উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা আর রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্য দিয়ে আজ মঙ্গলবার খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ২৮৯টি কেন্দ্রে বিরতিহীনভাবে এ ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
জাতীয় নির্বাচনের ছয় মাস পূর্বের এই নির্বাচন নিয়ে খুলনায় টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে মেয়র পদে জয়-পরাজয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। এই পরিস্থিতিতে আজকের খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কাছে এক অগ্নিপরীক্ষা।
নির্বাচনে পাঁচজন মেয়র প্রার্থী থাকলেও মূলত লড়াই হবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক ও বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর মধ্যে। আওয়ামী লীগ সংগঠিত থাকলেও বিএনপিকে নির্বাচনী মাঠে অনেকটা অগোছাল দেখা গেছে। এই মুহূর্তে বলা যায়, সাংগঠনিকভাবে এগিয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। সবকিছু মিলিয়ে আজ ভোটের মাধ্যমে খুলনায় আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন ঘটবে নাকি পুনরায় আসবে বিএনপি— এই প্রশ্ন সর্বত্রই। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা এবং উন্নয়ন আর বিএনপির প্রার্থীর পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি বিবেচনা করে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন ভোটাররা- এমন প্রত্যাশা নগরবাসীর। তবে শেষ পর্যন্ত কে জিতবে ? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে দেশবাসীকে আজ মধ্যরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
প্রথমবারের মতো কেসিসি নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের কাছেই জয়-পরাজয় প্রেস্টিজ ইস্যুতে রূপ নিয়েছে। সে কারণে এবারের নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণার শুরু থেকেই ভোটের মাঠে তীব্র উত্তাপ ছড়িয়েছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থী বাকযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। তারা একে-অপরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ, নির্বাচনে জঙ্গি ও জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার এবং সর্বহারা-চরমপন্থিদের ব্যবহার করার অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ করেছেন। তাদের এই অবস্থানে সাধারণ মানুষ ও ভোটারদের মধ্যে সংঘর্ষ ও হানাহানি শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিনিধিদল একাধিকবার সিইসির সঙ্গে দেখা করে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দাখিল করেছেন। তাই কি হতে যাচ্ছে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হবে কি না, নিরাপদে ভোট দিতে পারবেন কি না সে বিষয়ে খানিকটি ভাবনায় রয়েছেন ভোটাররা। তবে উচ্চ আদালতের রিটের পর বিএনপি কর্মীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে প্রকাশ্যে এসেছেন।
এ দিকে, বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু গতকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে খুলনার দলীয় কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে অভিযোগ করেছেন, ‘ভোটের আগের রাতে ভোট ডাকাতির পরিকল্পনা রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘পুলিশের নেতৃত্বে রাতেই ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভরার ষড়যন্ত্র চলছে। একটি সুন্দর নির্বাচনকে নিজেদের অনুকূলে নিতে মরিয়া সরকারি দল।’ অবশ্য নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপি প্রার্থীর অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করা হয়েছে। পাল্টা প্রেস ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা এস এম কামাল হোসেন বলেন, বিএনপির মেয়র প্রার্থীর একটিই কাজ সকালে উঠে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো। কিন্তু তিনি এই মিথ্যা তথ্য দিয়ে নির্বাচনে কোনো সুফল বয়ে আনতে পারবেন না।
খুলনার পুলিশ কমিশনার মো. হুমায়ূন কবির বলেন, ‘পুলিশ বিএনপির কোনো নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করছে না। তবে ভোট সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে করতে সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী ও চিহ্নিত আসামিদের গ্রেফতার করছে। বিএনপির প্রার্থী পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করেছেন তা ডাহা মিথ্যা।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ ইত্তেফাককে বলেন, সুষ্ঠু ও সুন্দর একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি আমরা। নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও রংপুর সিটি নির্বাচনে যে ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে খুলনায়। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করার কোনো ধরনের সুযোগ নেই।
মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাঁচজন
মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন— আওয়ামী লীগ মনোনীত তালুকদার আব্দুল খালেক (নৌকা), বিএনপি মনোনীত নজরুল ইসলাম মঞ্জু (ধানের শীষ), জাতীয় পার্টি (জাপা) মনোনীত এসএম শফিকুর রহমান মুশফিক (লাঙ্গল), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত মাওলানা মুজ্জাম্মিল হক (হাতপাখা) ও সিপিবি মনোনীত মোঃ মিজানুর রহমান বাবু (কাস্তে)। এর পাশাপাশি ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৪৮ জন কাউন্সিলর প্রার্থী এবং ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৩৯ জন নারী কাউন্সিলর প্রার্থীসহ ১৮৭ জন কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক সকাল ৮টায় নগরীর সাউথ সেন্ট্রাল রোডের পাইওনিয়ার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে এবং বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু সকাল সাড়ে ৮টায় মিয়াপাড়া মেইন রোডের রহিমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট প্রদান করবেন।
ইসি সূত্র জানায়, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটার চার লাখ ৯৩ হাজার ৯৩ জন।
২৮৯টি কেন্দ্রের ২৩৪টিই ঝুঁকিপূর্ণ
খুলনা সিটি নির্বাচনে ২৮৯টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) কেন্দ্র রয়েছে ২৩৪টি। আর ৫৫টি সাধারণ কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। প্রতিটি সাধারণ কেন্দ্রে ২২ জন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ২৪ জন করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়ন করা হয়েছে। এবার ভোট কক্ষ রয়েছে এক হাজার ৫৬১টি। এ ছাড়া অস্থায়ী ভোট কক্ষ রয়েছে ৫৫টি। এ সব ভোট কেন্দ্রে চার হাজার ৯৭২ জন প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার দায়িত্ব পালন করবেন।
দুটি কেন্দ্রে ইভিএম
নির্বাচনে দুটি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) সাহায্যে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ দুটি ভোট কেন্দ্র হচ্ছে কেসিসির ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সোনাপোতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের পিটিআই কেন্দ্র।
নিরাপত্তার চাদরে খুলনা নগরী
কেসিসি নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিজিবি, র্যাব ও পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন।
যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা
নির্বাচন উপলক্ষে খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আমিন উল আহসান কেসিসি এলাকায় কিছু যান্ত্রিক যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। এতে বলা হয়, ১৪ মে দিবাগত মধ্যরাত ১২টা থেকে ১৫ মে দিবাগত মধ্যরাত ১২টা পর্যন্ত ট্যাক্সিক্যাব, বেবিট্যাক্সি/ অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পো ইত্যাদি চলাচল করতে পারবে না। এ ছাড়া ১৩ মে দিবাগত মধ্যরাত ১২টা থেকে ১৬ মে সকাল ৬টা পর্যন্ত সব ধরনের মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারবে না।
আজ ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা
আজ নির্বাচনের দিন বৃষ্টি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। সকালে বৃষ্টি ও কালবৈশাখী ঝড়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে ভোটাররা দুর্ভোগে পড়তে পারেন। খুলনা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ ইত্তেফাককে বলেন, খুলনায় ভোটের দিন সকালের দিকে অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি ও বজ্রবৃষ্টি হতে পারে।
এ দিকে কেসিসি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মোঃ ইউনুচ আলী জানান, বৈরী আবহাওয়ায় ভোট গ্রহণে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
No comments:
Post a Comment