ভয়াল বন্যা। শিকার লাখ লাখ মানুষ। দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। সরকারি হিসাবেই এখন পর্যন্ত ১৬ জেলার ৫৯ উপজেলা বন্যাকবলিত। ত্রাণ আর বিশুদ্ধ পানির সংকটে বানভাসি মানুষ। আশ্রয়ের জন্যও রয়েছে হাহাকার। এখন পর্যন্ত খোলা হয়েছে ৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্র। ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক।
বগুড়া প্রতিনিধি জানান, উজান থেকে ধেয়ে আসা পানিতে যমুনা নদীর তীরবর্তী জনবসতিগুলোতে রেকর্ড পরিমাণ পানি প্রবেশ করেছে। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। শনিবার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার কমে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার প্রায় ৯৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এদিকে বন্যাকবলিত লাখো মানুষ জীবন বাঁচাতে উঁচু জায়গার দিকে ছুটছেন। দিনভর কালিতলা গ্রোয়েন বাঁধ, দিঘলকান্দি হার্ডপয়েন্ট, মথুরাপাড়া হার্ডপয়েন্ট, রৌহদহ, আওলাকান্দি, হাসনাপাড়া ও দড়িপাড়াঘাটে চরের পানিবন্দি বহু মানুষ ঘরের মালামাল ও গবাদিপশু দিয়ে পাড়ি দিচ্ছে বাঁধ এবং বাঁধের পশ্চিম পারের উঁচু জায়গাগুলোতে। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিনভর তাদের ওই সব মালামাল স্থানান্তরের দৃশ্য চোখে পড়ে। পাকুড়িয়াচরের দিলবর আলী, ভোলা, আহেনা, শাহজাহান আলী, লালমিয়া জানান, নৌকা জোগাড় করে মোটামুটি মালামাল নিতে সক্ষম হয়েছেন। অনেকেই নৌকার অভাবে মালামাল সময় মতো পরিবহন করতে না পারায় যমুনা নদীর প্রচণ্ড স্রোতের তোড়ে ঘরের মালামাল, গরু ছাগল, হাঁস-মুরগি, গাছপালা, ধান-চালসহ অন্যান্য আসবাবপত্র ভেসে গেলেও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া করার কিছুই নেই তাদের। এক্ষেত্রে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা তারা পাচ্ছে না। এদিকে তীব্র স্রোতে ইতিমধ্যেই নদীর বুকে বিলীন হয়েছে অসংখ্য স্থাপত্য। এসবের মধ্যে রয়েছে ঘরবাড়ি, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আশ্রয়কেন্দ্র। যমুনার গর্ভে বিলীন হচ্ছে প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা। বন্যা এবং নদীভাঙনের ভয়াবহতায় চরাঞ্চলের মানুষের মাঝে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত জেলার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ১ লাখ ১২ হাজার ৭শ’ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চলতি বন্যায় সারিয়াকান্দি উপজেলায় বিভিন্ন চরের ৪টি মসজিদ, ২টি মাদরাসা, ৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি হাইস্কুল, ৩টি ব্রিজ, একটি বক্সকালভার্ট, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, আবাসন প্রকল্পের ১শ’টি ঘর এবং আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৮০টি ঘর ইতিমধ্যেই নদীর সঙ্গে মিশে গেছে। চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুস সরকার জানান, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নে। চরাঞ্চল হওয়ায় ইতিমধ্যেই মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ ভাগ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ইউনিয়নের অধিকাংশ বাড়িতে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। কেউ কেউ উঁচু বাঁধে আশ্রয় নিলেও অনেকেই এখনো পানিবন্দি হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। দুর্গত এলাকায় এখনো পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছেনি। খাবারের পাশাপাশি নিজেদের থাকার জায়গা এবং গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে চরাঞ্চলের মানুষ। আর কিছুটা পানি বাড়লে এই ইউনিয়নে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন। কর্নিবাড়ি ইউনিয়নের নান্দিনা, দশপাড়া ও সীমান্তপাড়া চরের প্রায় দেড় হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব পরিবারের কাছে এখনো কোনো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেনি। উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা সারওয়ার আলম জানান, পানিবন্দি এসব মানুষের জন্য ১ লাখ ২০ মেট্রিক টন চাল এবং নগদ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নতুন করে ৩০ টন চাল শুধু সারিয়াকান্দি উপজেলার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও সারিয়াকান্দিতে ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। নতুন করে বরাদ্দ চেয়ে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।
