Social Icons

Wednesday, August 31, 2016

প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অসাধারন এক দেশ

পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের প্রায় ৬০০ দ্বীপ নিয়ে গঠিত মাইক্রোনেশিয়া। চারটি বৃহৎ দ্বীপকে কেন্দ্র করে দেশটি প্রধানত চারটি রাজ্যে বিভক্ত। এগুলো হলো কোছরেই, পনপেই, চুক ও ইয়াপ। মহাসগারের বিশাল অংশজুড়ে এর অবস্থান, যা ফ্রান্সের আয়তনের প্রায় পাঁচ গুণ। প্রকৃতপক্ষে সব দ্বীপকে একত্র করলে এর আয়তন দাঁড়ায় মাত্র ২৭১ বর্গমাইল। আকার আয়তনের দিক দিয়ে এটি একটি অদ্ভুত দেশই বটে। এর পাশে ক্যারোলিন দ্বীপপুঞ্জ আরো একটু দূরে অবস্থিত ফিলিপাইন। দক্ষিণে নিউগিনি। আরো দক্ষিণে চলে গেলে অস্ট্রেলিয়া সোলোমন দ্বীপপুঞ্জ। পূর্বে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ। পশ্চিমে পালাউ ও ফিলিপাইন। প্রশান্ত মহাসাগরের সীমাহীন জলরাশি ছুঁয়ে আছে মটরদানার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দ্বীপগুলোকে। মূলত ক্যারোলিন দ্বীপ থেকেই প্রায় চার হাজার বছর আগে আগত মানুষ মাইক্রোনেশিয়ায় প্রথম জনবসতি গড়ে তোলে।

স্বাধীন দেশ হিসেবে জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে স্বীকৃত হলেও কার্যত একটি পরনির্ভরশীল দেশ। ‘কমপ্যাক্ট অব ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন’ নামক চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকার অধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বপরিসরে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ন্যাস্ত। মার্কিনিরা চাইলে সেখানে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে পারবে। তৃতীয় কোনো দেশ নাক গলাতে পারবে না ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দ্বীপমালায়। উড়োজাহাজ থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের সীমাহীন নীল পানিতে এগুলোকে ছোট ছোট মটরদানার মতোই দেখায়। মনে হয় বিস্তৃত একটি অঞ্চলে কেউ যেন ভাসিয়ে দিয়েছে এগুলোকে। দিগন্তবিস্তৃত মহাসাগরে কিছু গাছপালা নিয়ে চরগুলোকে রহস্যময় মনে হয়। শত শত মাইলের স্বচ্ছ নীল পানিতে সবুজাভ এসব ক্ষুদ্র দ্বীপ। ইউরোপীয়দের লোলুপ দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি অতি ক্ষুদ্র এ দ্বীপগুলোকে। ইউরোপের বিভিন্ন জাতি যখন সম্পদ আর ব্যবসার বিস্তৃতি বাড়ানোর নেশায় বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, সেই সময়ে জার্মান, ব্রিটিশ আর স্প্যানিশদের মধ্যে এ দ্বীপগুলোর দখল নিয়েও প্রতিযোগিতা হয়েছে।

প্রায় চার হাজার বছর আগে মাইক্রোনেশিয়া জনবসতি ওঠার প্রমাণ পাওয়া গেছে। জনবসতি গড়ে ওঠার প্রথম দিকেই গোত্রব্যবস্থার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দীপে ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের জনবসতির বিকাশ ঘটে। ইউরাপীয় উপনিবেশ স্থাপনকারীরা লোভাতুর দৃষ্টি নিয়ে পৌঁছায় ষোড়শ শতকে। প্রথমে আসে পর্তুগিজরা তাদের অনুসরণ করে আসে স্প্যানিশরা। সম্পদের লোভ তাদের গভীর মহাসমুদ্রে টেনে নিয়ে আসে। একপর্যায় স্পেন দখল করে নেয় দ্বীপগুলো। ১৮৯৯ সালে স্প্যানিশদের তাড়িয়ে দেশটির কর্তৃত্ব নেয় জার্মানরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি দখল করে জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে জাপানও বিদায় নেয়। জাতিসঙ্ঘের ট্রাস্ট টেরিটরির আওতায় আসে এটি। তখন প্রধান চারটি অঞ্চল পৃথক ছিল। ১৯৭৯ সালে এ চার অঞ্চল নিয়ে একটি সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় ফেডারেটেড স্টেট অব মাইক্রোনেশিয়া রাষ্ট্র গঠিত হয়। ১৯৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রথম কমপ্যাক্ট অব ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২০০৪ সালে এ চুক্তি নবায়ন করা হয়।

একনজরে মাইক্রোনেশিয়া
নাম
ফেডারেটেড স্টেটস অব মাইক্রোনেশিয়া
রাজধানী
পালিকির
আয়তন
৭০০ বর্গকিলোমিটার
জনসংখ্যা
১ লাখ ১১ হাজার
প্রধান ভাষা
ইংরেজি, পনপিয়ান, ইয়াপস, ট্রুকস ও কসরিয়ান
ধর্ম
খ্রিষ্টান
গড় আয়ু
৬৮ বছর (পুরুষ) ৬৯ বছর (মহিলা)
মুদ্রা
ডলার
প্রধান রফতানিদ্রব্য
মাছ, পোশাক, কলা
মাথাপিছু আয়
২ হাজার ৩০০ ডলার

ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটির এক কক্ষবিশিষ্ট আইন সভা। এর সদস্যসংখ্যা ১৪। এর মধ্যে চারজন চার রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করবেন। তাদের কার্যকাল চার বছর। বাকি ১০ জন ১০টি নির্বাচনী জেলা থেকে নির্বাচিত হবেন। এদের মেয়াদ দুই বছর। প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে আইন সভা। তারা রাজ্যের প্রতিনিধিত্বকারী চার সিনেটরের মধ্যে থেকে হয়ে থাকেন। রাষ্ট্রের প্রধান দু’টি পদে নির্বাচন হওয়ার পর সংসদের ওই দু’টি খালি আসনের পুনর্নির্বাচন হয়। একটি মন্ত্রিসভা গঠন করা হয় তারা প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টকে সহায়তা করে। দেশটিতে কোনো আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক দল নেই। রাজ্যগুলো ব্যাপক স্বাধীনতা ভোগ করে। কার্যত কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো দায়িত্ব থাকে না।

দেশের অর্থনীতি বিদেশী সাহায্যনির্ভর। চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের সাহায্য দিয়ে থাকে। ১৯৮৬ থেকে ২০০১ সালে ১ লাখ জনসংখ্যার দেশটি ২০০ কোটি ডলার সাহায্য পায় আমেরিকা থেকে। ২০০৪ থেকে পরবর্তী ২০ বছরে আরো ২০০ কোটি ডলার সাহায্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, সরকারের সামর্থ্য বাড়ানো, ব্যক্তি খাতের উন্নয়ন ও প্রধান সরকারি কর্মকর্তাদের বেতনভাতা বাবদ বিশেষত এ অর্থ ব্যয় হয়। জাপান ও অস্ট্রেলিয়াও মাইক্রোনেশিয়ানদের অর্থসাহায্য করে থাকে। 
তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বড় ভূমিকা রাখে কৃষিকাজ ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ। উচ্চ মানসম্পন্ন ফসফেট খনি রয়েছে এখানে। পর্যটন শিল্পেরও ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব আর অনেকটা বিচ্ছিন্ন অবস্থানের কারণে পর্যটকরা মাইক্রোনেশিয়া নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাননি।

বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বাস মাইক্রোনেশিয়ায়। বেশিরভাগই আশপাশের দ্বীপগুলোর বংশধর। এদের মধ্যে প্রায় ৪৯ শতাংশ চুক, পনপিয়ান ২৪ শতাংশ, কোছরেইয়ান ৬ শতাংশ, ইয়াপস ৫ শতাংশ বাকিদের বেশিরভাগই এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে এসেছে। এদের বড় একটা অংশের পূর্বপুরুষরা জাপান থেকে এসেছে। জাপানি ঔপনিবেশিক আমলে এই অভিবাসন ঘটে। চীনা ও ফিলিপিনো বংশোদ্ভূতদেরও দেখা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা ও ইউরোপীয় মানুষের সংখ্যা বাড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ইংরেজি কমন ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যমও ইংরেজি।
রাজধানী পালিকির ও চারটি রাজ্যের রাজধানী ছাড়া প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। ৩ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বাড়ছে দেশটিতে। বাকি বিশ্ব থেকে আলাদা বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী শিক্ষা-সংস্কৃতি আর সভ্যতার ছোঁয়া থেকে দূরেই ছিল। অধীনতামূলক স্বাধীনতা চুক্তির আওতায় ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। তারা শিক্ষা-দীক্ষায় ইতোমধ্যে বেশ এগিয়ে গেছে। ঘরে ঘরে এখন আমেরিকা প্রবাসী। সেখানে গিয়ে তারা উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। একটা অধীনতামূলক স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল জনস্রোতের সাথে মিশে গেছে।

ভৌগোলিক কারণে ফিলিপিনো সংস্কৃতি এদের জীবনে প্রাধান্য বিস্তার করে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আশপাশের অঞ্চলের জনসংস্কৃতির প্রভাবও পড়েছে। অস্ট্রেলিয়া, মেলেনেশিয়া আর পলিনেশিয়ার জীবনযাত্রার ছাপ রয়েছে মাইক্রোনেশিয়ার জনগণের মাঝে। প্রতিটি রাজ্যের আলাদা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। প্রতিটি দ্বীপের জনসাধারণের মধ্যে সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ়।

জনসংখ্যা আর ক্ষুদ্র স্থলভাগ হলেও দেশের ভৌগোলিক বিস্তৃতি মোটেও ছোট নয়। নিরাপত্তার জন্য তাদের তৎপর থাকতে হয়। একটি মেরিটাইম পুলিশ ইউনিট রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দেশটির যাবতীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। মজার বিষয় হচ্ছে, এ দেশের জনগণ চাইলে মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারে। এ জন্য আলাদা করে তাদের আমেরিকার নাগরিকত্ব নেয়ার প্রয়োজন হয় না।

বর্তমান প্রেসিডেন্টের নাম ইমানুয়েল মানি মুরি। ২০০৭ সালে শপথ নেয়া মুরি দেশটির সপ্তম প্রেসিডেন্ট। সবচেয়ে বেশি জনঅধ্যুষিত রাজ্য চুকের বাসিন্দা তিনি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক্সিকিইটভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মুরি জাপানি বংশদ্ভূত।

মাইক্রোনেশিয়ায় কোনো দৈনিক সংবাদপত্র নেই। কেন্দ্রীয় সরকার একটি পাক্ষিক পত্রিকা বের করে। এটি সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের সাময়িক ফিরিস্তিতে ভরা থাকে। রাজ্য সরকারগুলো বের করে একটি করে নিউজলেটার। কেন্দ্রীয় সরকার ও ধর্মীয় সংগঠনগুলো মিলে বেশ কয়েকটি রেডিও স্টেশন চালায়। পনপেই ও চুকেতে ক্যাবল টেলিভিশন সহজলভ্য।

No comments:

Post a Comment

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি

সম্পাদকীয় কার্যলয়

Rua padre germano mayar, cristo rio -80040-170 Curitiba, Brazil. Contact: +55 41 30583822 email: worldnewsbbr@gmail.com Website: http://worldnewsbbr.blogspot.com.br

সম্পাদক ও প্রকাশক

Jahangir Alom
Email- worldnewsbb2@gmail.com
worldnewsbbbrazil@gmail.com
 
Blogger Templates