আমাদের জীবন দাবা খেলার মতো। জিততে চান? তাহলে আপনাকে অবশ্যই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর এই পদক্ষেপের মাধ্যমেই বৃদ্ধি পাবে আপনার চিন্তাশক্তি, বিবেক-বুদ্ধি। অনেক সময় আমাদের জীবন সমুদ্রের মতো হয়। অনেক স্রোত, সামলে নেয়া যায় না নিজেকে। তখন এই জীবনটা অনেক তুচ্ছ মনে হয়। ইচ্ছে হয় নিজ হাতেই এই স্রোতকে থামিয়ে দিই।
আমরা অনেকেই হয়তো জীবনে কোনো না কোনো সময় ভেবেছি, মৃত্যু দেখতে কেমন হয়? কেমন লাগবে, যদি মরে যাই? তাদের এই প্রশ্নের ছোট্ট একটি উত্তর, মরে যাওয়া আসলে অনেক সহজ। কিন্তু বেঁচে থাকা? বেঁচে থাকা আসলে অনেক কঠিন। বেঁচে থাকাতে একটা চ্যালেঞ্জ আছে। আমরা সবাই ব্রিটনি স্পিয়ার্সকে চিনি একজন গায়িকা হিসেবে। কিন্তু আমরা কি জানি এই নামকরা পপ গায়িকা তার দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পর অনেক বিষণ্নতায় ভুগতেন? কারণ তার দাম্পত্য জীবনে ধ্বস নামে তখন। এর ফলে তিনি দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু এরপর তিনি চিকিৎসা নেন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।
“The bravest thing I ever did was continuing my life when I wanted to die”- Juliette Lewis
আত্মহত্যা হচ্ছে এই সমাজের একটি ভয়াবহ অসুস্থতার নাম। আজকাল ফেসবুক খুললেই দেখা যায় কেউ না কেউ সুইসাইড করেছে। আর এর বেশীর ভাগই হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ। বেশ অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম আত্মহত্যা নিয়ে কিছু লিখবো। তাই এবার আর ঘোরাঘুরি নিয়ে নয়, বরং কেন আপনার আত্মহত্যা করা উচিৎ নয় তা নিয়েই একটু আলোচনা হয়ে যাক।
আত্মহত্যা কী? আত্মহত্যা মানে নিজেকে নিজে ধ্বংস করা, নিজ আত্মাকে চরম কষ্ট ও যন্ত্রণা দেয়া, নিজ হাতে নিজের জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পরিসমাপ্তি ঘটানো। আবার কিছু মানুষ আছে, যারা নিজেকে আহত বা নিজের ক্ষতি করে। কিন্তু তাদের আসলে মৃত্যুবরণ করার কোনো প্রকৃত ইচ্ছা নেই। একে বলে প্যারাসুইসাইড।
স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এবং জাপানে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি (লাখে পঁচিশের ওপরে)। গত ৫০ বছরে সারা পৃথিবীতে, মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার শতকরা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। সারা পৃথিবীর যত মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করে, তার মধ্যে ২.০৬ শতাংশ বাংলাদেশী। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রতি লাখে ১২৮.০৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি বছর এই সংখ্যার হার বেড়েই চলছে। বাংলাদেশে প্রতিদিন ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। কি ভয়াবহ কথাবার্তা, তাই না? কিন্তু এটাই সত্যি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? কারা আত্মহত্যা করে?
দুনিয়ার সবকিছুই যখন কারো কাছে নেতিবাচক মনে হয়, তারাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তারা নিজের সম্পর্কে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ও অন্য মানুষ সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা পোষণ করে। তারা ভাবে, এই পরিস্থিতি দিন দিন আরো খারাপ হবে এবং এটি পরিবর্তনের জন্য শত চেষ্টায়ও কোনো লাভ হবে না। এর চেয়ে মুক্তির একমাত্র উপায় নিজেকে মেরে ফেলা। এই চিন্তায় তাড়িত হয়ে তারা আত্মহত্যা করে। বাংলাদেশে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায় পারিবারিক সমস্যা (৪১.২%), পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া (১১.৮%), বৈবাহিক সমস্যা (১১.৮%), ভালোবাসায় কষ্ট পাওয়া (১১.৮%), বিবাহ বহির্ভূত গর্ভধারণ ও যৌন সম্পর্ক (১১.৮%), স্বামীর নির্যাতন (৫.৯%) এবং অর্থকষ্ট (৫.৯%) থেকে রেহাই পেতে বেশিরভাগ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
আমাদের জীবনে যেমন ভালো সময় থাকে, ঠিক তেমনই ভাবে খারাপ সময়ও থাকে। ভালো আর খারাপ একে অপরকে পরিপূর্ণ করে। যেমন রাতশেষে এক নতুন ভোর হয়। তেমনই খারাপ সময় শেষে ভালো সময় ঠিকই আসে। আত্মহত্যা যদি সমাধান হতো তাহলে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষই এই পথ বেছে নিতো!
পরীক্ষায় খারাপ করেছো? আবার পরীক্ষা দাও, ভালো মতো প্রস্তুতি নাও। পরীক্ষা ভালো হবেই। জীবনে আরও অনেক পরীক্ষা দেয়ার বাকি আছে। মনে রেখো- আজকের ব্যর্থতা আগামী দিনের সফলতার শক্তি হয়ে কাজ করে। প্রেমে ব্যর্থ? কাউকে অনেক বেশি ভালোবেসে অবহেলিত? শোনো হে বালক-বালিকা, নিজের চেয়ে কাউকে বেশি ভালোবাসা উচিত না, কিছুতেই না। যে ভালবাসা তোমার জীবন নিয়ে নেয়, তা কোনোভাবেই ভালবাসা হতে পারে না। ভালবাসা মানুষকে বাঁচতে শেখায়। মৃত্যুর কারণ হয় না।
আপনি প্রতারণা, অবহেলার শিকার হলেন মানেই যে আপনার জীবন দিয়ে দিতে হবে তা নয়। বরং আপনি আরো একবার নিজের জীবনকে সুন্দর করে গোছানোর সুযোগ পেলেন। আপনার জীবনে এমন সময় আসলে নিজেকে একটু সময় দিন। পরিবার বা প্রিয় মানুষগুলোর সাথে সময় কাটান। দরকার হলে কয়েকদিনের জন্য একঘেয়ে জীবন থেকে ছুটি নিয়ে কোথাও ঘুরে আসুন। নিজের জীবনকে হনন নয়, নতুন করে সাজাতে শিখুন।
যদি কেউ তোমাকে উঠতে বসতে বলে তুমি একটা অপদার্থ, তোমাকে দিয়ে কোনো কিছুই হবে না, তাহলে হাল ছেড়ো না। তুমি আজকে যে কাজটি করতে পারো নি, তার মানে এই নয় যে ভবিষ্যতেও করতে পারবে না। একটি পথ বন্ধ হয়ে গেলো মানে বেশ অনেকগুলো পথ খুলে গেলো। সেই পথগুলো খুঁজে বের করার জন্য দরকার কেবল ধৈর্য আর নিজের প্রতি আস্থা।
আমি দেখেছি অনেক মডেলরা কোনো এক অজানা কারণে নিজেদের জীবন নিজেই দিয়ে দেয়। জীবন যেখানে দ্রোহের প্রতিশব্দ, মৃত্যুই সেখানে শেষ কথা নয় সেনোরিটা! যদি ভেবে থাকো তুমি মরে গেলে শুধু তুমিই মরো, তাহলে তুমি ভুল! তুমি মরে গেলে মরে যায় তোমার পরিবার, মরে যায় তোমার আপনজনেরা। হয়তো সে-ও মরে, যে তোমাকে লুকিয়ে ভালোবাসতো। হারানোর ভয়ে হয়তো কখনো বলতেই পারেনি যে সে তোমাকে ভালোবাসে। হয়তো তুমি তার সাথে কথা না বলে সময় দিয়েছিলে সেসব অমানুষকে, যাদের কারণে একদিন তুমি আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে।
আমার খুব খারাপ লাগে যখন দেখি বা শুনি কেউ আত্মহত্যা করেছে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে তার কষ্ট কি এই সুন্দর পৃথিবী থেকেও বড় ছিল? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কতটা অতৃপ্ত তাদের মন যারা জীবনের সঙ্গে প্রতারণা করে। আমি বিশ্বাস করি আত্মহত্যা করা প্রতিটি মানুষ শেষ মুহূর্তে বাঁচতে চেয়েছিল। তারা সবাই মৃত্যুর সময় একবার হলেও বাঁচার আকুতি করেছিলো। কিন্তু ততক্ষণে খুব দেরী হয়ে গিয়েছিলো।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মহত্যা যেমন মহাপাপ, তেমনি সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি গ্রহণযোগ্য নয়। জীবনে এমন অনেক সময় আসবে যখন আপনি প্রচণ্ড বিষণ্ন অনুভব করবেন, হতাশায় ভুগবেন। যেকোনো প্রকার নীতিবাক্য তখন আপনার কাছে অসহ্য মনে হবে। ঠিক সেসময় নিজেকে বোঝানোর দায়িত্ব মূলত আপনার নিজেরই। খারাপ সময়ে নিজেকে শক্ত রাখুন, মনকে অন্যদিকে ব্যস্ত রাখুন। ধর্মীয় কাজে মন দিন, মনে প্রশান্তি মিলবে।
Suicide is the most sincere form of self-criticism.
আত্মহত্যা আপনার সাময়িক সমস্যার স্থায়ী ভুল। এটি কখনোই আপনার সমস্যার সমাধান হতে পারে না। আপনার সমস্যার সমাধান তখনই হবে যখন আপনি পাল্টা প্রতিঘাত করবেন। আপনার যদি মনে হয় এই পৃথিবীতে আপনার চেয়ে দুঃখী মানুষ আর কেউ নেই, তাহলে আপনি ভুল! একবার বৃদ্ধাশ্রম ঘুরে আসুন। তাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটান। তাদের দুঃখগুলো জানুন। এতিমখানায় গিয়ে ঘুরে আসুন। একবার ভেবে দেখেছেন ওদের তো বাবাও নেই, মা বলে ডাকারও কেউ নেই। তাই বলে কি ওরা আত্মহত্যা করেছে? হাসপাতালেও কিছুটা সময় ব্যয় করে আসতে পারেন। নিজের সুস্থ শরীরটা নিয়ে সেখানকার অসুস্থ মানুষগুলোকে দেখলে নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হবে।
ঢাকা শহরে অনেক বস্তি রয়েছে। তাদের জীবনটা একবার কাছ থেকে দেখে আসুন। ওদের মাথার উপর মাঝে মাঝে ছাদটাও থাকে না। তবু ওরা ওদের জীবন নিয়ে অতৃপ্ত নয় যে, নিজের জীবন নিজেই দিয়ে দেবে। ওরা তবু বাঁচতে চায়। বিশ্বাস করুন, ওদের দেখলে আপনার বাঁচতে ইচ্ছে করবে! সময় কাটান এই মানুষগুলোর সাথে। তবু কেউ আত্মহত্যা করবেন না। কারণ বেঁচে থাকার জন্য অনেক কারণ আছে, কিন্তু মরে যাওয়ার কারণ হয়ত দুই-একটা। এই সুন্দর পৃথিবীতে আপনার জন্ম হয়েছে হেসে-খেলে জীবনটাকে উপভোগ করতে। যখন আপনার মৃত্যুর ডাক আসবে, তখন কেউ আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। তাহলে কেন হেলায় নিজের জীবনটাকে বিলিয়ে দিবেন?
মনে রাখবেন আকাশের তারাগুলো অন্ধকার ছাড়া জ্বলতে পারে না। বেঁচে থাকা একটা আশীর্বাদ। ভীরুর মতো না মরে, হিরোর মতো বাঁচতে শিখুন।
Never give up because great things take time.
Stay Happy
No comments:
Post a Comment