ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে দেশের অসহায় মানুষদের বিদেশে পাঠাচ্ছে এক শ্রেণির প্রতারক চক্র। সুনিদিষ্ট দেশে পৌঁছানোর পর কাজ দেওয়ার নামে নির্যাতন থেকে শুরু করে অপহরণ করা হচ্ছে অনেকেরই। অমানুষিক নির্যাতনের পর দেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে মোটা অংকের মুক্তিপণ। বছরের পর বছর ধরে এই পুরো জালিয়াতি সংগঠিত হচ্ছে দেশ ও দেশের বাইরে থাকা কয়েকটি মানবপাচার ও জিম্মি চক্রের মাধ্যমে। গ্রামের সহজ-সরল সাধারণ মানুষদের সঙ্গে প্রতারণার ফাঁদটিতে রয়েছে পাঁচটি ধাপ। প্রতিটি ধাপেই রয়েছে মানবপাচার ও জিম্মি চক্রের সদস্যরা। চক্রগুলো প্রথম ধাপে স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে বিদেশে যেতে আগ্রহীদের সংগ্রহ করে। দ্বিতীয় ধাপে জাল পাসপোর্ট-ভিসা প্রস্তুত করা হয়। তৃতীয় ধাপে বাংলাদেশ থেকে আকাশ বা নৌপথে বিদেশের পথে পাড়ি দেওয়া হয়। চতুর্থ ধাপে নির্ধারিত দেশে পৌঁছার পর ঐ দেশে অবস্থানরত বাঙালী ও স্থানীয়দের সহায়তায় তাদের জিম্মি বা অপহরণ করা হয়। পঞ্চম ধাপে রয়েছে অপহৃতদের নির্যাতন করে সেই খবর দেশে থাকা স্বজনদের কাছে পৌঁছে বিনিময়ে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। সম্প্রতি এক প্রতারক চক্রকে আটক করেছে র্যাব। র্যাবের এক কর্মকর্তা জানিয়েছে, এ প্রতারক চক্র স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা গ্রামের সাধারণ মানুষদের ‘টার্গেট’ করে। এর পর তাদের জাল পাসপোর্টের মাধ্যমে বিদেশে পাঠাতো। এবং বিদেশে পৌঁছানোর পর এ চক্রটি বিদেশে তাদের আটক করে মুক্তিপণ আদায় করতো। আর যারা সময় মতো মুক্তিপণ দিতে পারতো না তাদের বিভিন্ন ভাবে নির্যাতন চালাতো এ চক্রটি। এমনকি মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হতো তাদের বলেও জানায় র্যাবের এই কর্মকর্তা।
বিদেশে গিয়ে প্রতারিত হয়ে ফিরে আসা আসাদুজ্জামান রোকন জানান, বাংলাদেশি অনেক ছোট-বড় স্থানীয় এজেন্ট রয়েছে। তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষদের অল্প খরচে বিদেশে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে আকৃষ্ট করে। আর এই সহজে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় তাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দেয় রোকন। তিনি বলেন, প্রতারক চক্র মালয়েশিয়া, লিবিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডের জন্য ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা এবং ইউরোপ বা আমেরিকার জন্য জনপ্রতি ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা দাবি করতো। তিনি ৯ লাখ টাকা দিয়ে ইতালি যাওয়ার উদ্যেশে তাদের টাকা দেয়। রোকন আরও বলেন পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা করা, টিকিট ক্রয়ের কথা বলে বিভিন্ন ধাপে টাকা নেয় এ চক্রটি। প্রথম ধাপে কিছু টাকা দেওয়ার পর বিভিন্ন ধাবে তার কাছ থেকে ৯ লাখ টাকা নেয় এ চক্রটি। তিনি বলেন, দেশিয় এ এজেন্টগুলো একই সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ সনদ, ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদি তৈরি করতো। নকল পাসপোর্ট, ভুয়া ভিসা, ভুয়া টিকিটের কারণে অনেক নিরীহ ব্যক্তিকে এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে আসতে হতো বলেও জানান রোকন। রোকন বলেন, দেশিয় প্রতারণ চক্রগুলো বিভিন্ন জায়গায় তাদের নিজস্ব মানুষ থাকতো। যারা দেশ থেকে নৌপথে বা বিমান পথে এ নিরহ মানুষগুলো বিদেশে পাঠানোর কাজ করতো। এই দেশিয় চক্রগুলো আবার সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের সঙ্গে। যার কারণে বিদেশে যাওয়ার পর বিদেশি চক্রগুলো তাদের আবার নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নতুন ভাবে টাকা দাবি করা শুরু করে। এ সময় টাকা দিতে দেরি হলে অমানবিক নির্যাতন করতো বলেও জানায় রোকন। তিনি বলেন, বিমান পথে প্রথমে লিবিয়ায় পৌঁছায় তিনি।
কিন্তু সে দেশ থেকে আর ইতালি যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি তার। কারণ লিবিয়ায় পৌঁছানোর পরই তাকে আটক করা হয়। একই সাথে তার কাছ থেকে নতুন করে ৫ লাখ টাকা দাবি করে এ চক্রটি। পরে তাদের দাবি পূরণ করে এক বাংলাদেশির সাহায্য দেশি ফেরত আছে রোকন। এদিকে দেশে-বিদেশে এমন অনেক চক্র সক্রিয় রয়েছে বলে মনে করছেন র্যা বের অতিরিক্ত মহাপরিচালক(অপারেশন) কর্নেল আনোয়ার। তিনি বলেন, এ ধরনের চক্রকে আটক করার জন্য তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এখন পযর্ন্ত মানবপাচার রোধে ১৫২টি অভিযান পরিচালনা করেছে। এর মধ্যে মানবপাচারকারী চক্রের ৪৩২ জন সদস্যকে গ্রেফতারের পাশাপাশি ৬৯৬ জন ভিকটিমকে উদ্ধার করেছে র্যা ব। তবে তিনি অভিবাসন প্রত্যাশিদের অনুরোধ করেন কোনো দালাল চক্রের মাধ্যমে বিদেশে না গিয়ে। নিজেরা বুঝে-শুনে বিদেশে যাওয়ার জন্য। এতে প্রতারণা হওয়ার সম্ভবনাও কম থাকে।


No comments:
Post a Comment