Saturday, July 30, 2016
দেড় হাজারের বেশি নারী জঙ্গি সক্রিয়!
টাঈাইলের কালিহাতীর রোজিনা বেগমকে ৪ জুলাই পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এরপর তারই তথ্যের ভিত্তিতে ধরা হয় সাজিদা আক্তার ও জান্নাতি ওরফে জেমিকে। সাজিদার স্বামী নজরুল ইসলাম ওরফে হাসান ওরফে বাইক নজরুল ভয়ংকর এক জঙ্গি। এই নজরুল পঞ্চগড়ের পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর রায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী, রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি ও মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যাকাণ্ডে জড়িত। তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তিন নারীই স্বীকার করেছে, তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির মহিলা শাখার সক্রিয় সদস্য। তাদের স্বামীরাও একই সংগঠন করে। তারাই এদের এ পথে এনেছে। র্যাব ও পুলিশ বলছে, সারা দেশেই জেএমবিসহ বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠনে এখন রিক্রুট করা হচ্ছে নারীদের। তাদের কাছে এর একটা তালিকাও আছে। তাতে দেড় সহস্রাধিক সক্রিয় সদস্য থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে হামলা চালানোর জন্য এদের ব্যবহারের পরিকল্পনা আছে উগ্রবাদীদের। নারী জঙ্গিরা জেলা পর্যায়ে পাড়া-মহল্লায় ধর্ম প্রচারের নামে ও ছোট ছোট সাপ্তাহিক ধর্মসভার আড়ালে কাজ করছে। পুরুষদের পাশাপাশি জঙ্গিবাদে মহিলাদের তত্পরতায় শঙ্কা বাড়ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জঙ্গিবাদী তত্পরতায় মহিলাদের ব্যবহারের কিছু সুবিধা আছে। পর্দা করার কারণে এদের শনাক্ত করা কঠিন এবং অস্ত্র-বিস্ফোরক বহনও এদের জন্য সহজ। বিশেষ করে আত্মঘাতী হামলায় এদের ব্যবহারে বাড়তি সুবিধা পেতে পারে জঙ্গিরা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নারী জঙ্গি বিষয়ে কথা বলেছেন। ২৫ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি সতর্ক করে বলেন, জামায়াত-শিবির আগে থেকেই মাঠে রয়েছে। এখন তারা লেডি সুইসাইডাল স্কোয়াড গঠন করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগস্ট মাসে আত্মঘাতী হামলার সতর্কবার্তা আছে। জামায়াতে ইসলামীর সুইসাইডাল স্কোয়াড আগে থেকেই সক্রিয়। এবার সেই স্কোয়াডে নারীরাও যোগ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তত্পর হয়ে ওঠে। গোয়েন্দা সূত্রগুলোর মতে, নারী জঙ্গি সৃষ্টিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে হিযবুত তাহ্রীর। নিষিদ্ধ এ জঙ্গি সংগঠনের ছাত্রী মুক্তি সংস্থা নামে একটি শাখা আছে। এর বাইরে জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আল্লাহর দলসহ প্রতিটি জঙ্গি সংগঠনের আলাদা নারী ইউনিট রয়েছে। পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নারী জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে মনিটর করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য। জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুরুষদের পাশাপাশি বেশ কিছুসংখ্যক মহিলা জঙ্গিবাদী কাজে যুক্ত হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে আরো অনেককে আমরা নজারদারির আওতায় আনার চেষ্টা চালাচ্ছি।’ র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, জঙ্গি সংগঠনগুলোর মহিলা সদস্যদের তালিকা করা হয়েছে। তাদের ধরতে সারা দেশে অভিযান শুরু হয়েছে। তাদের ব্যাপারে র্যাবের প্রতিটি ব্যাটালিয়নকে সতর্ক করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনেক দিন ধরেই জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ-হুজি, এবিটি ও হিযবুত তাহ্রীরের নারী সদস্যরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সক্রিয়। তারা ইসলামের দাওয়াতের নামে দেশবিরোধী কাজে লিপ্ত। তাদের অস্ত্র চালানোসহ জঙ্গিবাদী বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সংগঠনের গোপন খবরাখবর আদান-প্রদানের কাজে নারীদের বেশি ব্যবহার করা হয়। জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের মুখে উগ্রবাদী পুরুষ সদস্যরা এখন একটু আড়ালে থেকে নারীদের দিয়েই সাংগঠনিক কাজগুলো সক্রিয় রাখছে। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, জেএমবির সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমান, আব্দুল আউয়ালের স্ত্রীরাও জঙ্গি তত্পরতায় যুক্ত ছিল। তাদের ফাঁসি হওয়ার পর কিছুদিন সংগঠনটির নারী ইউনিট চুপচাপ ছিল। এখন আবার তত্পরতা শুরু হয়েছে। নূরজাহান, মারজিয়া, মিনা আক্তার, লতা, শারমিন, জ্যোত্স্না ও বিলকিসদের দিয়ে নতুন করে গঠন করা হয়েছে মহিলা ইউনিট। তাদের সঙ্গে জেএমবির পলাতক শীর্ষ নেতাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে। ঢাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া, টঙ্গি, গাজীপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুরসহ আরো কয়েকটি অঞ্চলে নারী জঙ্গি বেশি। তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে সংগঠনের সদস্য বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। সূত্র জানায়, গত ২৪ জুলাই সিরাজগঞ্জের মাছুমপুর মহল্লার উত্তরপাড়ায় হুকুম আলীর ভাড়া বাড়ি থেকে আটক করা হয় নাদিরা তাবাসুম রানী, রুনা বেগম, হাবিবা আক্তার মিশু ও রুমানা আক্তার রুমাকে। তাদের কাছ থেকে ছয়টি হাতবোমা, গ্রেনেডের চারটি খোল, ৯টি জিহাদি বই, ডেটোনেটর, সুইচ ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এর আগে গুলশান হামলায় সংশ্লিষ্টতার সন্দেহে নরসিংদী থেকে রুমা আক্তার নামের এক নারীকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। যদিও তার পরিবারের দাবি, রুমা মানসিক ভারসাম্যহীন। ২৩ জুলাই গোপন বৈঠককালে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার আটিয়াতলী এলাকার একটি বাসা থেকে জামায়াতের ১১ নারী সদস্যকে আটক করে পুলিশ। কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগে ঝিনাইদহ শহরের ব্যাপারীপাড়ায় অভিযান চালিয়ে জলি খাতুন নামে জামায়াতের এক নারী কর্মীকে আটক করা হয়। মহিলা জঙ্গি সম্পর্কে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, জঙ্গি সংগঠনগুলোর আলাদা আলাদা মহিলা ইউনিট রয়েছে। তাদের মাধ্যমে যেকোনো সময় নাশকতা চালানো হতে পারে বলে তথ্য পেয়ে তাঁরা সতর্ক রয়েছেন। টাঈাইলের পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া নারী জঙ্গিদের কাছ থেকে চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের স্বামীরাও জেএমবির সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বোঝা যাচ্ছে, আমার জেলায় আরো নারী জঙ্গি আছে। তারা যাতে কোনো অঘটন ঘটাতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় আছে। জঙ্গিবাদ রুখতে পুলিশের পাশাপাশি জনগণও ব্যাপক সাড়া দিচ্ছে।’ পুলিশ-র্যাব সূত্র জানায়, সম্প্রতি রাজধানীর ইডেন কলেজ ক্যাম্পাস থেকে জঙ্গি সন্দেহে লিপি আক্তার, নাজমা সুলতানা, নাসরিন সুলতানা ও নুরুন্নাহার নামে হিযবুত তাহ্রীরের চার মহিলা সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। র্যাব কর্মকর্তারা জানান, তারা সবাই হিযবুত তাহ্রীরের মহিলা ইউনিট ছাত্রী মুক্তি সংস্থার সদস্য। এর মধ্যে নুরুন্নাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও ভূগোল বিভাগ থেকে পড়ালেখা শেষ করেছে। তার স্বামী মনিরুল ইসলাম একই বিভাগ থেকে শিক্ষা শেষ করে। মনিরুল ছাত্র মুক্তির নেতা ছিল। তাদের নেতৃত্বে রাজধানীতে নারী জঙ্গিদের আলাদা একটি ইউনিট রয়েছে। তারা সবাই বিভিন্ন বেসরকারি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বস্তির ছিন্নমূল নারীরাও আছে। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে তারা পুরুষ জঙ্গিদের সহযোগিতা করছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিওর পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ইসলামী দল তাদের সহায়তা দিচ্ছে। গত বছরের ২৪ এপ্রিল বরিশালে জঙ্গি সন্দেহে ২১ মহিলাকে আটক করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে, এরা সবাই হিজবুত তাওহীদসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। এই গ্রুপের দলনেতার নাম হেনারা বেগম। সে জানায়, তারা মাঠপর্যায়ে দাওয়াতি কাজ করে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর নেত্রকোনার বাহির চাপড়া গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আল্লাহর দলের মহিলা সংগঠক হাজেরা খাতুনকে। সে পুলিশকে জানায়, নেত্রকোনায় আল্লাহর দলের ৩৪ জন মহিলা সদস্য রয়েছে। ১৫ আগস্ট পটুয়াখালী শহরের ছোট চৌরাস্তা এলাকা থেকে রুমা খাতুন, সাবিয়া সুলতানা ও আমেনা বেগমকে জিহাদি বইসহ আটক করা হয়। পঞ্চগড়ে জেএমবির শীর্ষ নেতা নজরুলের স্ত্রী ইসমত আরাকে গ্রেপ্তারের পর সে জানায়, তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে জেএমবিতে ভেড়ানো হয়েছে। বগুড়ায় ধরা পড়া মাসুমার স্বামী রাইসুল ইসলাম খান। স্বামী-স্ত্রী মিলে জঙ্গি তত্পরতা চালিয়ে আসছিল। রাইসুলের ডাক নাম ফারদিন। সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মাসুমার বড় ভাই মুজাহিদও জেএমবির শুরা কমিটির সদস্য। ২৭ জুলাই জঙ্গি সন্দেহে ইডেন কলেজের রসায়ন বিভাগের সাবিহা আফরিন সীমা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মোসাম্মত উম্মে সালমা রুমা, সমাজকর্ম বিভাগের মাকসুদা খাতুন, ইংরেজি বিভাগের নাসরিন সুলতানা এবং ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছাত্রী ফৌজি আক্তারকে গ্রেপ্তার করা জয়। তাদের রিমান্ডে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে পুলিশ দাবি করেছে। জেএমবির মহিলা শাখার প্রধানসহ চার আত্মঘাতী জঙ্গি : ভারতের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনার মূল সন্দেহভাজন জেএমবির রাজনৈতিক শাখার প্রধান কমান্ডার শেখ রহমাতুল্লাহ ওরফে সাজিদের স্ত্রী ফাতেমা আক্তারসহ চার মহিলা জঙ্গি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা স্বীকার করেছিল, জেএমবির আবদুল্লাহ কাজী, ইশরাত আলী শেখ ও শওকত সরদার তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়। তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু জিহাদি বই, বিস্ফোরক ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। ফাতেমা বর্ধমান বিস্ফোরণের সময় স্বামীর সঙ্গে ঘটনাস্থলের পাশেই অবস্থান করছিল। শিমুলিয়ায় এক মাদ্রাসায় সে মহিলাদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিত। ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন এ বিষয়ে বলেন, সারা দেশের মহিলা জঙ্গিদের তালিকা করে গ্রেপ্তার অভিযান চলছে। এর আগে ফাতেমা বর্ধমান বিস্ফোরণের পর ভারতের ঝাড়খণ্ডে পালিয়ে গিয়েছিল। পরে সে বাংলাদেশে এলে তাকে আটক করা হয়। ভারতের শিমুলিয়ায় এক মাদ্রাসায় ফাতেমা জেএমবি সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিত। সেখানে অন্তত ২৫ জন নারী জেএমবির সামরিক শাখার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জন বাংলাদেশি, অন্যরা ভারতীয়। সবাই এখন পলাতক। ফাতেমার বাড়ি দিনাজপুর বলে জানা যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের এনআইএ কর্মকর্তারাও জেএমবির নারী ইউনিট বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment