রভাব বিস্তারে সক্ষম নয়। বিশেষত মিয়ানমার থেকে চোরাচালান হওয়া ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ করার জন্য তাঁর ইচ্ছাশক্তি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।’
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, বদির সত্ভাই মৌলভি মুজিবুর রহমান, আবদুস শুক্কুর, সফিক, আবদুল আমিন ও ফয়সালের নাম শীর্ষ মাদক কারবারি হিসেবেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মিয়ানমার হয়ে ‘ভিআইপি প্রটেকশনে’ ইয়াবার বড় বড় চালান টেকনাফে নিয়ে আসার কাজটি করেন বদির ভাইরা। ১৮ ভাই-বোনের মধ্যে বদির আপন বোন দুজন। তালিকাভুক্ত ব্যক্তিরা বদির সত্ভাই। মৌলভি মুজিবুর রহমান থাকেন জেলেপাড়ায়। তিনি টেকনাফ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।
কক্সবাজারে কর্মরত এক পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টেকনাফে মৌলভি মুজিবুর স্থানীয় এমপি হিসেবে পরিচিত। এমপি বদির অনুপস্থিতিতে তিনিই সব দেখেন। তাঁর ইচ্ছার বাইরে থানায় একটা জিডিও হয় না। তাঁদের বেল্টের লোকজন তো ধরাই যায় না।’ ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘এমপির ভাইবেরাদারদের প্রমাণসহ কে ধরবে? তাদের লোকজনই সব করছে। সুতা ধরে টান দিলে সবই বের হবে।’
স্থানীয় সূত্র মতে, টেকনাফ পৌরসভা, নাফ নদের কাছে নীলা ও সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের ৩০টি ঘাটের নিয়ন্ত্রক মৌলভি মুজিবুর রহমান। ইয়াবা কারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা নেন তিনি। নিজস্ব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ইয়াবা খালাস করার ব্যবস্থাও করেন। একটি সূত্রের দাবি, গরিবদের দান করায় বদি এলাকায় জনপ্রিয়। এ কাজটি হয় মৌলভি মুজিবুরের মাধ্যমেই। তিনি মিয়ানমারের ইয়াবা ও হুন্ডি কারবারিদের কাছ থেকে বার্মিজ চালের বস্তা নেন। সেই চাল বদি তাঁর নির্বাচনী এলাকার ১১টি ইউনিয়নের জনগণের মধ্যে বিতরণ করেন। এ কারণে বদি তাঁর ভাই মুজিবুরকে সব ধরনের সহায়তা দেন।
অভিযোগের বিষয়ে মৌলভি মুজিবুর রহমানের বক্তব্য জানতে গতকাল রবিবার রাত ৮টার দিকে তাঁর মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, মাদক কারবারির তালিকায় ২ ও ৩ নম্বরে আছে টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ ওরফে জাফর চেয়ারম্যান ও তাঁর ছেলে মোস্তাকের নাম। জাফর চেয়ারম্যান বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও পাঁচ-ছয় বছর আগে স্থানীয় বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। জাফরও এমপি বদির ঘনিষ্ঠ বলে সূত্রের দাবি।
তালিকার ৪ নম্বরে আছে এমপি বদির পিএস মং মং সেনের নাম। টেকনাফ পৌরসভার চৌধুরীপাড়ার অং সেনের ছেলে মং মং বদির আত্মীয়। তিনি ঢাকায় একাধিকবার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হন। একটি মাদক মামলায় জামিনে মুক্তি পেয়ে তিনি কক্সবাজারে ফিরেছেন। গোয়েন্দা ও স্থানীয় সূত্র মতে, ইয়াবার চালান দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাইকারি ‘ডিলারদের’ কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে মং মংয়ের সিন্ডিকেট।
তালিকার ২০ ও ২১ নম্বরে আছে দুই ভাই আকতার কামাল ও শহীদ কামালের নাম। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এঁরা বদির বোনজামাই পুলিশের সাবেক ওসি আবদুর রহমানের খালতো ভাই। স্থানীয়ভাবে এঁরা বদির বেয়াই হিসেবে পরিচিত। গত শনিবার আকতার কামালের লাশ পাওয়া গেলেও তাঁর মৃত্যুর দায় কেউ স্বীকার করেনি।
এমপি বদির বোন শামছুন্নাহারের ছেলে সাহেদুর রহমান নিপু তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারি। তিনি এলাকার বড় সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন বলে জানায় গোয়েন্দা সূত্র। এমপি বদির মামা হায়দার আলী ও মামাতো ভাই কামরুল ইসলাম রাসেলের নাম আছে তালিকায়। তালিকাভুক্ত কারবারি সৈয়দ হোসেন সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেনের ভাই। তিনি এমপি বদি ও মৌলভি মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ। তালিকার ১৬ নম্বরে থাকা মীর কাশেম ওরফে কাশেম মেম্বার ইয়াবার চালান সরাসরি জাহাজে করে পাচার করেন। তিনি বদি পরিবারের ঘনিষ্ঠ। তালিকার ৩২ নম্বরে আছে মৌলভি আজিজের নাম। বাহারছড়া পুরানপাড়ার মৌলভি নাছির উদ্দিনের ছেলে আজিজ বদির ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ। টেকনাফ সদর ইউপি চেয়ারম্যান শাহজাহান, সাবরাং ইউপির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার এনামুল হক, সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান নূর হোসেন, ফুলের ডেইলের বুলু, লেঙ্গুর বিলের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার শামসুল আলম, নয়াপাড়ার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মোহাম্মদুর রহমান, সাবরাং ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মোয়াজ্জেম হোসেন দানু, বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান আজিজ উদ্দিন, হ্নীলা ইউপির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার জামাল হোসেন, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নুরুল হুদা, হ্নীলা লেদার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদ আলী এবং হোয়াইক্যং ইউপির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার রাকিব আহমেদের নাম আছে তালিকায়। এঁরা সবাই বদি ও তাঁর ভাইদের ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টেকনাফে বদির ঘনিষ্ঠ ছয়জন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছিল।
No comments:
Post a Comment