ভাষার জরিপ প্রকাশকারী সংস্থা অ্যাথনোলোগের (ethnologue) সর্বশেষ তথ্য মতে, পৃথিবীতে মোট সাত হাজার ৯৯টি ভাষা বর্তমানে চলমান। ভাষার শুরুটা কিভাবে হয়েছে, কিভাবে এতগুলো ভাষার জন্ম হয়েছে, কিভাবে ভাষার ক্রমবিকাশ ঘটেছে, এ নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীদের বিরোধের অন্ত নেই। বহু আগ থেকেই এ বিরোধ চলে আসছে। প্রত্যেকে নিজ নিজ চিন্তা, দর্শন ও বিশ্বাসের আলোকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। চার্লস ডারউইন বলেছেন, ‘এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ভাষার উৎপত্তি হয়েছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শব্দের ইঙ্গিত, প্রাণীদের আওয়াজ ও মানুষের স্বভাবগত উচ্চারিত ধ্বনির অনুসরণ ও সংশোধন করে।’ (The Descent of Man, and Selection in Relation to Sex, 2 vols. London : Murray, p. 56.)
ভাষাবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে ভাষার উৎপত্তি নিয়ে প্রধান দুটি তত্ত্ব সুবিদিত। এক. অবিচ্ছিন্নতাতত্ত্ব বা Continuity theories. সেটি হলো, ‘ভাষার বিষয়টি এত জটিল যে তার চূড়ান্ত প্রকৃতি বিষয়ে কল্পনা করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এটি পূর্বপুরুষদের থেকে পরম্পরাগতভাবে চলে আসছে।’ দুই. বিচ্ছিন্নতাতত্ত্ব বা Discontinuity theories. এ তত্ত্ব আগেরটির বিপরীত। অর্থাৎ ‘ভাষা এমন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত যে মানুষ ছাড়া অন্য কারো মধ্যে ভাষার ব্যবহার পাওয়া যায় না। মানবীয় বিবর্তনপ্রক্রিয়ার কোনো একসময়ে একবারেই হঠাৎ ভাষার প্রকাশ ও বিকাশ ঘটেছে।’ এমন ধারণা নৃবিজ্ঞানীদেরও। নৃবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভাষার উৎপত্তির ঘটনা ইতিহাসে একবারই ঘটেছিল, একাধিকবার নয়। বিশ্বের সব জায়গায় প্রচলিত মানব ভাষাগুলোর মধ্যে গাঠনিক সাদৃশ্য এই অনুমানের ভিত্তি।
বহু শতাব্দী ধরে লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু ভাষার পরিবর্তনশীলতার জন্য প্রাচীন ভাষাগুলোর উেসর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই বললেই চলে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মনে করা হতো, প্রাকৃতিক ধ্বনি থেকে ভাষা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এর যথার্থ কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এবং এ থেকে যে তত্ত্বগুলো তৈরি করা হয়েছিল, তা-ও ছিল মনগড়া ও হাস্যকর। বলা হয়ে থাকে, সর্বপ্রথম প্রাণী ও পাখির আওয়াজ থেকে ধ্বনি তৈরি হয়েছে। এ তত্ত্বের নাম ‘ওউ-ভৌ’ (wow-Bow) তত্ত্ব। এ তত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন জার্মান লেখক ও দার্শনিক জুহান গটপ্রেড হার্ডার (Johann Gottfried Herder.)
কারো কারো মতে, মানুষের আনন্দ, বেদনা ও আবেগ অনুসৃত ধ্বনি থেকে ভাষার জন্ম। এটা হলো ‘পুঃ পুঃ’ (Phoo-phoo) তত্ত্ব।
মুইলরের মতে, বস্তুর প্রাকৃতিক বুদ্বুদ বা আওয়াজ থেকে পাওয়া ধ্বনি থেকে ভাষার জন্ম। এটা ‘ডিঙ-ডঙ’ (Ding-dong) তত্ত্ব।
এ ছাড়া রয়েছে ‘ইউ হে হু’ (Yo-he-ho) তত্ত্ব। সেটি হলো, মানুষের যৌথ কায়িক কসরতের পরিণতিতে ভাষার উদ্ভব হয়েছে। কায়িক প্রচেষ্টার সমন্বয় সাধন করার সময় যে আওয়াজ বের হয়, তা থেকে ভাষার জন্ম। (The Origin of Language. pp. 7-41.)
বিংশশতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কি এ সম্পর্কে একটি অভিমত দিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘ভাষা কোনো যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। ভাষা মানুষের সৃজনী চেতনার সঙ্গে যুক্ত।’
অনেক ভাষাবিজ্ঞানী এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে ইন্দো-ইউরোপীয় আদি ভাষা থেকে সব ভাষার উৎপত্তি। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০ থেকে ৩৫০০ অব্দের মাঝামাঝি সময়ে এ ভাষার জন্ম হয়। তবে তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত নয়।
ভাষার উৎপত্তি বিষয়ে এত জটিলতা থাকার কারণেই ১৮৬৬ সালে প্যারিসের ভাষাতাত্ত্বিক সমিতি (Linguistic Society of Paris) ভাষার উৎসসংক্রান্ত যেকোনো গবেষণাপত্র পাঠে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আজও বেশির ভাগ ভাষাবিজ্ঞানী ভাষার উৎস সম্পর্কে কথা বলতে তেমন আগ্রহী নন, কেননা তাদের মতে ভাষার উৎস নিয়ে যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত এতটাই কল্পনাপ্রসূত যে এগুলোকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া সম্ভব নয়। মানবসভ্যতার ইতিহাসে আকার-ইঙ্গিতের নির্বাক অথবা প্রাক-ভাষা থেকে অন্তত একবার মৌখিক ভাষার জন্ম হয়। এমন ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত। কিন্তু এর বেশি কিছু জানা যায় না। বরং বলা হয়ে থাকে, বৈজ্ঞানিক গবেষণা যেসব জায়গায় অক্ষমতা প্রকাশ করেছে, ভাষার উৎপত্তিবিষয়ক গবেষণা তেমনই একটি স্পর্শকাতর জায়গা। (H. Christiansen, Language evolution. Oxford University Press. pp. 77-93)
তবে চিকিৎসা ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের মতে, শিশুর ভাষার বিকাশ শুরু হয় মাতৃগর্ভ থেকেই। তখন থেকেই সে শব্দের প্রতি সচেতন হয়। এ সময় উচ্চারণ করতে না পারলেও মা-বাবার কণ্ঠস্বর শুনতে পায় ও বুঝতে চেষ্টা করে এবং শব্দভাণ্ডারে শব্দ সঞ্চয় করতে থাকে। ডেইলি মেইল ও হাফিংটনপোস্ট এ বিষয়ে দুটি গবেষণা প্রতিবেদন ছেপেছে। আগ্রহীরা সেখান থেকে চোখ বুলিয়ে আসতে পারেন। (https://goo.gl/3VJWPt; https://goo.gl/txEq9d)
মনোবিজ্ঞানীদের এ তত্ত্ব বিশ্বাসযোগ্য। ভাষা শেখার যোগ্যতা নিয়ে জন্ম না নিলে কোনো শিশুর পক্ষে এত দ্রুত ভাষা রপ্ত করা সম্ভব নয়। এবার একটি আয়াত পাঠ করে নেওয়া যাক। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে এমনভাবে বের করেছেন যে তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও হৃদয়, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। (সুরা : নাহল, আয়াত : ৭৮)
মহান আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এর মাধ্যমে মানুষ পরস্পর ভাববিনিময় করতে পারে। তারা পার্থিব প্রয়োজন পূরণের উত্তম পন্থা আবিষ্কার করতে পারে, আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি, ন্যায়-অন্যায় বোধের জ্ঞানও অর্জন করতে পারে। মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর এ যোগ্যতা নেই। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই (আল্লাহ) মানুষকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।’ (সুরা : আর-রাহমান, আয়াত : ৪)
ভাব প্রকাশের মৌখিক পদ্ধতি ছাড়াও রয়েছে লিখিত পদ্ধতি। সে পদ্ধতিও আল্লাহর শেখানো। আল্লাহ বলেন, ‘পড়ো, তোমার প্রভু মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।’ (সুরা : আলাক, আয়াত : ৩-৪)
ভাষার উৎপত্তি নিয়ে যেসব বিতণ্ডা হয়েছে, সেগুলো হয়েছে কোরআনিক শিক্ষা অগ্রাহ্য করার কারণে। এ বিষয়ে কোরআন তো বহু আগেই মীমাংসা করে দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আল্লাহ শেখালেন আদমকে (আদি মানব) সব বস্তুর নাম। তারপর সেসব বস্তু ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করেন। অতঃপর বলেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা (শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে) সত্য হয়ে থাকো। তারা বলল, আপনি পবিত্র! আমরা তো কোনো কিছুই জানি না, তবে আপনি যা আমাদের শিখিয়েছেন (সেগুলো ছাড়া)। নিশ্চয়ই আপনিই প্রকৃত জ্ঞানসম্পন্ন, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৩১-৩২)
কাজেই ভাষার ইতিহাস মানব ইতিহাসের সমসাময়িক। ভাষাজ্ঞান নিয়েই মানুষের জন্ম হয়েছে, এটা কোরআনের বক্তব্য। এ বক্তব্য অকাট্য, সুনির্দিষ্ট ও শাশ্বত। সুতরাং আদি মানব আদম (আ.) ভাষাজ্ঞান লাভ করেছেন মহান আল্লাহর কাছ থেকে। অতঃপর বংশপরম্পরায় তাঁর সন্তানদের মধ্যে ভাষার বিকাশ হতে থাকে। সে হিসেবে বলা যায়, একসময় পৃথিবীর মানুষ অভিন্ন ভাষায় কথা বলত। তখন ভাষা ছিল মাত্র একটি। কালক্রমে মানুষের চিন্তা ও রঙের বৈচিত্র্যের মতো ভাষাবৈচিত্র্যের উদ্ভব হয়। সেই উদ্ভাবনী ক্ষমতাও মহান আল্লাহ দান করেছেন। ভাষাবৈচিত্র্য মহান আল্লাহর অসীম কুদরতের নিদর্শন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে।’ (সুরা : রুম, আয়াত : ২২)
লেখক : সাংবাদিক
No comments:
Post a Comment