Social Icons

Monday, December 12, 2016

ব্রাজিল ২০১৭ রিও কার্নিভালে আসবে লক্ষ লক্ষ পর্যটক

সাম্বা। ইংরেজিতে ঝঅগইঅ- বিশ্বব্যাপী পরিচিত একটি শব্দ। সাম্বা মানেই ব্রাজিল। ব্রাজিল মানেই এখন সাম্বা। ব্রাজিলের আর সব সম্পদের চেয়ে বিশ্বব্যাপী বেশি পরিচিত সাম্বা। এটি এমনই এক নৃত্য সংগীত যার আকর্ষণীয় সুর আর ছন্দ, সঙ্গে বাদ্য যন্ত্রের মর্মস্পর্শী আওয়াজ আপনাকে সম্মোহিত করে ফেলবে। 


 ব্রাজিল আর সাম্বা যেন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে। আর সাম্বা বলতেই আমাদের সামনে যে চিত্রটি ফুটে ওঠে তাহলো অর্ধ বা তার চেয়েও বেশি অনাবৃত দেহের নারী বা নারীদের নৃত্য। অনেকের ধারণা সাম্বা নাচ অশ্লীলতানির্ভর। আসলে কিন্তু তা নয়। সাম্বা নাচের কিছুটা  বিশ্ববাসী সরাসরি দেখতে পেয়েছেন বিশ্বকাপ ফুটবলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও সমাপনী অনুষ্ঠানে। 

মজার ব্যাপার হলো সাম্বা আর ব্রাজিল একাকার হয়ে গেলেও এর উৎপত্তি আফ্রিকায়। আফ্রিকান দাসদের এই নাচই এখন ব্রাজিলের ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনপ্রিয়তার দিক থেকেও তুঙ্গে। শুধু তাই নয়, নৃত্যের এই ধরন এখন বিভিন্ন দেশেও প্রসারিত হচ্ছে। মানুষের আগ্রহ বাড়ছে এর প্রতি। বছরের পর বছর এই নাচ ব্রাজিলিয়ানদের নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। কার্নিভাল ব্রাসিলেইরোর একটি অংশ এখন সাম্বা। 



এটি এখন ব্রাজিলের জাতিগত ও সামাজিক সম্প্রীতিরও প্রতীকে রূপ নিয়েছে। ষোড়শ বা সপ্তদশ শতকে পর্তুগিজরা ব্রাজিলে কাজের জন্য আফ্রিকা থেকে দাস হিসেবে মানুষ কিনে আনতো। তারা সাধারণত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বাহিয়া রাজ্যে বসবাস করতো। ১৮৮৮ সালে ব্রাজিলে দাস প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর দাসদের অনেকে ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা এলাকায়। বিশেষ করে দক্ষিণের সবচেয়ে বড় শহর রিওতে এসে তারা আস্তানা গাড়তে থাকে। এখন সাম্বার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেছে এই রিও। 



সাম্বা নাচ কবে কোথায় শুরু হয়েছিল এর নির্দিষ্ট কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না। এ নিয়ে রয়েছে ‘নানা মুনির নানা মত’। তবে একটা বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই যে, এটি আফ্রিকান কৃতদাসরাই ব্রাজিলে এর প্রচলন করে। সাম্বা আফ্রিকানদেরই সংস্কৃতির অংশ। ওই সব কৃতদাসরা নানা ধর্মীয় ও ঐতিহ্যগত অনুষ্ঠানে সাম্বা নাচের মাধ্যমে আনন্দ করতো। সাম্বা কেবল শারীরিক কসরতই নয়, এর সঙ্গে বাদ্য যন্ত্রের শব্দ ও ছন্দের বিরাট প্রভাব রয়েছে। বাদ্য যন্ত্রগুলোর মধ্যে পান্ডেইরো, রেকো রেকো, টামবরিম ও কুইকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই যন্ত্রগুলো এক ধরনের শব্দ ও কম্পন তৈরি করে; যা হৃদয়কে ছুঁয়ে যায় সহজেই। 
সাম্বার শব্দটি আসলে সেম্বা থেকে এসেছে। এর উৎপত্তি আফ্রিকান বানটু ভাষা থেকে। বানটু ভাষা এখন কিমবানডু নামে বেশি পরিচিত। তবে সাম্বা শব্দ কুসাম্বা থেকে এসেছে বলেও মত রয়েছে। এর অর্থ হলো প্রার্থনা করা। গান ও নাচের তালে তালে ঈশ্বরের কৃপা প্রার্থনা করা। আমাদের দেশেও এমন অনেক নাচ-গান প্রচলিত ছিল যার 
মাধ্যমে স্রষ্টার আনুকূল্য প্রার্থনা করা হতো। এই যেমন খরা হলে বৃষ্টি কামনা করে গান গাওয়া হতো, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান চাল সংগ্রহ করে ভোজের আয়োজন করা হতো। কখনও কোন বড় বিপদ-আপদ এলে সামাজিকভাবে প্রার্থনা আয়োজন করা হতো, যেখানে নাচ গান থাকতো। সে রকমটি আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলেও চালু ছিল।


ব্রাজিলে যেসব দাস আনা হয়েছে তারা প্রায় সবাই অ্যাঙ্গোলার। ব্রাজিল আর অ্যাঙ্গোলা আটলান্টিক মহাসাগরের এপারে আর ওপারে। সেম্বার অর্থ নাচে সাদর ও আন্তরিক আমন্ত্রণ। ব্রাজিলের সাম্বার মধ্যে অ্যাঙ্গোলর এই ঐতিহ্য নিহিত রয়েছে। এটা কেবল অর্থহীন নাচানাচি নয়, এর মাধ্যমে ধর্মীয় উৎসবও উদযাপন করা হয়। এখনকার সাম্বা নাচে প্রাচীনকালের ছন্দ অনুসরণ করা হয়। পেট ও পশ্চাৎদেশ অনাবৃত করে নৃত্য পরিবেশন করার ধারাটিও এসেছে আদিমদের রীতি থেকে।
ক্রীতদাসদের আধিক্যের কারণে বাহিয়া অঞ্চলকে এক সময় ‘লিটল আফ্রিকা’ বলা হতো। এখান থেকেই সাম্বা ছড়িয়ে পড়ে ব্রাজিলে। প্রথমে আফ্রিকানরা সেখানে ধর্মীয় উপসানালয় তৈরি করে যার পর্তুগিজ নাম টেরেইরস ডা কানডোম্বল। তারা সেখানে নাচ ও গানের মাধ্যমে ঈশ্বরের উপাসনা করতো। বিশেষ করে ধর্মীয় উৎসবের সময় ‘সাম্বা ডা রোডা’ এক ধরনের নাচের আয়োজন করা হতো যাতে আফ্রিকান ড্রাম ব্যবহার করা হতো। বাহিয়ান ধর্মীয় গুরুরাও তাদের বাড়িতে এ রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। আর এতে নাচের মধ্যেও পার্থক্য তৈরি হয়ে যেত। প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে সাম্বা গান রেকর্ড করা হয় পেলো টেলেফোন নামে। এর পরিচালক ছিলেন দোঙ্গা ও মাউরো আলমেইদা। এটা এত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, সাম্বাকে কালোদের গন্ডি থেকে সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে।






ক্রীতদাস প্রথা যখন শেষের দিকে তখন বাহিয়া থেকে দলে দলে আফ্রিকানরা রিওতে আসতে শুরু করে। এলাকা ছেড়ে এলেও সাম্বা অনুশীলন থেমে থাকেনি। এরপর দরিদ্র অঞ্চলের শিশুদের প্রতিষ্ঠা করা হয় সাম্বা শেখার স্কুল এসকোলাস ডি সাম্বা। এভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে পাশের এলাকাগুলোতে। কিন্তু শ্লীলতার মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় এক সময় সাম্বা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। বিশেষ করে দেশটির উচ্চ শ্রেণীর লোকরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। পরে অবশ্য এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এ ব্যাপারে সাম্বা নাচের দিকপাল আনজেনিওর ডি ওলিভেইরা তার এক বইতে উল্লেখ করেছেন এভাবে: আমি যখন ছোট ছিলাম, বাড়ির পেছনের আঙিনায় আমরা নাচের আয়োজন করাতাম বৃদ্ধ মহিলাদের সঙ্গে, যাদের আমরা তিয়াস বা আন্টি বলতাম। কিন্তু প্রায়ই এসে আমাদের নাচ বন্ধ করে দিত। তার পরও থেমে থাকেনি সাম্বার অগ্রযাত্রা। গোপনেই চলতো অনুশীলন। এরই ধারাবাহিকতায় এসকোলাস ডি সাম্বা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ১৯১৭ সালে জনসমক্ষে সাম্বার প্রদর্শনী হয়। সাম্বা কাননাভালেস্কো নামের এ অনুষ্ঠান উপস্থাপন করে আরনেস্তো দস সান্ত।
১৯২০-এর দশকে ব্যাপকভাবে সাম্বা চর্চা হতে থাকে। কারনিভাল ব্রাসিলেইরোতে এ নাচ স্থায়ী হয়ে যায়। সাম্বা স্কুলও বাড়তে থাকে। এতে বিবিন্ন উৎসবে সাম্বা প্রতিযোগিতা অুনষ্ঠিত হতে থাকে যেখানে ৫০ জনের বেশি ছেলে মেয়ে দল বেঁধে অংশ নেয়। ১৯৩০’র দশকে সাম্বা স্কুলগুলোতে সরকার ভর্তুকিও দিতে থাকে যাতে সামাজিক বৈষম্য দূর করে গণতন্ত্র সংহত হয়। ধীরে সাম্বা স্থান করে নেয় বড় বড় হোটেলের বল রুমে। এরপর ১৯২৫-এ পর্তুগিজদের হাত ধরে এ নাচ ইউরোপেও চলে আসে। এখন সাম্বা যুক্তরাষ্ট্রেও প্রসার লাভ করছে। 

