যখন কিছু ছিল না তখনো আল্লাহ ছিলেন। শুধু আল্লাহ। আর কেউ নয়। আর কিছু না। হঠাৎ আল্লাহর মনে প্রেম জাগল। ভালোবাসার সাধ হলো। নুরে মুহাম্মাদি সৃষ্টি করে প্রেমিক হলেন। নুরে মুহাম্মাদিকে বানালেন মাশুক। নিজে হলেন আশিক। আশিক-মাশুকের ইশকের বাগানে ফুটল হরেক ফুল। সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ফুলটির নাম আদম। আদমের হৃদয়ও প্রেমের তৃষ্ণায় ব্যাকুল হয়ে উঠল। প্রেমের কারিগর আল্লাহতায়ালার কাছে তা অজানা ছিল না। সৃষ্টি করলেন আদম ফুলের জুড়ি, মা হাওয়া নামে যাকে আমরা চিনি। আদম-হাওয়ার প্রেমের বাগানে আমরা সবাই মানবফুল। আমাদের হৃদয়ও প্রেমের জন্য ব্যাকুল। প্রেম-কারিগর আল্লাহতায়ালা প্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দিলেন আমাদের মনে। পৃথিবী টিকে আছে এই প্রেমেরই কারণে।
স্বামী-স্ত্রী, মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী একে অন্যকে ভালোবাসে। ভালোবেসে সুখে থাকে। এভাবেই চলতে থাকে। চলতে চলতে ভুলতে থাকে। একসময় পথ ভুলে মানুষ হাঁটে অন্য পথে। ভালোবাসে ভুল মানুষকে ভুল নিয়মে। ঠিক তখনই আল্লাহতায়ালা নবী-রসুল প্রেরণ করেন ভালোবাসার শিক্ষক বানিয়ে। তারা মানুষকে বাতলে দেন— এভাবে ভালোবাসো। এ নিয়মে প্রেম কর। আমাদের নবী (সা.)-ও প্রেমের সবক নিয়েই পৃথিবীতে এসেছেন ভালোবাসার পৃথিবী গড়ার জন্য। কোরআনের ভাষায়, ‘হে আমার প্রেমসখা মুহাম্মাদ! আমি আপনাকে সৃষ্টিজগতের প্রেমের নিদর্শন, ভালোবাসার প্রতীক বানিয়ে পাঠিয়েছি।’
তখন আরবে অনাচার-অরাজকতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। প্রেমের নামে অপ্রেম, ভালোবাসার নামে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়েছে জনে জনে। ভালোবাসা মানেই তারা বুঝত উলঙ্গপনা-নির্লজ্জতা ও ভোগ-বিলাসের প্রতিযোগিতা। তাই তো কামের আগুন নেভাতে আপন মা-বোনকেও ব্যবহার করত হামেশাই। পাশ্চাত্য সভ্যতার বিকৃত যৌনাচারের চেয়েও বড় ভয়ঙ্কর ছিল জাহিলি যুগের যৌনসংস্কৃতি। বয়ফ্রেন্ডে-গার্লফ্রেন্ডের গণ্ডি পেরিয়ে ফ্রি-সেক্স ও লিভ-টুগেদারের শেষ সীমায় পৌঁছেছিল তারা। এমন সময় প্রেমগ্রন্থ কোরআন এসেছে প্রেমের মশাল হাতে। বলেছে ভালোবাসার নিয়ম-কানুন। সে নিয়ম মেনেই বিশ্বের বুকে আরবরা হয়েছে শ্রেষ্ঠ মানুষ। সুখী মানুষ।
প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে কোরআন বিশ্বস্ততা ও অঙ্গীকারপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলেছে বার বার। চাই তা স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা হোক, কিংবা বাবা, মা, ভাই, বোনের ভালোবাসা হোক। আজকের মনোবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানও কোরআনের কথায় ফিরে এসেছে। তারা প্রমাণ করেছে, ভালোবাসায় বিশ্বস্ততা, অঙ্গীকার, দায়বদ্ধতা না থাকলে তা যেমন জীবনের জন্য হুমকি, তেমন সুখী হওয়ার পথে বড় বাধা। তাই ইউরোপ-আমেরিকারর মতো ফ্রি-সেক্স ও লিভ-টুগেদারের দেশে এখন বিশ্বস্ত সঙ্গীর খোঁজে হয়রান মানুষ। জাপানের মতো শক্তিশালী প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশের মানুষ বিশ্বস্ত সঙ্গীর অভাবে আত্মহত্যা করছে প্রতিনিয়ত। তার চেয়ে বড় কথা, এ ধরনের ভুল ভালোবাসার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে নারী নিরাপত্তা। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি পাশ্চাত্য দেশগুলোয় নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আফসোস! আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও কীভাবে যেন ভালোবাসার নামে নির্লজ্জতা-নোংরামি ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়, পার্কে এখানে-ওখানে তরুণ-তরুণীরা দিনের আলোয় যে নির্লজ্জতার চর্চা করছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে আমাদের জন্য সত্যিই তা বড় অপমানজনক। স্কুল লেভেলের শিশুরা পর্যন্ত প্রকাশ্যে প্রপোজ-অশ্লীলতা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছে। হায়! আমাদের দেশেও লিভ-টুগেদার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বলে একাধিক সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। আমি তো প্রায়ই বলি, ফ্রি-সেক্সের দেশ হতে আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না আমার সোনার বাংলাদেশকে।
এসব নির্লজ্জতাকে উসকে দিচ্ছে আমাদের মিডিয়া। কাছে আসার গল্প বল, ভালোবাসার কাহিনী জানাও— এ ধরনের কত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যে তরুণ-তরুণীদের মাথা বিগড়ে দিচ্ছে আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি! আপনাদের এসব উৎসাহ পেয়েই আজ একান্নবর্তী পরিবারের বাংলাদেশ লিভ-টুগেদারের পথে হাঁটছে। বাড়ছে অশান্তি-অরাজকতা-আত্মহত্যার প্রবণতা। আমরা যারা এসবে উৎসাহ দিচ্ছি, আমাদের সন্তান-আমাদের প্রজন্মকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছি, গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার।
শেষ করছি প্রেমগ্রন্থ কোরআনের প্রেমময় বাণী দিয়ে। ‘যারা বিশ্বাসীদের মাঝে অশ্লীলতা ছড়াতে উত্সুক এবং উদ্যোগী হয়, তাদের জন্য দুনিয়ায় রয়েছে অশান্তি-অতৃপ্তির জীবন। আর আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। দুনিয়ায় কীভাবে তারা অশান্তি-অতৃপ্তি ভোগ করবে আর আখিরাতে কীভাবে শান্তি ভোগ করবে তা তারা জানে না, আল্লাহ ভালো করে জানেন।’ (সূরা নূর : ১৯)।
হে আল্লাহ! শুদ্ধ ভালোবাসা দিয়ে আমাদের জীবন রাঙিয়ে দিন। অসুন্দরের থাবা থেকে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি ও মাতৃভূমির সন্তানদের রক্ষা করুন।
লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।
No comments:
Post a Comment