দক্ষিণ আফ্রিকার নর্থ ওয়েস্ট প্রভিন্সে গত এক মাস ধরে চলা দুর্নীতি বিরোধী বিক্ষোভে নিঃস্ব হয়েছেন প্রায় তিন হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি। ক্ষতিগ্রস্ত এসব বাংলাদেশির অধিকাংশই নর্থ ওয়েস্ট প্রভিন্সের বিভিন্ন শহরে ক্ষুদ্র ব্যবসার সংগে জড়িত ছিলেন। পুঁজি হারিয়ে এসব ব্যবসায়ীর অনেকেই পথে বসেছেন। অনেকে কোনো উপায় না পেয়ে শহরের বিভিন্ন অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। বিক্ষোভে নিঃস্ব হওয়া এসব বাংলাদেশির আর্তনাদ এখন নর্থ ওয়েস্টের আকাশ-বাতাসে।
ঘটনার সূত্রপাত হয় গত ৮ এপ্রিল। নর্থ ওয়েস্ট প্রভিন্সের মেয়র সুপ্রা’র বিরুদ্ধে ৩৫ বিলিয়ন র্যান্ডের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় রাস্তায় নামেন ওই এলাকার জনগণ। দুর্নীতির বিষয়টি খতিয়ে দেখতে মেয়রের কার্যালয়ে অভিযান চালায় আফ্রিকার ইন্টেলিজেন্স ইউনিট হকস্। মেয়রের দুর্নীতির খবর মুহূর্তেই প্রদেশের বিভিন্ন শহরে স্ফূলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এরপর শুরু হয় বিক্ষোভকারীদের তাণ্ডবলীলা। বিক্ষোভকারীরা একের পর এক ভাংচুর করতে থাকে প্রবাসী ব্যবসায়ীদের দোকানপাট। অগ্নিসংযোগ করে ছোট-বড় বহু রেঁস্তোরা ও কাপড়ের দোকানে। বিক্ষোভের দাবানল সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর রূপ দেয় নর্থ ওয়েস্ট প্রভিন্সের মাফিকিং শহরে।
বিক্ষোভকারীরা ২২ থেকে ২৪ এপ্রিল তিন দিনে শহরের প্রায় ১৫শ’ দোকানপাট ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। যার মধ্যে বাংলাদেশিদের দোকান প্রায় ১২শ’। এসব দোকানপাটে কাজ করতেন তিন হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি। দীর্ঘ একমাস ধরে চলা এই বিক্ষোভের তাণ্ডবলীলার করাল গ্রাস নিজ চোখে দেখেছেন প্রবাসী ব্যবসায়ীরা। তাঁদেরই একজন ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার জাহাঙ্গীর আলম বাদল; যিনি নর্থ ওয়েস্টের ক্রিস্টিয়ানা শহরে দীর্ঘদিন ধরে গ্রোসারির (মুদি) ব্যবসা করতেন। তিলে তিলে গড়ে তোলা নিজের স্বপ্ন যখন বিষাদের আগুনে পুঁড়ে ছাই হচ্ছিলো, নিজেকে কোনোভাবেই শান্তনা দিতে পারছিলেন না তিনি। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কঠোর পরিশ্রম ও সাধনায় গড়ে তোলা নিজের ছোট্ট গ্রোসারিটি নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে তা তিনি কল্পনাও করেননি।
ভয়েস বাংলা প্রতিবেদকের সংগে আলাপকালে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সেই তাণ্ডবলীলার বর্ণনা দিচ্ছিলেন বাদল। বাদল বলেন, তাঁর মতো প্রায় ১২০০শ’ বাংলাদেশির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিক্ষোভকারীদের তাণ্ডবলীলায় ছারখার হয়ে গেছে। যাদের দোকানপাট অক্ষত রয়েছে তাঁরাও প্রাণভয়ে দেকানে ফিরতে পারছেন না। জাহাঙ্গীর আলমের মতোই বাংলাদেশের শামসুল হুদা, মোহাম্মাদ ইব্রাহীম এবং আবুল কালাম নর্থ ওয়েস্টের ম্যাফিকিং শহরে মুদির ব্যবসা করতেন। একমাস আগেও যাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জমজমাট ছিলো তাঁরা সব হারিয়ে আজ ভীষণ অসহায়। তাঁরা বলেন, বিক্ষোভকারীরা এতোটাই হিংস্র ছিলো যে, পুলিশও তাদের সামালাতে পারছিলো না।
শুধু শহরে নয়, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও যেসব প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসা করতেন তাঁদের দোকানপাটও ভাংচুর করেছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। বাংলাদেশি ছাড়াও ইথিওপিয়া, পাকিস্তান ও সোমালিয়ানদের দোকানে ভাংচুর করে বিক্ষোভকারীরা। ব্যবসা হারিয়ে এসব প্রবাসী এখন শহরের বিভিন্ন অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা। সর্বশেষ খবর পাওয়া গেছে, তিনিও মেয়রকে পদত্যাগের অনুরোধ জানিয়েছেন।
বাংলাদেশিদের এই দুঃসহ পরিস্থিতি দেখতে নর্থ ওয়েস্ট প্রভিন্স পরিদর্শন করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কাউন্সিলর খালেদা বেগম। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সংগে কথা বলেছেন এবং সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী, পাসর্পোট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নতুনভাবে করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে কথা বলে প্রয়োজনীয় সহযোগিতারও আশ্বাস দিয়েছেন। তবে শ্রম কাউন্সিলনের এমন আশ্বাসবাণীর পরও সন্তুষ্ট হতে পারেননি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। কারণ যেসব এলাকায় বাংলাদেশিদের দোকানপাটে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, তাঁর মধ্যে মাত্র একটি জায়গা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন শ্রম কাউন্সিলর।
ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার সংগে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। তাই এ ধরনের ক্ষতিতে সরকার কোনো পদক্ষেপই নিতে পারবে না। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের বেশিরভাগই ‘অ্যাসাইলাম সিকার’ হওয়ায় দূতাবাসও খুব একটা এগিয়ে আসে না। এ নারকীয় ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশিদের বিভিন্ন সংগঠন। দিয়েছেন সহযোগিতার আশ্বাসও।
No comments:
Post a Comment