বাংলাদেশ থেকে অসহায় মানুষের চাকরির নামে বিদেশে এনে প্রতারণা করা হচ্ছে। কোনো মতেই থামানো যাচ্ছে না এই প্রতারণা।
দালাল চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে দিন দিন। অসহায় গ্রামের সহজ-সরল মানুষের কাছে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে ভালো বেতনে চাকরি প্রলোভন দেখিয়ে বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব দালাল চক্র। আর এ চক্রের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না নারীরাও।
কিছুতেই যেন তাদের রোখা সম্ভব হচ্ছে না। তারা নতুন নতুন কৌশলে গ্রামের সহজ-সরল মানুষের কাছে চটকদারি কথা বলে বিদেশে নানা প্রলোভন দিয়ে মানব পাচার করছে। যেকোনো ভাবেই বিদেশ পাঠানোর পর আকামা (রোড পারমিট) দেয় না। আবার রোড পারমিটের জন্য টাকা দাবি করে। টাকা নিয়েও আবার ভিসার বাতিল (হুরুফ) করে দিচ্ছে।
গতকাল রোববার ভুক্তভোগীরা দালাল চক্র ইউসুফ এবং এজেন্সি জিরো গ্রাউন্ড সার্ভিসের পার্টনার রফিক ও ম্যানেজার জহিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে জেদ্দায় স্থানীয় একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগীরা দাবি করেন রোড পারমিটের টাকা দিতে দেরি হলে তাদের ওপরে পাশবিক নির্যাতন করতেও দ্বিধাবোধ করছে না।
এবার এজেন্সি জিরো গ্রাউন্ড সার্ভিস ও লাকী ট্রাভেল এজেন্সির দালালের খপ্পরে পড়ে নরসিংদীর চরবেলাবর গ্রামের নাদিম হোসেন মানিক চান, পলাশ থানার ইসলাম পাড়া গ্রামের রাশেদ আহমেদ, কাউয়াদী চর সিন্দুর গ্রামের মোহাম্মদ মিলন মিয়া, একই গ্রামের আব্দুল আজিজ ও রফিকুল।
কুমিল্লা সদর দক্ষিণের আরিফ ও হোমনা মাথাভাঙ্গার সাইফুল ও ঢাকা জেলার ধামরাই থানার চালকরা গ্রামের আনোয়ারসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের আরো ১১ জন সৌদি আরবে এসে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তারা দালালের কাছে জায়গা-জমি, গরু-ছাগল বিক্রি করে, ধার-দেনা ও বসতভিটা বন্ধক রেখে টাকা দিয়েছেন।
অভিযুক্ত দালাল ইউসুফ জনপ্রতি ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে ৮২ লাখ ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে সৌদি আরব নিয়ে আসে। এয়ারপোর্ট থেকে তাদের নিয়ে আসার একদিন পর তাদের কাছ থেকে আবার রোড পারমিট (একামা) করার জন্য টাকা দাবি করে। তাদের সাথে চুক্তি ছিল সম্পূর্ণ টাকার ভেতরে একামা, টিকিট ইউসুফ বহন করবেন। কিন্তু বিদেশে আসার পর বাস্তব চিত্র ভিন্ন দেখে অসহায় যুবকদের করুণ পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে।
কেউ কেউ আবার দেশে থেকে টাকা নিয়ে এসে দিলেও দালাল ইউসুফ টাকা নিয়ে একামা তো দূরের কথা তাদের খাওয়া-দাওয়া না দেয়া থেকে শুরু করে রুম থেকেও তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন প্রায় সাত মাস হয়ে গেলেও দালাল ইউসুফের আর কোনো খবর পাচ্ছে না তারা। খেয়ে না খেয়ে অসহায় জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের।
এ ঘটনায় দেশে যুবকদের পরিবারের লোকজন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এমনকি ঘটনাটি প্রবাসীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। পরে তাদের একজনের আত্মীয় জানতে পেলে তাদের নিয়ে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেদ্দার লেবার কাউন্সিলর সালাউদ্দিনের কাছে ঘটনা খুলে বলেন। ঘটনা শুনে লেবার কাউন্সিলর ইউসুফের নামে অভিযোগ দাখিল করতে বলেন। মকবুল মৃধা বাদী হয়ে ইউসুফ ও তার এজেন্সির নামে একটি অভিযোগ দাখিল করেন।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেদ্দা অভিযুক্ত ইউসুফের বিরুদ্ধে রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে ব্যবস্থা নিতে একটি সুপারিশ করেন।
ভুক্তভোগী মানিক চান সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আকুল আবেদন করে বলেন, ‘ইউসুফ ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হলে গ্রামের সহজ-সরল যুবক প্রতারকদের হাত থেকে রক্ষা পাবে। ইউসুফ ও তার চক্রকে এখনি থামানো না গেলে শতশত জালিয়াতি ভিসার মাধ্যমে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের চাকরি দেয়ার নাম করে সৌদি এনে নির্যাতন ও টাকা দাবি করছে। সহায় সম্বল বিক্রি করে আসা গ্রামের অসহায় যুবকদের নিঃস্ব করে দিচ্ছে।’
রাশেদ আহমেদ বলেন, ‘আমরা নতুন এসেছি, সৌদি আরবের পথ-ঘাট কিছুই চিনি না। আসার দুদিন পর ইউসুফ আমাদের রুম থেকে বের করে দেয়। অসহায় অবস্থায় আমরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এগিয়ে না এলে আমাদের যে কি হতো আল্লাহ জানেন। আজকে সাত মাস ধরে আমরা মানবতর জীবনযাপন করছি।’ ইউসুফ ও তার সহযোগীদের শাস্তির দাবি জানান তিনি।
বহু বছর সৌদি আরবের ভিসা বন্ধ থাকার পর চালু হয় বহু কাঙ্ক্ষিত এই শ্রমবাজার। কিছু অসাধু দালাল ভিসা ব্যবসার নামে জালিয়াতি করে এই শ্রমবাজার নষ্ট করে দিচ্ছে। যেখানে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার মধ্যে সৌদি আরব আসার কথা সেখানে পাঁচ থেকে আট লাখ টাকার মতো নিচ্ছে এসব দালাল চক্র। ক্রমেই বাড়ছে এসব দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য।
যেখানে সৌদি আরবের শ্রমবাজার মন্দা, পুরনো যারা আছেন তাদের চাকরি হারাচ্ছেন সেখানে আবার হাজার হাজার ফ্রি ভিসার নামে সৌদি আরবে আগমন। যারা ফ্রি ভিসায় আসছেন চাকরি তো দূরের কথা তাদের চলতেই অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ইউসুফ ও তার সহযোগীদের এখনই থামানো না গেলে জালিয়াতি ভিসা ও ফ্রি ভিসা চাকরি দেয়ার নাম করে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করছে বাংলাদেশের সাধারণ গ্রামের যুবকদের। বাংলাদেশ সরকার এখনই এসব দালাল চক্র নির্মূল করে সৌদি আরবের হারিয়ে যাওয়া শ্রমবাজার ধরে রাখা এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রবাসীরা।
No comments:
Post a Comment