তবে সময়ের বিবর্তনে আর অবাধ প্রসারে সাম্বার কিছু বিশেষত্ব হারিয়ে যেতে থাকে। নানা নামে ছোট ছোট উদ্যোক্তারা এটাকে ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে নেয়। তাদের কাছে লাভটাই মুখ্য ছিল। পর্যটন ব্যবসায়ী ও কিছু রাজনীতিবিদ সাম্বাকে পণ্য বানিয়ে ফেলে। একপর্যায়ে সচেতন মহল নড়ে চড়ে উঠে। শুরু হয় সাম্বা রক্ষা আন্দোলন। ১৯৮০-এর দশকে প্যাগোডে মুভমেন্ট নামের আন্দোলনের ফলে সাম্বা আবার তার বিশেষত্ব ফিরে পায়। 


তৃণমূল পর্যায়ের এই আন্দোলনে অংশ নেয় রিও ডি জেনিরোর শ্রমিকশ্রেণীর মানুষ। তারা আফ্রো-ব্রাজিলিয়ান জাতীয়তাবাদকে জিইয়ে রাখার জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। তারা তাদের উদ্যোগে শোভাযাত্রা বের করতে থাকলেন যাতে তারা নিজেদের কথার স্বকীয়তা ফুটিয়ে তুলতেন। এভাবে বাইরের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায় সাম্বা।
তার পরও সাম্বা স্রোতস্বীনির মতো নানা সময়ে গতি পরিবর্তন করে চলেছে। নতুন ধারা-উপ ধারার সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, কারিওকা, এ বাইয়ন, কঙ্গা, মেসেম্বা, এ বাতুকাডো ও কার্নিভালে। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব ধারা রয়েছে। তবে সাম্বারও বিভিন্ন নাম রয়েছে পদ্ধতিগত কারণে। যেমন, সাম্বা ক্যানকাও (সাম্বা সংগীত), সাম্বা কার্নাভালেস্কা (কার্নিভাল সাম্বা), সাম্বা এনরেদো (থিম সাম্বা) ও সাম্বা ডি ব্রেক (ব্রেক সাম্বা)। যারা সাম্বা নৃত্য পরিবেশন করেন তাদের বলা হয় সাম্বিস্তা। 
সাম্বার ইতিহাসের মজার একটি দিক হলো ইসমায়েল সিলভার গাওয়া অংশ। তিনিই প্রথম সাম্বার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন দেইক্সা ফালার। ইসমায়েলই সাম্বা নাচের সঙ্গে গানও জুড়ে দিয়ে রিও’র কার্নিভালের উপযোগী করে তোলেন। একটা সময় তার ওই ধরনটাই দেশজুড়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ফলে মানুষও এটাকে নিজেদের করে নিয়েছিল। পরবর্তীকালে ব্রাজিলের জাতীয়তাবাদী নেতা গেতুলিও ভারাগাস এটাকে ব্রাজিলের জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা দেন। 
সাম্বার বৈশিষ্ট্য
সাম্বা বলরুম নাচ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার  আগে অনেক ধরন ছিল এ নাচের। সঙ্গীর সঙ্গে ছিল আবার এককভাবেও ছিল। রাস্তার সাম্বা আবার দল বেঁধে। সাম্বা নাচে পায়ের কাজ অনেক। পা চালাতে হয় অনেক দ্রুত। এক পায়ের ওপর ভর দিয়ে দ্রুত ঘুরতে হয়। শরীরকে বাঁকানোর  জন্য অ্যাক্রোব্যাটিক কৌশলও জানা থাকতে হয়। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বাদ্যের তালে তালে দ্রুত পা ফেলা এবং শরীরকে দোলানো। হাঁটু গোড়ালির অনেক কৌশল থাকে সাম্বা নাচে। সাম্বা বাউন্স অ্যাকশন হচ্ছে সাম্বার প্রধান অ্যাকশন। এটা নাচকে অসাধারণ দর্শনীয় করে। এটা বেশ মৃদু লয়ে হাঁটু গোড়ালির সাহায্যে করতে হয়। তবে কাজটা নিখুঁতভাবে করতে হলে অনুশীলনের প্রয়োজন। দক্ষ না হলে ছন্দের সঙ্গে তাল মেলানো কঠিন।

২০১৭ রিও কার্নিভালে ব্রাজিলের দিকে দৃষ্টি এখন সারা পৃথিবীর মানুষের। ভিসা পেতে প্রতিটি দেশে ব্রাজিল হাই কমিশনে জানুয়ারিতে দেখা যাবে উপচে পড়া ভিড়। অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশ থেকেও আসতে পারে পর্যটক। 








No comments:

Post a Comment

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি

সম্পাদকীয় কার্যলয়

Rua padre germano mayar, cristo rio -80040-170 Curitiba, Brazil. Contact: +55 41 30583822 email: worldnewsbbr@gmail.com Website: http://worldnewsbbr.blogspot.com.br

সম্পাদক ও প্রকাশক

Jahangir Alom
Email- worldnewsbb2@gmail.com
worldnewsbbbrazil@gmail.com
 
Blogger Templates