ফুলছড়িতে বাঁধে ধস: শতাধিক বাড়িঘর ভেসে গেছে
উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার সিংড়িয়ায় শুক্রবার রাতে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বাঁধের দুই পয়েন্টে অন্তত সাড়ে ৩শ’ ফিট বাঁধ ধসে যায়। বাঁধে ধসের কারণে রাতেই মালামাল, ধান, চাল, নগদ টাকা, ঘরের আসবাবপত্রসহ শতাধিক ঘরবাড়ি মুহূর্তেই পানির তোড়ে ভেসে যায়। এসব পরিবার শিশু সন্তান নিয়ে গবাদিপশুর সঙ্গে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিকাশ কৃষ্ণ সরকার জানান, সব নদীতে পানি কমলেও বিপদসীমার অনেক উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন যাবৎ ফুলছড়ি উপজেলার সিংড়িয়া নামক স্থানে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। চলতি বর্ষা মওসুম ও বন্যার শুরুতে সিংড়িয়া নামক স্থানে বাঁধরক্ষায় জরুরিভাবে মেরামত কাজ শুরু করা হয়। তারপরও বাঁধের বিভিন্ন অংশ দিয়ে পানি চুইয়ে পড়তে থাকে। কয়েকদিনের অবিরাম বর্ষণ ও পানি বৃদ্ধির কারণে বাঁধ হুমকির মুখে পড়ে। কয়েক দিন থেকে সিংড়িয়ায় বাঁধ মেরামতে বালির বস্তাসহ নানা সামগ্রী দিয়ে নদী শাসনের কাজ চলছিলো। কাজ তদারকির জন্য বাঁধে উপস্থিত ছিলেন রংপুরের সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হারুনুর রশিদ। তার উপস্থিতিতে মেরামত কাজ চলছিলো। এ সময় হঠাৎ করে যমুনা নদীর পানির প্রবল চাপে বাঁধের অন্তত ২০ ফিট অংশ ধসে যায়। ধসে যাওয়া অংশ দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করে নতুন নতুন এলাকা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। গাইবান্ধা কৃষি বিভাগ জানায়, বাঁধ ধসে নতুন করে আবারও ১৫টি ইউনিয়নের ৮০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে নতুন করে রোপা আমনসহ ২ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সিংড়িয়া এলাকার ঘরবাড়ি ধসের শিকার লিয়াকত আলী জানান, রাতে ভাঙনের শব্দ শুনে বাচ্চাদের নিয়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাই। হু হু করে পানি এসে ঘরে ঢুকে সবকিছু ভেঙে নিয়ে যায়। কোনো রকমে জীবন নিয়ে বের হয়ে যাই। ঘরের কিছুই রক্ষা করা যায়নি এই গ্রামের শতাধিক পরিবারের। ফুলছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, বর্ষা এলেই লোক দেখানো কাজ করা হয়। লুটপাট করা হয় টাকা পয়সা। সে কারণে আজ সাধারণ মানুষের এই দুর্ভোগ। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস জানায়, ৩৩টিসহ নতুন করে আবার ১৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। জেলা প্রশাসক আবদুস সামাদ জানায়, বন্যার্ত ও ভেঙে যাওয়া পরিবারগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
চিলমারীতে দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি
চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, ব্রহ্মপুত্রের পানি কমতে শুরু করলেও রক্ষা পেল না উপজেলা সদর। পানিতে তলিয়ে গেছে উপজেলা পরিষদ, থানা, কলেজ, স্কুলসহ সদরের রাস্তাঘাট। বিপাকে পড়েছে বিভিন্ন শ্রেণির কর্মকর্তা, কর্মচারী, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষজন। ব্রিজ ও পাকা রাস্তা ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় উপজেলার প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাড়ছে হতাশা। রাস্তা ডুবে যাওয়ায় অচল হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে মানুষ। স্থানীয়দের সূত্র অনুযায়ী, উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের বুরুজের পাড়া এলাকার সড়ক ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্রবল পানির চাপে সদর থানাহাট ইউনিয়নের ঠগেরহাট বাজার এলাকায় একটি ব্রিজসহ পাকা রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় উপজেলা সদর প্লাবিত হয়ে পড়েছে। ফলে উপজেলা পরিষদ, চিলমারী মডেল থানা, চিলমারী ডিগ্রি কলেজ, সদর থানাহাট বাজার, রমনাঘাট রাস্তা, থানাহাট বাজার রাস্তাসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় উপজেলার প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব মানুষের বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন। বরুজের পাড় ও ঠগেরহাট এলাকার লোকজন অভিযোগ করে বলেন- রাস্তা ও ব্রিজ ভেঙে গেলেও উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলীসহ প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা এখন পর্যন্ত এলাকা পরিদর্শনসহ সহযোগীর জন্য এগিয়ে আসেননি। উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম বলেন, সরজমিন পরিদর্শনপূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সরিষাবাড়ীতে সড়ক ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
