এপ্রিল মাস। এখানকার বর্ষা শেষ হতে চলেছে। তবুও এই বনে, তাম্বোপাতার বর্ষার বনে, বৃষ্টিটাই স্বাভাবিক। ঘন বনে ঢাকা আছে হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটার, তার মধ্যে বহমান বিশাল সব নদী, পেরুর পূর্বে, আন্দিজ পর্বতমালার পূর্ব দিকের ঢালু থেকে বৃষ্টি ও তুষারের জল চলেছে আতলান্তিকের দিকে। আমরা যে নদীর পাড়ে আছি তার নাম মাদ্রে দে দিওস, ঈশ্বরের মাতা। তার স্রোতধারা চলেছে পূর্ব দিকে বলিভিয়ায়, তারপর নানা নদী ধরে সেই ধারা মিশেছে ব্রাজিলে আমাজন নদীর সাথে।
রাতে বৃষ্টিটা কমে আসল, কিছুক্ষণের জন্য আকাশ থেকে মেঘ সরে যায়। আমরা নৌকায় বসে কাইমান (ছোট কুমীর) দেখতে বার হই। আমাদের গাইড ইসো নৌকার গলুই থেকে একটা টর্চ জ্বালিয়ে জলের ওপর আলো ফেলে। আমি ছাউনির নিচ থেকে দক্ষিণ গোলার্ধের আকাশের দিকে তাকাই। উত্তর আকাশে সপ্তর্ষি মণ্ডল দিগন্ত ঘেঁষে শুয়ে আছে। তার প্রথম দুটো তারা ধ্রুবতারার দিক নির্দেশ করে, কিন্তু দক্ষিণের এই আকাশ থেকে ধ্রুবতারা দেখা যায় না। এখানে সব নক্ষত্রমণ্ডলীই যেন উল্টো, কালপুরুষ, বৃহৎ সারমেয় - উত্তর আকাশের এই সব পরিচিত তারাগোষ্ঠীকে যেন মাথাটা পেছন দিকে হেলিয়ে দেখছি। খুঁজলাম আলফা সেন্টাউরি, সূর্যের পরে আমাদের সবচেয়ে কাছের তারা। বাংলাদেশের দক্ষিণ থেকে সেটাকে আকাশের একেবারে দক্ষিণে জুন মাসে দেখা যেতে পারে, তার নাম হল জয়। লুব্ধক ও অগস্ত্যের পরে সেই হল আকাশের তৃতীয় উজ্জ্বল তারা। আলফার ওপরে বেটা সেন্টাউরি – আলফা ও বেটা – জয় ও বিজয়। তাদের কাছাকাছি হচ্ছে দক্ষিণের ক্রস যা কিনা দক্ষিণ আকাশের মেরুর দিক নির্দেশ করে। বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণের ক্রুসকে দেখা যায় না। পৃথিবীর পাঁচটি দেশের জাতীয় পতাকায় এই ক্রস স্থান পেয়েছে – ব্রাজিল, অস্ট্রালিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাপুয়া-নিউ গিনি ও সামোয়ার পতাকায়। ক্রুসের পাঁচটি তারা শুয়ে আছে উজ্জ্বল ছায়াপথের ওপর। কাইমান হচ্ছে ছোট কুমীর। ইসোর আলোয় হঠাৎ জলের ওপর একটার মাথা দেখা যায়। মূহূর্তেই সেটা অদৃশ্য হয়ে যায়। পাড়ে দু-একটা কাইমান দেখা যায়, তাদের চোখ অন্ধকারে টর্চের আলোয় জ্বলজ্বল করে। পরদিন আমরা একটা কাদার রাস্তায় হেঁটে যাই জঙ্গলের গভীরে এক হ্রদে। এখানে এত বড় জলাশায় কেমন করে সৃষ্টি হল? ইসো বলল কোন এক সময়ে এই হ্রদ মাদ্রে দি দিওস নদীর অংশ ছিল। নদী যদি কখনো তার বাঁক এড়িয়ে সোজাসুজি চলে তবে তার বাঁকে এই ধরণের হ্রদ সৃষ্টি হয়। একে বলা হয় অক্সবো বা ধনুক আকারের হ্রদ, বাংলাদেশে যাকে আমরা বাওড় বলি। পরে বিমানে উড়ে যাবার সময় ওপর থেকে দেখলাম এই রকম অনেক ধনুক আকারের হ্রদ বা বাওড় সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা নৌকো করে যে হ্রদে ঢুকলাম তার পাড়ে অনেক পাম গাছ সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পেছনে কেপক বা সেইবা গাছ, রেইন ট্রি, আর নাম-না জানা অনেক উঁচু গাছ যারা রেইন-ফরেস্টের ক্যানোপি বা আচ্ছাদন তৈরি করে। তার মধ্যে মাঝে মধ্যে কিছু হাউলার, স্পাইডার, কাপুচিন ও স্কুইরেল বানর দেখা যায়। দু-একটা মাকাউ পাখি ওপর দিয়ে উড়ে যায়। একটা গাছের ওপর অনেক ক’টা চামচিকা সারি বেঁধে রোদ পোহায়। পাশের গাছের ডালে রঙ্গীন ডানা মেলে কিছু পাখী বসে থাকে। সমস্ত জায়গা জুড়ে বিরাজ করে এক শুনশান নিরবতা। সেই রাতে ক্যাম্পের অন্ধকারে ঝিঁ ঝিঁ পোকার প্রচণ্ড আওয়াজের মধ্যে আকাশে বৃথাই খুঁজলাম বৃহৎ ম্যাজিল্লানিক মেঘ, ইংরেজীতে Large Magellanic Cloud। এটি আমাদের গ্যালাক্সি ছায়াপথের এক উপগ্যালাক্সি, খুব ছোট - বামনাকার। দক্ষিণ আকাশে আবছা হয়ে সে ছড়িয়ে আছে একটা বড় জায়গা জুড়ে। এর আগে, অস্ট্রালিয়ার আকাশ থেকে এই গ্যালাক্সিকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। যদিও অনেক প্রাচীন পর্যবেক্ষকই এই নাক্ষত্রিক মেঘের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত ছিল, পর্তুগীজ নাবিক ফার্দিনান্দ ম্যাজিল্লান (পর্তুগীজ ভাষায় তার নাম হল মাগালানেস) দক্ষিণ গোলার্ধে তার নৌ অভিযানের সময় এই আকাশে এই মেঘের স্থানকে লিপিবদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত তার নামেই এই গ্যালাক্সির নামাকরণ স্থায়ী হয়। কিছুক্ষণ পরেই মেঘে ঢেকে গেলে আকাশ। আবার নামল তুমুল বৃষ্টি। আমি ভাবলাম পৃথিবীর আবহাওয়া ঠিক করতে আমাজনের এই অরণ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লক্ষ লক্ষ বর্গকিলোমিটার জুড়ে এই অঞ্চলের যে গাছ তারা শুষে নেয় মানুষের সৃষ্ট কার্বন-ডাই-অক্সাইড। পৃথিবীর জলবায়ুর গঠন কেমন হবে আমাজনের এই জঙ্গল তা নির্ধারণ করে দেয়। তবে মানুষের নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়নের তাগিদে এই জঙ্গল ধীরে ধীরে ছোট হচ্ছে। তারপর ভাবলাম ইতিহাসের চাকার অবিশ্রান্ত ঘূর্ণনে কেমন করে আমেরিকার মানব সমাজের পরিবর্তন ঘটেছে। সেই সূত্রেই বৃহৎ ম্যাজিল্লানের মেঘ ধরে ভাবলাম সেই ভাগ্যান্বেষী পর্তুগীজ নাবিকের কথা। স্প্যানের রাজা চার্লসের পৃষ্ঠপোষকতায় ম্যাজিল্লান আতলান্তিকের পশ্চিম দিকে রওনা হয়েছিল পূর্বের মশলা দ্বীপের সন্ধানে। এর আগে পর্তুগালের হয়ে সে ভারতের পশ্চিম উপকূলে যুদ্ধ করে এসেছে, তাই পূর্ব সম্পর্কে তার ধারণা ভালই ছিল। আমেরিকার ইতিহাস তখন আমূল পরিবর্তনের মুখে। কলম্বাস ১৪৯২ সনে ইউরোপের জন্য উত্তর আমেরিকার পথ খুলে দিল। তারপর থেকে স্পেনের কনকিস্তাদররা তাদের ভাগ্য অন্বেষণে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার পথে পাড়ি দিল। সাহস, ধূর্ততা, প্রত্যুতপণ্মমতিত্ত্ব, ধার্মিকতা, নিষ্ঠুরতা সব মিলিয়ে কনকিস্তাদররা ছিল এক নতুন যুগের নায়ক, একটা পুরো মহাদেশকে দখল করে নিতে তারা পিছপা হয় নি। সেই ধূর্ততার পথ ধরে বন্দী পণের সোনা পাওয়া সত্ত্বেও কনকিস্তাদর ফ্রান্সিস্কো পিসারো ১৫৩৩ সনে ইঙ্কা রাজা আথাহুয়াল্পাকে হত্যা করে। ইঙ্কা সাম্রাজ্যের পতনের শুরু তখন থেকেই। আমি ভাবি ইঙ্কাদের শেষ রাজা তুপাক আমারু কুসকো থেকে পালিয়ে আমাজনের এই জঙ্গলে পালিয়ে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুপাক জঙ্গলকে বিশ্বাস করে নি, স্প্যানিশ কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। কিন্তু তুপাক আমারুর জন্য তার ফলাফল ভাল হয় নি। কুসকোতে নিয়ে গিয়ে তাকে অত্যাচার করে ১৫৭২ খ্রীস্টাব্দে মেরে ফেলা হয়। ১৯৮০র দশকে পেরুতে যখন উজ্জ্বল পথ (সাইনিং পাথ) নামে এক মাওবাদী জঙ্গী গোষ্ঠী তৎপর, তখন তুপাক আমারুর নামে আর একটি জঙ্গী গোষ্ঠীও সৃষ্টি হয়। ১৯৮৮ সনে তারা লিমার জাপানী দূতাবাস দখল করে ৮০ জন লোককে প্রায় ছয়মাস জিম্মি করে রাখে, কিন্তু তার ফলাফলও সেই গোষ্ঠীর জন্য ভাল হয় নি। কিন্তু সকালে আমাদের গাইড ইসোকে যখন আমি তুপাক আমারুর কথা জিজ্ঞেস করলাম সে বলল, পেরুর অনেক লোক তুপাককে হিরো মনে করে, কিন্তু সে ছিল এক ইঙ্কা রাজা, তার অনেক দাস ছিল, দেশের লোকের কি ভাবে উন্নতি হবে তা নিয়ে সে চিন্তিত ছিল না। ইসোর পিতামহী ছিল কেচুয়া-ভাষী (আদি ইঙ্কাদের ভাষা), কেচুয়া উত্তরাধকারী হয়েও ইসো ইতিহাসের ধারা নিয়ে ছিল দ্বিধান্বিত। আমেরিকায় ইউরোপীয়দের আবির্ভাব ইতিহাসের ধারাকে বদলে দিয়েছে। ১৯৮০র দশকে পেরু যখন অস্ত্রধারী মাওবাদী আন্দোলনের সম্মুখীণ হয় তখন সেই সহিংস প্রক্রিয়ায় সরকার ও মাওবাদী উভয় পক্ষই যথেষ্ট নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নেয়। আমি ভাবি পেরুর নোবেল বিজয়ী লেখক মারিও ভার্গাস লোসাসের কথা। কিউবার বিপ্লবের সময় সেও ফিদেল কাস্ত্রোর খুব সমর্থক ছিল। পরবর্তীকালে কিউবার একনায়কতন্ত্র ও পেরুতে মাওবাদী অরাজকতা দেখে তার রাজনীতিও ব্যক্তি স্বাধীনতাভিত্তিক ও মধ্য দক্ষিণপন্থী হয়ে গেল। বর্তমানে মনে হয় পরিস্থিতি অনেক স্থিতিশীল। সামাজিক-অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে লাতিন আমেরিকা ৭০ আর ৮০র দশকের মন্দাভাব কাটিয়ে উঠছে। লাতিন আমেরিকার অনেক দেশের মত পেরুতেও একজন মধ্য-বামপন্থী নেতা – ওলান্তা উমালা - রাষ্ট্রপতি হিসেবে এখন নির্বাচিত। এর মধ্যেই পেরুর অনেক নাগরিক তাদের মিশ্রিত অতীতে ইঙ্কাদের রেখে যাওয়া স্থাপত্যে নতুন অনুপ্রেরণা খুঁজতে চাইছে। আমাদের জঙ্গলবাস শেষ হলে ফিরে আসি মাদ্রে দি দিওস নদীর পাশে পুয়ের্তো মালদোনাদো শহরে। বাংলাদেশের মহকুমা শহরের মতই। তবে পরিষ্কার। অটোরিক্সা বা বেবী ট্যাক্সি চলছে। আমাদের মহিলা গাইড নিজেই অটোরিক্সা চালিয়ে আমাদের বাজারে নিয়ে গেলেন। বাজারে মাছ, মাংস বিক্রী হচ্ছে। কিন্তু বিক্রেতারা প্রায় সবাই মহিলা। মাংস যারা কাটছে তারাও মহিলা, তাদের হাতে দস্তানা, গায়ে সাদা এপ্রন। বাজারের বাইরে একটু দূরেই বিষুবীয় অরণ্য। একটু পরেই আমরা বিমানে চড়ে সেই অরণ্যের ওপর দিয়ে উড়ে গেলাম পশ্চিমের পাহাড়ের দিকে, আমাদের গন্তব্য কুসকো শহর, ইঙ্কা সাম্রাজ্যের পীঠস্থান, আর এখন মাচু পিচুর উদ্দেশ্যে যাত্রা এখান থেকেই শুরু হয়। আন্দিজ পর্বতমালায় প্রায় ১১,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কুসকো শহরে দু-একদিন সময় লাগে অক্সিজেন স্বল্পতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে। আজকের কুসকো পর্যটন শিল্পের ওপর প্রায় পুরোপুরি নির্ভরশীল। উত্তর আমেরিকা আর ইউরোপ থেকে আগত পর্যটক দিয়ে কুসকোর রাস্তা ভর্তি। পথের পাশে অনেক কেচুয়া ইন্ডিয়ানরা রকমারী জিনিস বিক্রী করছে। এই শহরের ভিত্তিভূমি ইঙ্কা পাথর দিয়ে তৈরি। পাঁচশো বছর পুরোনো সেই পাথরের দেওয়াল অনেক পথেই দেখা যায়। ছোট পায়ে চলা রাস্তা পাথর দিয়ে বাঁধানো, তার পাশের দেওয়াল বড় বড় পাথর দিয়ে তৈরি। কেমন করে ইঙ্কা কর্মীরা এই রকম কারিগরী দক্ষতা দেখিয়েছে তাই নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। কুসকোর পাশে আরো উঁচু পাহাড়ের ওপর ইঙ্কা রাজা পাচাকুটেক তৈরি করেছিল একটি বাসস্থান, নাম হচ্ছে সাক্সাইউয়ামান। কুসকো হচ্ছে পুমার দেহ আর সাক্সাইউয়ামান হচ্ছে সেই পুমার মাথা। ওপর থেকে পাথর দিয়ে তৈরি পুমার দাঁত দেখা যায়। আর নিচে সুন্দর কুসকো শহর ছড়ানো। কুসকো ছিল ইঙ্কাদের রাজধানী। এত বছর পরে আমরা ইঙ্কা স্তাপত্য বা পাহাড়ের গায়ে পায়ে চলার জন্য পাথরের বাঁধানো রাস্তা দেখে চমৎকৃত হই, কিন্তু সেই ইঙ্কা সাম্রাজ্য একশো বছরের বেশী টেঁকে নি। কিন্তু সেই স্বল্প সময়ের মধ্যে ইঙ্কারা বর্তমানের ইকুয়াডর থেকে মধ্য চিলি পর্যন্ত বিভিন্ন উপজাতি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে তাদের রাজ্য বিস্তার করে। সেই সাম্রাজ্যের নাম ছিল তাওয়ানতিনসুয়া, ইঙ্কা নয়। কারণ কেচুয়া ভাষায় ইঙ্কা শব্দের অর্থ হচ্ছে রাজা। পৃথিবী অবশ্য ইঙ্কা সভ্যতার পীঠস্থান হিসেবে নাম শোনে মাচু পিচুর। তবু মাচু পিচুর কোন ইতিহাসই আমাদের জানা নেই। এমন কি পনেরো কি ষোড়শ শতকের কোন স্প্যানিশ ঐতিহাসিকের বা কনকিস্তাদরের লেখাতেও মাচু পিচুর উল্লেখ পাওয়া যায় না। দুর্ভেদ্য পাহাড়ের ওপর এমন একটা বড় সুন্দর সাজানো শহর ইতিহাস থেকে কেমন করে হারিয়ে গেল? হয়তো স্প্যানিশদের কাছে রাজ্য হারিয়ে তাদের শেষ মর্যাদার স্থানটির অবস্থান কেচুয়াভাষীরা গোপন করে রাখতে চেয়েছিল। কুসকো থেকে বাসে ওলানতা-তাম্বোই, সেখান থেকে ট্রেনে আগুয়াস কালিয়েন্তেস বা গরম জলসমূহ (বহুবচনে)। ওলান্তা-তাম্বোই কথাটা যেন বাজনার মত। সেখান থেকে ট্রেন উরুবাম্বা নদীর গিরিখাত দিয়ে চলে। দুপাশে সুন্দর সবুজ পাহাড়। মাঝে মধ্যেই কয়েক শো বছরের পুরোনো ধ্বংসাবশেষ, তার মধ্যে পাহাড়ের টেরেস করা প্রাচীন পাথরে বাঁধানো চাষের জমি। পৃথিবী মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার কাছে বহু ভাবে ঋণী। আলু, টমেটো, পেপে, লঙ্কা বা মরিচের উৎস হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকা। আমদের খাদ্যে এর প্রভাব এতই যে আমরা অনেকেই মনে করি মরিচ একটি দেশী জিনিস। হয়তো পর্তুগীজ নাবিকেরা আমেরিকা থেকে পনেরো শতকে লঙ্কা নিয়ে এসেছিল ভারতের গোয়াতে, অথবা লঙ্কা এসেছিল স্প্যানিশ কলোনি ফিলিপিন দ্বীপপুঞ্জ মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, সেখানে থেকে ভারত তথা বাংলায়। যেভাবেই সেটা আসুক না এটা ভাবতেই অবাক লাগে যে পনেরো শতকের আগে বাংলাদেশে লঙ্কা বা মরিচের ব্যবহার ছিল না। নিঃসন্দেহে এই নিয়ে অনেক গবেষণার অবকাশ আছে। সুন্দর বড় জানালার ট্রেন স্রোতস্বিনী উরুবাম্বার পাশ দিয়ে চলে। সবুজ পাহাড়ে ওপর পায়ে চলা পথ দেখা যায়। ইঙ্কা ট্রেইল। প্রতি বছর হাজার হাজার লোক এই পথে চারদিন হেঁটে মাচু পিচু পর্যন্ত যায়। ব্যাকপ্যাকিং বা ট্রেকিংয়ের জন্য যা লাগে তার সব কিছুরই ব্যবস্থা আছে। প্রাচীন ইঙ্কারা এই পথেই মাচু পিচু যেত। আজও মাচু পিচু যেতে হলে কোন গাড়ির রাস্তা নেই, হয় ট্রেন ধরতে হবে নয় ইঙ্কা ট্রেইলে হাঁটতে হবে। আমিও ট্রেইল ধরতে চেয়েছিলাম, সময়াভাবে হল না। ট্রেন এসে পৌঁছায় গিরিখাতের মাঝে সুন্দর শহর আগুয়াস কালিয়েন্তেসে। সেখান থেকে বাসে ৫০০ মিটার সর্পিল রাস্তা ধরে ওঠা। ১৯১১ সনে মার্কিন ঐতিহাসিক হাইরাম বিংগহাম এই পাহাড় বেয়ে ঊঠেই মাচু পিচুর ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেয়েছিলেন। এই স্থানের হদিশ অনেক কেচুয়া ভাষীই জানত, কিন্তু বিংগহামই প্রথম বাইরের জগতকে এই রকম একটা অসাধারণ শহরের সংবাদ দিল। প্রথম দর্শনে মাচু পিচুর পাথরের শহর আমার নিঃশ্বাস কেড়ে নেয়। সবুজ পাহাড়ের মাঝে গ্রানাইট পাথরের মেলা। পাহাড়ের তিনদিকে উরুবাম্বা নদীর গভীর গিরখাত। নদীর ঐ পাশে সবুজ ঘাসে ঢাকা পাহাড়, সে পাহাড় ছাড়িয়ে মাঝে মধ্যে আন্দিজ পর্বতমালার তুষার শুভ্র শিখর ঝলকাচ্ছে। মাঝে মধ্যে তারা বর্ষার মেঘে ঢাকা পড়ছে, মাঝে মধ্যে সেই মেঘ আমাদের খুব কাছাকাছি নেমে আসছে নদীর ঐ পাশের পাহাড়গুলো ঢেকে দিয়ে। এত দুর্ভেদ্য একটা অঞ্চলে ইঙ্কা স্থপতি ও প্রকৌশলীরা একটা শহরের নক্সা বানিয়েছে, খাড়া পাহাড়ের পাশকে টেরেস পদ্ধতিতে ভূমিধ্বস থেকে আটকেছে, প্রাকৃতিক ঝর্ণাকে নালার মাধ্যমে শহরের মধ্যে নিয়ে এসেছে, পাহাড়ের ঢালু অংশে কৃষিকাজের জন্য জমির সংস্থান করেছে। দশ টনি পাথর দিয়ে নিঁখুত দেওয়াল তৈরি করেছে। মাচু পিচুর অনেক দেওয়ালের পাথর এমন ভাবে বসানো হয়েছে যে তাদের দুটোর মধ্যে ছুরির ফলাও ঢুকবে না। আমি ভাবি কি পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়েছে তাদের এইরকম ৫ থেকে ১০ টন ওজনের পাথরকে মসৃণ করে একে অপরের ওপর বসাতে। ইঙ্কারা চাকা ব্যবহার করত না, এই রকম আদিম প্রকৌশল দিয়েও কিরকম চমৎকার স্থাপত্য সৃষ্টি সম্ভব! এসব কিছুই হয়েছে লোহা ও চাকার গাড়ির ব্যবহার ব্যতিরেকে। ঘোড়া বা হাতীর মত ভারবাহী পশু ইঙ্কাদের ছিল না। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে তাদের কোন লিখিত ভাষা ছিল না। লেখা ছাড়া কি করে এত বড় সাম্রাজ্য কি করে ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব? তারপর মনে পড়ল ইঙ্কা সাম্রাজ্য মাত্র ১০০ বছরের কিছু বেশী দিন মাত্র টিকে ছিল। কেমন করে একটা পশ্চাদপদ অবস্থা থেকে ইঙ্কা জাতি খুব অল্প সময়ের মধ্যে অন্য জাতিদের বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে ইকুয়াডর থেকে চিলি পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করতে পেরেছিল? অনেকে বলেন আন্দিজ পর্বতমালার জলবায়ু সেই সময় মানুষের জন্য অনুকূল হয়েছিল। যাইহোক সেই রাজ্য টিঁকিয়ে রাখতে ইঙ্কাদের সংবাদ পাঠাতে হত। জানলাম সংবাদ পাঠানোর জন্য তারা হাজার হাজার মাইল পায়ে চলা রাস্তা সৃষ্টি করেছিল। অনেক জায়গায় সেই পথ পাথরে বাঁধানো ছিল। ইঙ্কা রানাররা শত শত মাইল সেই পথে দৌড়ে মৌখিক ভাবে সাম্রাজ্যের সংবাদ আদান প্রদান করত আর হিসেব রাখতে রশির গিট্টু ব্যবহার করত। মধ্য আমেরিকার আজটেক ও মায়া সভ্যতা যেমন আকাশচুম্বী পিরামিড গড়েছে, তেমনই এক ধরণের কঠোরতা সেই সমাজে বিরাজ করেছে। তার মধ্যে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে মানুষকে বলি দেওয়ার মত কঠিন ঘটনা পড়ে। ইঙ্কা সভ্যতায় মায়া বা আজটেকদের মত নিষ্ঠুর প্রথা ছিল না, তবুও ঈশ্বরকে খুশী করতে তারা কিশোর-কিশোরীদের উৎসর্গ করত। এই জন্য তারা উচ্চবংশীয় শিশুদের বাছাই করত, তাদের বিশেষ খাওদাওয়ার ব্যবস্থা করত। কয়েক বছর এই রকম চলার পরে তাদের উঁচু পাহাড়ে পাঠানো হত। শারীরিক প্ররিশ্রম করে তারা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ত, তখন মাদক খাইয়ে অপ্রকৃতিস্থ করে তাদের হয় হত্যা করা হত নয় উঁচু পাহাড়ের ঠাণ্ডা ও বায়ুহীন প্রকৃতিতে মৃত্যুর জন্য রেখে যাওয়া হত। বিংশ শতাব্দীতে এইরকম কিছু কিশোর-কিশোরীর মমি পেরুতে আবিষ্কৃত হয়েছে। উঁচু পাহাড়ের শুষ্ক আবহাওয়ায় গত কয়েকশো বছর ঐ দেহগুলি অবিকৃত ভাবে রয়ে গিয়েছে। সেই সব দেহের ওপর গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা ঐ সময়ের মানুষের খাদ্য, ব্যবহার্য জিনিস ও আচার-প্রথা সম্বন্ধে জানতে পেরেছে। হয়তো সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় ইঙ্কারা বিজিত জাতিদের প্রতি সুবিচার করে নি, তাই হয়তো স্প্যানিশ কনকিস্তাদরদের পক্ষে খুব সহজেই ইঙ্কা সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে। মাচু পিচু ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকার একটি জায়গা। মানুষ নির্মিত প্রখ্যাত জায়গার মধ্যে এটি একটি। স্প্যানিশ কঙ্কিস্তাদররা খুব অল্প সৈন্য নিয়ে ছলে-বলে ইঙ্কা সাম্রাজ্য দখল করেছিল। কিন্তু তারা মাচু পিচুর অস্তিত্ব জানতে পারে নি। সেই জন্য ইঙ্কাদের ব্যবহারকৃত ধর্মীয় প্রতীক তারা ধ্বংস করতে পারে নি। এর মধ্যে একটি প্রতীক হচ্ছে ইন্তি হুয়াতানা পাথর যা কিনা সূর্যের বিষুবায়ন বা ক্রান্তি লগ্নগুলো নির্দেশ করত। সূর্য ছিল ইঙ্কাদের অন্যতম দেবতা, মাচু পিচুর একটি বিশেষ ঘর সূর্যের জন্য নির্মিত। এটিই মাচু পিচুর এক মাত্র গোলাকৃতি ঘর। অনেকেই ভাবে ইঙ্কারা অতিপ্রাকৃত কোন ইঙ্গিত থেকে এই দুর্গম জায়গায় তাদের শহর নির্মাণ করেছিল, এই পাথরের শহরে তাই কোন আধ্যাত্মিক কোন ব্যাপার আছে। আমি দেখি অনেক পর্যটকই ওপরে উঠে একটা জায়গায় বসে মাচু পিচুর সৌন্দর্যে নিজেদের মূহ্যমান করে রাখছে। হয়তো তারা সূর্যের নিচে নিজেদের অস্তিত্বের তাৎপর্য বুঝতে চাইছে। তাই ফিরে যাবার আগে তাদের মত আমিও পাথরে বসে পা ঝুলিয়ে বসে থাকি। আন্দিজ পর্বতমালার উরুবাম্বার খাড়া গিরিখাতের ওপর নিজেকে শঙ্খচিলের মত কল্পনা করি, সেই শঙ্খচিল ওপরের হিম বাতাসে ওড়ে, যে শঙ্খচিল কিনা শত শত বর্ষ পেরিয়ে পাহাড়ের গায়ে ইঙ্কাদের এই শহর গড়ে তোলার চিত্র দেখতে পায়।
Tuesday, April 26, 2016
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment