একটা সময় ছিল ব্রিটেনে যারা পড়াশুনা করত সেই সব বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বেশ আলাদা চোখে দেখা হত। এর মধ্যে বিলেত পাস করাদের কদর ছিল চাকরি,বিয়ে থেকে শুরু করে প্রায় সব ক্ষেত্রে। তবে ২০০৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের মানি ম্যাকিং স্টুডেন্ট স্কিম টায়ার ফোর সে ধারণা পাল্টে দেয়। কোনো ইংলিশ টেস্ট নেই, ন্যূনতম এসএসসি পাস আর ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখাতে পারলেই ভিসা নিশ্চিত এমন এক অপূর্ব সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের ছাত্ররা ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্রিটেনে! কিন্তু হোম অফিসের নানা নিয়মের ফেরে পড়ে এখন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রায় দিশাহারা অবস্থা।
মূলত এই স্কিমের পেছনে কারণ ছিল ব্রিটেনের মন্দার ভেতর থেকে বের হয়ে আসা। ব্রিটেন ২০০৮ সালে যে অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসতেও সক্ষম হয় এই স্কিমের মাধ্যমে। এক বছরে তারা শুধু ওভারসিজ স্টুডেন্টদের কাছ থেকে ৮ বিলিয়ন পাউন্ড সংগ্রহ করে। ২০০৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টায়ার ফোর স্কিমে লক্ষাধিক বাংলাদেশি স্টুডেন্ট এসেছিলেন। তখন সিস্টেমের ফাঁকে যেমন মেধাবী ছাত্ররা এসেছেন, না বুঝে তেমনি অনেক অল্পশিক্ষিত লোকও এসেছেন সার্টিফিকেট ও ব্যাংক স্টেটমেন্ট জাল করে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশি মালিকানাধীন শতাধিক কলেজ গড়ে ওঠে। অনেকেই কোটি কোটি টাকার মালিক হোন চোখের পলকে। শুধু বাংলাদেশি কমিউনিটিতে তখন ৩০০ মিলিয়ন পাউন্ডের লেনদেন হয় এই টায়ার ফোর স্টুডেন্টদের নিয়ে শিক্ষা বাণিজ্যে।
২০০৯ সালে টায়ার ফোর স্কিমে ব্রিটেনে আসা ছাত্র সাগর আহমেদ বলেন, ব্রিটেন এসেছিলাম সোনার হরিণের আশায়। না বুঝে নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই নষ্ট করলাম। একই সময়ে সিলেটের ইয়াকুব হোসেন চলে আসেন ব্রিটেনে। আজ তিনিও অবৈধ। ইয়াকুব বলেন, দেশে অনেক ভালো করার সুযোগ ছিল আমার তা না করে চলে এলাম ব্রিটেনে। এখন অবৈধ হয়ে আছি। দেশে গিয়ে তো জীবনের নষ্ট করা আট বছর ফেরত পাব না। যখনই ব্রিটিশ সরকার অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উঠে দাঁড়ায় তখনই এমন সব নিয়ম আরোপ করে যে টায়ার ফোর স্কিমে আসা ৮৫ শতাংশ অবৈধ হয়ে পড়ে। এদের বড় একটি অংশ চলে যায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, একটি অংশ এখনো ব্রিটেনে অবৈধ হিসেবে রয়ে গেছে।
কিছু অংশ ফিরে গেছে বাংলাদেশে। ২০১৪ সালে ব্রিটিশ হোম অফিস টোয়েক নামে একটি ইংরেজি ভাষা কোর্সকে অবৈধ ঘোষণা করলে ৪৮ হাজার স্টুডেন্টের ভিসা বাতিল করে। ব্রিটিশ সরকার বিদেশি ছাত্রদের ক্ষেত্রে যে কড়াকড়ি আরোপ করেছে তাতে মেধাবী এবং সত্যিকারের ছাত্ররা সবেচেয়ে বেশি কষ্ট করছেন। বাংলাদেশের নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করতে এসেছিলেন এমন ছাত্রও রয়েছে।কিন্তু হোম অফিসের নানা মারপ্যাঁচে পড়ে জীবন অতিষ্ঠ তাদের। বাংলাদেশি রফিকুল রাফি বলেন, বর্তমান নিয়মে একজন ছাত্র কলেজে যদি ফাউন্ডেশন কোর্সে পড়তে আসে তাহলে তাকে বছরে ৩ লাখ ২০ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা দিতে হয়। সেই সঙ্গে আইইএলটিএস ৫.৫ পয়েন্ট থাকতে হবে। ব্রিটেনে একজন স্টুডেন্টের থাকা, খাওয়া এবং ট্রাভেল বাবদ খরচ হয় বছরে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা থেকে ৮ লাখ টাকা।
আবার কলেজের আওতায় ভিসা নিয়ে এলে থাকবে না কোনো কাজের অনুমতি। মানে বছরে প্রায় ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকার পুরোটাই নিজে বহন করতে হবে। যেহেতু কাজের অনুমতি নেই তাই কাজ করা অবৈধ। তাই কেউ যদি নগদ বেতনে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন এবং ধরা পড়েন তাহলে সাময়িক জেলে নিয়ে সেখান থেকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। রাফি আরো জানান, কেউ যদি কোনো মধ্যম সারির ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসে তাহলে তাকে আইইএলটিএস ৬ থেকে ৭ পয়েন্ট তুলতে হবে। সেই সঙ্গে বছরে টিউশন ফি দিতে হবে বছরে ১০ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা। আর থাকা-খাওয়া বাবদ খরচ মিলিয়ে সেটা বছরে হবে প্রায় ২০ লাখ টাকা। তবে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এলে সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজের সুবিধা রয়েছে। সেই হিসাবে বছরে প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা রোজগারের সম্ভাবনা রয়েছে।
এরপর রয়েছে আরও হাঙ্গামা। যদি কেউ পড়ার বিষয় পরিবর্তন করে ভিসার মেয়াদ বাড়াতে চায় তাহলে সেটা আর এখন বাড়ানো যায় না। নিজ দেশে গিয়ে আবার আবেদন করতে হয়। সে ক্ষেত্রে ভিসা না দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক। শুধু ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এলে ওয়ার্ক পারমিট নেওয়ার সুযোগ এখনো আছে তবে সেটাও অনেক শর্ত সাপেক্ষ। আগে ব্রিটেনে অনার্স করার পর দুই বছরের পোস্ট ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া হতো যার মাধ্যমে দুই বছর ফুল টাইম কাজ করে টাকা জমিয়ে অনেকে মাস্টার্স করতে পারতেন। এরপর আবার ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে ব্রিটেনে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ ছিল। বর্তমানে যে সব সিস্টেম আরোপ করেছে সেভাবে আর ব্রিটেনে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। ১০ বছর টানা বৈধ ভিসায় লেখাপড়া করার রেকর্ড থাকলে ব্রিটেনে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে সেটাও পরিবর্তন করার কথা ভাবছে সরকার।


No comments:
Post a Comment