সরিষাবাড়ী (জামালপুর) প্রতিনিধি জানান, জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। তিনদিনের ব্যবধানে যমুনার পানি বিপদসীমার ১২১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার দেড় শতাধিক গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে চরাঞ্চচলের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। সরিষাবাড়ীর পপুলার টু জামালপুর সড়ক ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে উপজেলার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পিংনা নরপাড়া এলাকায় তারাকান্দি-ভূঞাপুর সড়ক হুমকির মুখে থাকায় যমুনা সারকারখানা থেকে সার পরিবহন ও ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সড়কটি রক্ষার জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন। বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকটে ভুগছে চরাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। গৃহহারা হয়ে বাঁধের উঁচু স্থান, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও আশ্রয় কেন্দ্রে। ভেঙে তলিয়ে গেছে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কামরাবাদ ইউনিয়নের জাপান সরকারের জাইকা প্রকল্পের বেড়িবাঁধ। বাউসী-ধনবাড়ী উপ-মহাসড়কের দুটি স্থানে সড়ক ডুবে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার স্রোতে পৌরসভার রেলি লুইস ড্রেফার্স এলাকার কয়েকটি পরিবার সহ যমুনা তীরবর্তী শতাধিক বসতভিটা নদীগর্ভে চলে গেছে। কৃষকের প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমির উফশী ফসল ও দেড় শতাধিক পুকুর তলিয়ে গেছে। পৌরসভার হাসপাতাল, শিমলা বাজার, আরামনগর বড় বাজার, বাউসী বাজার ও খাদ্যগুদাম সহ প্রায় পুরো এলাকা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। আজ রোববার উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস কর্তৃক বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বন্যাকবলিত মানুষকে শুকনো খাবার হিসেবে বিতরণের জন্য রুটি বানিয়ে বিতরণ করবে বলে জানা গেছে। সরিষাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ও জামালপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আজিজুল হক ভূঁইয়া বন্যা ও ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। বন্যাকবলিত মানুষকে সরকারিভাবে সহায়তার জন্য ৭৫ টন চাল দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
তলিয়ে গেছে অর্ধেক এলাকা
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ১৯৮৮ আর ২০০৭ সালের বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল পুরো সিরাজগঞ্জ জেলা। এবারের বন্যার শুরুতেই সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার একাংশসহ জেলার ৭টি উপজেলার ৮৩টি ইউনিয়নের প্রায় অর্ধেক এলাকার নিম্নাঞ্চল ইতোমধ্যেই তলিয়ে গেছে। পানি বাড়ার গতি সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাদের আশঙ্কা এবারের বন্যা অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যেই বানের পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে চলন বিলাঞ্চলসহ এসব এলাকার পুকুরের মাছ ও ক্ষেতের ফসল। পানি উঠেছে তাঁতঘর ও স্কুল-কলেজে। ডুবে গেছে হাজার হাজার বসতবাড়ি। লাখো মানুষ বাঁধ, উঁচু এলাকা ও আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছে বন্যাক্রান্ত শিশুরা। চরাঞ্চলের সমস্যা সবচেয়ে বেশি। এসব এলাকায় গবাদিপশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় কর্মহীন হয়ে পড়ায় লাখো মানুষ শুধু ত্রাণের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে। সরকারিভাবে যে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। শহর রক্ষা বিকল্প বাঁধে দেখা দিয়েছে ফাটল। চৌহালীতে তীব্র নদীভাঙন দেখা দেয়ায় বিলীন হচ্ছে বসতবাড়ি। পানি উন্নয়ন বোর্ড যমুনা নদীর পশ্চিমপাড়ে অবস্থিত ৮৭ কিমি বাঁধ রক্ষায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বসানো হয়েছে সর্তক পাহারা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মৎস্যভাণ্ডার হিসাবে খ্যাত চলনবিলের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া ও তাড়াশে শ’ শ’ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। তলিয়ে গেছে শাহজাদপুরের গো-চারণ ভূমি এবং এই ৩টি উপজেলার আবাদি ফসল। তাঁত শিল্প অধ্যুষিত শাহজাদপুর ও বেলকুচি উপজেলার শ’ শ’ তাঁত ফ্যাক্টরি বন্ধ রয়েছে। বন্যা আক্রান্ত এলাকার অধিকাংশ স্কুল-কলেজে পানি প্রবেশ করায় সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। চৌহালী উপজেলার খাসরাজবাড়ি ও এনায়েতপুর এলাকায় রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ও বসতবাড়ি ভেঙে যাচ্ছে। সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বিকল্প বাঁধের রাণীগ্রাম এলাকায় কয়েকটি স্থানে ফাটল দেখা দেয়ায় শহরবাসীর মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। এই বাঁধটি ভেঙে গেলে শহরে পানি প্রবেশ করবে। এ চিন্তা ভাবিয়ে তুলেছে শহরবাসীকে। চরাঞ্চলের চারিদিকে পানি থৈ থৈ করায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে কাজিপুর, চৌহালী, বেলকুচি ও সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের লাখো মানুষ। ডুবে গেছে পাট ও সবজি ক্ষেত। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা নদীর পানি ক্রমশ: বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে তা বিপদসীমার ৮৯ সেন্টি মিটার উপর দিয়ে বইছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ওয়ালী উদ্দিন জানান, সরকারি হিসাবে সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলায় ৩৩টি ইউনিয়নের প্রায় শতাধিক গ্রামের কমপক্ষে সাড়ে ১৫ হাজার পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছে। এছাড়াও ১৫ শত বাড়িঘর আংশিক ও পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য ১৩৯টি কেন্দ্রে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ পর্যন্ত জেলার ৫টি উপজেলার বন্যা কবলিতদের মাঝে ৩৭০ মেট্রিক টন চাল ও ১৩ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। চৌহালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল বারী জানান, নদীতে তীব্র স্রোতের কারণে উপজেলার কয়েকটি এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে।
মুন্সীগঞ্জে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
স্টাফ রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ থেকে জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে মুন্সীগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। আকস্মিক পদ্মার নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল পদ্মার ভাগ্যকুল পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে পদ্মা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। তলিয়ে গেছে নদী তীরবর্তী জমির ফসল। নদীতে তীব্র স্রোতের কারণে ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে, জেলার মেঘনা, ধলেশ্বরী ও ইছামতি নদীর পানিও বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে শুক্রবারের চেয়ে ১০ সেন্টিমিটার। এ অঞ্চলে টানা কয়েকদিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি এখনও আশঙ্কাজনক নয় বলে নিশ্চিত করেছে সূত্রটি। তবে এভাবে পানি বৃদ্ধি পেলে বন্যা ভয়াবহ রূপ নিবে। ভাগ্যকুল পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস সহকারী জয়নাল আবেদীন জানান, ভাগ্যকুল পয়েন্টে পদ্মার পানি ৪০ সে.মি উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর তীর ঘেঁষা ঘর-বাড়িতে পানি এসে গেছে। লৌহজং উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. খালেককুজ্জামান জানান, এ উপজেলায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তবে বন্যার মতো পরিস্থিতি হয়নি। নদীর তীর সংলগ্ন বাড়ির উঠানে পানি এসেছে। তবে পানি আরো বৃদ্ধি পেলে বন্যায় রূপ নিবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয়েছে ব্যবস্থা নেয়া হবে তিনি জানিয়েছেন। এদিকে, জেলার শ্রীনগর, টঙ্গীবাড়ী উপজেলার পদ্মার নদীর তীরবর্তী সঙ্গে অবস্থিত বাড়িঘরে পানি আসা শুরু করেছে। তবে নদীভাঙন দেখা যায়নি।
জামালপুরে দুর্ভোগ
জামালপুর প্রতিনিধি: জানান, যমুনা নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ৫ সেন্টিমিটার হ্রাস পেলেও জামালপুরের ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ, সরিষাবাড়ী, বকশীগঞ্জ এবং মাদারগঞ্জ উপজেলার ৫০টি ইউনিয়নসহ ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ ও বকশীগঞ্জ পৌরসভা এখনও বন্যা কবলিত হয়ে আছে। এ পর্যন্ত বন্যার পানিতে ডুবে গত তিনদিনে জেলায় ৭ জন ও সাপের কামড়ে আরো এক জনের মৃত্যু হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ৫ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে গতকাল বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১১৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসণ সূত্রে জানা যায়, বন্যায় এ পর্যন্ত জেলায় ৬ লাখ ৫৯ হাজার ২’শ ২০ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পরেছে। ভয়াবহ বন্যায় মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। চারিদিকে বন্যার পানিতে স্থবির হয়ে পরেছে মানুষের জীবনযাত্রা। বন্যার কারণে চারদিকে পানি থাকায় রান্না করার সুযোগ না পেয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে বানভাসী মানুষ। র্দুগত এলাকায় কাউকে দেখামাত্রই ত্রাণের আশায় ছুটে আসে এসব বানভাসী মানুষেরা। এ পর্যন্ত জেলায় ৩১ লাখ টাকা শুকনো খাবার এবং ৮শ’ মেট্রিক টন চাউল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিতরণের কথা বলা হলেও চরম অব্যবস্থাপনা ও ত্রাণের অপ্রতুলতার কারণে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে বানভাসী মানুষেরা। চিনাডুলি ইউনিয়নের ষাটোর্ধ্ব কুসুম, আজিজুল, মরিয়ম, আবদুল লতিফ, মোবারক আলী, কুলকান্দি গ্রামের আশি বছর বয়সের বৃদ্ধা গোলেছা ও ময়না বেগম অভিযোগ করে বলেন, এখন পর্যন্ত আমারা কোনো ত্রাণ পাইনি। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটালেও কেউই আমাদের খোঁজ নেয় না। বন্যার্দুগত এলাকায় গৃহপালিত পশু নিয়ে বানভাসী মানুষেরা বেশ বেকায়দার মধ্যে রয়েছেন। এ ছাড়াও বন্যা কবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি ও গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক বানভাসী মানুষ গরু-বাছুর, হাঁসমুরগী নিয়ে উচু বাঁধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাস্তার উপর আশ্রয় নিয়েছে। এদিকে বন্যার কারণে বিষাক্ত সাপের উপদ্রব বেড়ে গেছে। চারদিকে পানি থাকায় বিষধর সাপও মানুষের পাশাপাশি উঁচু স্থানে আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছে। এরই মধ্যে সাপের কামড়ে মাদারগঞ্জ উপজেলার আদারভিটা ইউনিয়নের পোড়াবাড়ী এলাকায় মজনু (৩০) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস জানায়, বন্যার এ পর্যন্ত ৫শ’ ১৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ১শ’ ১১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কৃষিবিভাগ জানায়, বন্যার পানিতে এ পর্যন্ত ১২ হাজার হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল তলিয়ে গেছে।
মানিকগঞ্জে ১০০টি গ্রাম প্লাবিত
স্টাফ রিপোর্টার, মানিকগঞ্জ থেকে জানান, পদ্মা-যমুনার পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির ফলে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ১৩ ইউনিয়নের মধ্যে ৮টি ইউনিয়নের অন্তত ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানি ঢুকে পড়েছে পদ্মা বেষ্টিত হরিরামপুর উপজেলা পরিষদ চত্বর এবং আন্ধারমানিক বাজারে। এছাড়া রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় উপজেলা সদরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ইউনিয়ন বিভিন্ন ইউনিয়। উপজেলার ৩০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়ায় ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। এতে চরমভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। এছাড়া শিবালয় উপজেলার আরিচা-তেওতা সড়কে পানি উঠে পড়ায় মানুষজন যাতায়াতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। দৌলতপুরের সাথে বাচামারা ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগের একমাত্র রাস্তাটিও পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া দৌলতপুর ও শিবালয় উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের অন্তত ৫০ টি গ্রামের কয়েক শ’ বাড়ি-ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। ডুবে গেছে বিস্তীর্ণ ফসলী জমি। এদিকে আরিচা পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে।
পদ্মা নদীর পানি বেড়েই চলেছে
ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, গত কয়েদিন পদ্মার পানি বেড়ে এখন বিপদসীমার ৯৬ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে ফরিদপুর জেলার তিনটি উপজেলা ১১টি ইউপি’র অধিকাংশ জায়গা তলিয়ে গেছে। ফরিদপুর সদর, চরভদ্রাসন ও সদরপুর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যে এসব এলাকায় ২৮টি বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণ করা হয়েছে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। শুক্রবার বিকালে ফরিদপুর সদরের আলীয়াবাদ ইউপি’র ভাজনডাঙ্গা পদ্মা নদীর সংলগ্ন এলাকার কাঁচা (মাটির তৈরী) বেড়িবাঁধ ভাঙনের মুখে পরে। পরে প্রশাসন ও স্থানীয় এলাকাবাসীর সহায়তায় বালির বস্তা ফেলে সেটাকে প্রাথমিকভাবে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা চলছে। ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ রিডার ইদ্রিস আলী জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর পানি ২১ সে.মি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৯৬ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম জানান, পানি বৃদ্ধির ফলে ফরিদপুর সদরের চারটি, চরভদ্রাসনের চারটি এবং সদরপুর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি বন্দি রয়েছে ওই সব এলাকার ১৮ হাজারের বেশি পরিবার। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শিবপদ দে জানান, এই পর্যন্ত জেলার ৩২টি স্কুলে পানি প্রবেশ করেছে, তার মধ্যে পাঠদানের অনুপযোগী ২৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (এনডিসি) রুবায়েত হায়াত শিপলু জানান, ফরিদপুর সদর, চরভদ্রাসন ও সদরপুর উপজেলায় বন্যাদুর্গতদের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৫ মে.টন চাল ও ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় সেগুলো বিতরণ শুরু হয়েছে। তিনি জানান, বন্যার সকল ধরনের খবর রাখার জন্য কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। ফরিদপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর জানান, পানিবন্দি মানুষের খোঁজ-খবর রাখার জন্য আমরা দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছি। পাশাপাশি তাদের ত্রাণ সহায়তার জন্য তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
কুড়িগ্রামে দুর্ভোগ কমেনি
স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম থেকে জানান, শনিবার নদনদীর পানি সামান্য কমলেও বন্যাদুর্গত মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। এখন ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৭২ সেমি. এবং ব্রক্ষপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ৮ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ঘরছাড়া মানুষ এখনও বাড়িতে ফিরতে পারেননি। ১৩ দিন থেকে পানিবন্দি সাড়ে ৬ লাখ মানুষ পড়েছে খাদ্য সংকটে। সরকারি ত্রাণ তৎপরতা অপ্রতুল হওয়ায় বানভাসিরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। একই সঙ্গে দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যের তীব্র সংকট। শিশু, গর্ভবতী মা ও বৃদ্ধরা পড়েছেন চরম বিপাকে। সরজমিন উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায় মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ। ব্রহ্মপুত্র নদের দুর্গম গাবুরজান গ্রামের সরমত আলীর বাড়িতে একবুক পানি। স্ত্রী বিউটি বেগম ২০ দিনের শিশুকে নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে। চারদিকে থৈ থৈ পানি। ভয়ে ভয়ে প্রতিটা মুহূর্ত কাটে, কখন শিশুটি পড়ে যায় পানিতে। রান্না করার মতো কোনো উপায় নেই। শুক্রবার সন্ধ্যায় উলিপুর বাজার থেকে এক প্যাকেট শিশুখাদ্য এনেছিল বাবা সরমত আলী। কিন্তু রান্না করতে পারেননি বন্যার পানির কারণে। বাড়ির পাঁচ সদস্য তিনদিন থেকে শুকনো খাবার খেয়ে জীবনকে বাঁচিয়ে রেখেছে। টানা ১৩ দিন থেকে তাদের এ দুর্ভোগ। খাওয়া নেই তাই শিশুটি মায়ের বুকের দুধও ঠিকমতো পায় না। শুধু সরমত আলীর পরিবারের এ অবস্থা নয়, কম বেশি হাতিয়া ইউনিয়নের ৯টি মৌজার মানুষের একই অবস্থা। এ ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী বুড়াবুড়ী ইউনিয়নের বাবুরচর গ্রামের মালেকা বেগম (৫২), মেহেরজান (৫৫) ও আলেয়া বেগমসহ ব্রহ্মপুত্র নদের দুর্গম চরের বেশ কিছু বাড়ি ঘুরে একই চিত্র চোখে পড়ে। চর ও দ্বীপচরগুলোর যেদিকে তাকাই সেদিকেই পানি আর পানি। এসব এলাকার মানুষ ঘরের ছাদে মাচানে অথবা টিনের চালের মধ্যে চৌকির মাঝে রাত কাটাচ্ছেন। পানিতে থাকতে থাকতে হাত পায়ে তাদের ঘা দেখা দিয়েছে। কোনো নৌকার শব্দ শুনলে মানুষজন শুকনো খাবারের জন্য ছুটে আসে। এ মুহূর্তে তারা চাল ডাল চায় না। চায় শুধু শুকনো খাবার, চিড়া মুড়ি গুড়, বিশুদ্ধ পানি আর তৈরি খাবার। বন্যার্ত মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে, ওয়াপদা বাঁধ, উঁচু রাস্তা এবং আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানেই নিয়ে উঠেছে তাদের গরু ছাগল হাঁস মুরগি। চরগাবুরজান সোনারপার গ্রামের ফুলমতি (৩০)। ১৫ দিন আগে তাদের ভিটেমাটি ব্রহ্মপুত্র নদের তীব্র স্রোতে বিলীন হয়ে যায়। দুটি সন্তান নিয়ে মানুষের ঘরে উঠেছে সেখানেও পানি। তার স্বামী আমজাদ জানান, কৃষি কাজ করেই সংসার চলে। কিন্তু দুই সপ্তাহ থেকে হাতে কাজ নেই। ব্রহ্মপুত্র নদের তীব্র স্রোতে বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের ওয়াপদা বাঁধের প্রায় ৪০ ফুট, আব্বাস মেম্বারের বাড়ি থেকে দেলদারগঞ্জ রাস্তায় তিন জায়গায় ভেঙেছে। তীব্র স্রোতের কারণে প্রায় শতাধিক বাড়ি ভেসে গেছে। এসব মানুষ বিভিন্ন রাস্তা ও আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।
কাজিপুরে চার হাজার হেক্টর জমির ফসল পানির নিচে
কাজিপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের চলতি বন্যায় যমুনার পানি স্থিতিশীল রয়েছে। কাজিপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৫ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে তলিয়ে গেছে প্রায় চার হাজার হেক্টর জমির ফসল। কাজিপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে ১১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৭ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। চরের ৬ ইউনিয়নে পাটের চাষ হয়েছে প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমিতে। পানি বেশি হওয়ায় পাট কাটতে কৃষকদের কষ্টের মাত্রা বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে কর্তনকৃত পাটের অনেক জাগ পানিতে ভেসে গেছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মামুনুর রহমান জানান, অনুকূল আবহাওয়ার কারণে অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি এবার পাটের বাম্পার ফলন হয়েছে। বন্যায় শুধু পাটক্ষেত নিমজ্জিত হয়েছে ৩ হাজার হেক্টর।
স্যার, আমাকে কিছু সাহায্য দ্যান!
শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, স্যার, আমাকে কিছু সাহায্য দ্যান! এভাবেই বন্যার্তরা বন্যার পানি সাঁতরিয়ে সাঁতরিয়ে ত্রাণ পাওয়ার জন্য এসে আকুতি-মিনতি করেন। শাহজাদপুর উপজেলার বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৈজুরী ইউনিয়নের জগতলা, গুদিবাড়ী, আররা, ধীতপুরসহ ২৬টি গ্রামের সিংহভাগ এলাকার ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সেই সাথে আশ্রয়হীন মানুষের চরম খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। গতকাল শনিবার কৈজুরী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় বন্যাদুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিরতণ করেন শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম আহমেদ, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আরিফুজ্জামান, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জিন্দার আলী, ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম। ত্রাণ বিরতণের খবর ছড়িয়ে মুহূর্তেই ওইসব এলাকার শ’ শ’ নারী-পুরুষ বন্যার পানিকে উপেক্ষা করে ত্রাণ বিরতণ স্থলে ভিড় জমান। তবে প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণ অপ্রতুল থাকায় অনেকেই ত্রাণ না পেয়ে বিষণ্ন বদনে ফিরে যান। শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম আহমেদ জানান, ‘আমরা পর্যায়ক্রমে সকলের মধ্যেই ত্রাণ বিরতণ করবো।’ এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ১৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় শাহজাদপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। ইতিমধ্যেই শাহজাদপুরে ৬৫ মেট্রিকটন চাউল ও নগদ ৮০ হাজার টাকা বন্যাদুর্গতদের মধ্যে বিরতণ করা হয়েছে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment