Social Icons

Monday, December 26, 2016

ফেসবুকে ধর্ম প্রচারের নামে প্রতারণা

কালের আবর্তনে ফেসবুক একটি বড় যোগাযোগমাধ্যম হয়ে গেছে। দেশ-বিদেশের লাখো মানুষের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে ফেসবুক।
বিশ্বের ১৬০ কোটি (প্রায়) মানুষ সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করে। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা পাঁচ কোটি সাত লাখেরও বেশি। ফেসবুক ব্যবহারকারীর পরিমাণ এক কোটি ৭০ লাখ। (দৈনিক যুগান্তর : ১১-১১-২০১৫)
এ তো এক বছর আগের হিসাব। এক বছরে আরো অনেক বেড়েছে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা।
ফেসবুকের উন্মুক্ত এই বিশাল মাধ্যমকে বেছে নিয়েছে সুযোগসন্ধানী মহল। অপরাধকারীরা যেমন তাদের অপরাধ বাস্তবায়নে জাল বিস্তার করছে, তেমনি বিভিন্ন ভ্রান্ত মতাবলম্বীও তাদের মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে ব্যবহার করছে ফেসবুককে। অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিতেও ব্যবহার করা হচ্ছে ফেসবুক। সরলপ্রাণ মানুষকে বোকা বানিয়ে মিথ্যা প্রচার করার জন্য গুজব এবং ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে তারা। কখনো দেখা যায় যে ‘ইসলাম প্রচারের’ দোহাই দিয়ে করা হচ্ছে এসব কাজ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুয়া আইডি কিংবা পেজ ব্যবহার করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ফেসবুক উন্মাদনা এখন চরমে।
‘আমিন না লিখে যাবেন না’; ‘মুসলমান হলে আমিন না লিখে যাবেন না’ ‘ছুবহানাল্লাহ, আল্লাহর কী কুদরত!’ ‘এটা নবীজির পাত্র, আমিন না লিখে যাবেন না’—এমন লেখার সঙ্গে আল্লাহ কিংবা রাসুল (সা.)-এর নাম কিংবা কালিমা খচিত ছবি হয়তো ফেসবুক ইউজারমাত্রই দেখেছেন। এসব ভুয়া পোস্ট দিয়েই অনেকে ফেসবুকে ‘ইসলাম প্রচার’ করছেন। অনেকেই সরলপ্রাণে লাইক-কমেন্টও করেছেন। অসুস্থ বা রুগ্ণ শিশুর ছবি দিয়ে লিখে দেয়, ‘আমিন না লিখে যাবেন না। ’ ভাবখানা এমন যে, এখানে লাইক দিলেই জান্নাত। প্রশ্ন হলো, এখানে রুগ্ণ ব্যক্তির সঙ্গে আমিন বলার কী সম্পর্ক? নবীজি (সা.)-এর পাত্রের সঙ্গে আমিন বলার কী সম্পর্ক?
পাশাপাশি কয়েকটি ধর্মীয় গ্রন্থের ছবি দিয়ে বলা হয়, ‘আপনি কোনটির সাপোর্টার?’ কখনো দেখা যায় এমসিকিউয়ের মতো প্রশ্ন। আপনার রব কে? এক. আল্লাহ। দুই. ভগবান। তিন. গড। মাঝেমধ্যে দেখা যায়, হৃদয়ে ঝাঁকুনি দেওয়ার মতো প্রশ্ন, ‘আপনি কি মুসলমান?’ মুসলমান হলে লাইক না দিয়ে যাবেন না। আবেগী ফেসবুকাররা এখানে ধুমছে লাইক দিচ্ছেন। এগুলো ইসলাম নিয়ে ইসলামের পরিভাষা ‘আমিনকে’ নিয়ে উপহাস করা ছাড়া কিছুই নয়। কখনো দেখা যায়, অশুদ্ধ বা জাল হাদিস তুলে ধরে বলা হয়, ‘লাইক দিন, যদি জান্নাতে যেতে চান। ’ অথচ মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করা যেন জাহান্নামে নিজের ঠিকানা বানিয়ে নেওয়া। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার ওপর মিথ্যা আরোপ করে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়। ’ (সহিহ বুখারি)
পোস্টটি শেয়ার করলে, ‘আমিন লিখলে অমঙ্গল থেকে বাঁচা যাবে; মনোবাসনা পূর্ণ হবে, শেয়ার না করলে, আমিন না লিখলে ব্যবসায় লোকসান হবে, সন্তান মারা যাবে’—এমন শিরকপূর্ণ কথাবার্তাও থাকে কথিত ইসলাম প্রচারে। আমিন লিখলেই মনোবাসনা পূর্ণ হবে, না লিখলে ক্ষতি—এটা কোরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। কেননা পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোনো কষ্ট দেন, তবে তিনি ছাড়া তা অপসারণকারী কেউ নেই। পক্ষান্তরে যদি তোমার মঙ্গল করেন, তবুও তিনি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। ’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৭)
মূলত এসব পোস্টের মাধ্যমে মানুষকে শিরকে লিপ্ত করা হচ্ছে। একটি আমিন বলা বা শেয়ারই মানুষকে অমঙ্গল থেকে বাঁচাতে পারে—এমন ধারণা তো সম্পূর্ণ শিরক। অনেকেই সরল মনে অযাচিতভাবেই লিপ্ত হচ্ছে শিরকের মতো ক্ষমার অযোগ্য মারাত্মক অন্যায়ে। শিরককারীর জন্য জান্নাত হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন। তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। (শিরকের মতো) অত্যাচারকারীদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই। ’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৭২)
ভুয়া সংবাদের অন্যতম উৎস হয়ে গেছে ফেসবুক। এখানে সবাই যেন সাংবাদিক। ফেসবুকের উন্মুক্ত মাধ্যমে যা ইচ্ছা তা-ই পোস্ট করা যায় বলে একে সুযোগ হিসেবে নিয়ে ভুয়া সংবাদ পোস্ট করেন। প্রায়ই দেখা যায়, ‘মক্কা শরিফের খাদেম স্বপ্নে দেখেছেন... শেয়ার করলে এই পুরস্কার। ’ কয়েক দিন আগে দেখা গেল অং সান সু চির হিজাব পরা ছবি। নিচে লেখা—‘ইসলাম গ্রহণ করেছেন অং সান সু চি। ’ সারা পৃথিবীর কেউ জানে না। কোনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম পেল না সেই খবর, কিন্তু বাঙালির ফেসবুক দখল করে নিল সু চির হিজাবি ছবি! একজন কমেন্টে প্রশ্ন করলেন, ‘এই খবর পৃথিবীর কোনো মিডিয়া পেল না, আপনি কোত্থেকে পেলেন?’ জবাব দেওয়া হলো, ইহুদি-নাসারারা কি ইসলাম গ্রহণের খবর প্রচার করবে? কথায় কিন্তু যুক্তি আছে।
আরেকবার দেখা গেল, ‘এবার সনাতন ধর্ম গ্রহণ করলেন নওয়াজ শরিফের ভাতিজি। সবাই আশীর্বাদ করুন। ’ ‘যজ্ঞ করে ইসলাম ছেড়ে রফিক এখন হিন্দু রাজু। দেখামাত্রই পোস্টটি শেয়ার ও দাদাকে আশীর্বাদ করুন। ’ এসব ছবি নিছক ফটোশপের কারসাজি। ছবিটি ভালোভাবে দেখলে বোঝা যাবে যে কাজটা এত নিপুণভাবে করা যে তা কোনো আনাড়ি ধর্মপ্রিয় ফেসবুকারের কাজ নয়। বরং খুব ঝানু কেউ মুসলমানদের হাসির পাত্র বানানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে কাজটা করেছে। প্রথমত, যাঁরা এ ধরনের পোস্ট দিয়ে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে খেলা করছেন, তাঁরা মারাত্মক অন্যায় করছেন। মিথ্যা বলা, লেখা, প্রচার করা ইসলামের দৃষ্টিতে ভয়াবহ কবিরা গুনাহ। একটি কবিরা গুনাহই একজন মানুষকে জাহান্নামে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহর কথা বলব না? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা, মাতা-পিতার অবাধ্যতা, এরপর তিনি ঠেস দিয়ে বসে বললেন এবং শোনো! মিথ্যা কথা। তিনি (মিথ্যা কথা) বারবার বলতে লাগলেন। ’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)।
অনেক সময় লাইক বা কমেন্ট পাওয়ার জন্য এ ধরনের মিথ্যা বা গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। লাইক-কমেন্ট পাওয়ার লোভ এক ধরনের মানসিক অসুস্থতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। তারা যেন লাইক-কমেন্টের কাঙাল। ফলে বেশি লাইক পেতে ধর্মীয় অনুভূতি আর গুজবকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, লাইক বা কমেন্ট কী মহামূল্যবান জিনিস যে মিথ্যা প্রচার করে লাইক বা কমেন্ট পেতেই হবে! কী উপকার হবে এতে? মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যা প্রচারের মধ্য দিয়ে অতি সাময়িক ফায়দা লাভ হলেও মূলত এর দীর্ঘকালীন ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন। কারণ মিথ্যা ফাঁস হয়ে গেলে মিথ্যাবাদীর জন্য বয়ে আনে মারাত্মক লাঞ্ছনা ও দুর্ভোগ। পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘দুর্ভোগ প্রত্যেক মিথ্যাবাদী পাপীর জন্য। ’ (সুরা : জাসিয়া, আয়াত : ৭)
কখনো দেখা য়ায়, মিথ্যা দিয়ে কেউ কাউকে হাসাতে চায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কঠিন দুর্ভোগ তার জন্য, যে মিথ্যা ও অলীক কথা বলে লোককে হাসাতে চায়। তার জন্য কঠিন দুর্ভোগ, তার জন্য কঠিন দুর্ভোগ। ’ (তিরমিজি, আবু দাউদ)
এ ধরনের মিথ্যাচার মুনাফেকির আলামত। যিনি এ ধরনের মিথ্যা পোস্ট দেবেন, তিনি যতই ইসলামের দরদি সেজে নিজেকে একজন একনিষ্ঠ মুসলমান হিসেবে প্রমাণ করতে চেষ্টা করুন না কেন, তার কাজটি প্রমাণ করছে যে তিনি একজন মুনাফিক। রাসুলে কারিম (সা.) বলেন, ‘মুনাফিকের আলামত তিনটি (অর্থাৎ কোনো মুমিনের দ্বারা এ কাজগুলো সংঘটিত হবে না। যদি কেউ এ কাজগুলো করে সে আর মুমিন নয়, বরং সে হলো মুনাফিক) ১. কথা বললে মিথ্যা বলে। ২. ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে। ৩. তার কাছে আমানত রাখা হলে সে এর খিয়ানত করে। ’ (বুখারি ও মুসলিম)
যুগে যুগে মিথ্যা বলে, মিথ্যা প্রচার করে মুনাফিকরাই ইসলামের বেশি ক্ষতি করেছে। ইসলামকে হাসির পাত্র বানিয়েছে। মহানবী (সা.)-কেও তারাই বেশি কষ্ট দিয়েছে।
এ বিষয়ে আমাদের করণীয় হলো, কোনো সংবাদভিত্তিক পোস্টে লাইক বা কমেন্ট করার আগে সংবাদটির উৎস জানতে হবে যে তা কোনো সঠিক উৎস থেকে এসেছে কি না। অনেক আবেগপ্রবণ ফেসবুকারই লাইক বা কমেন্ট শেষে এসব মিথ্যা পোস্ট শেয়ারও করে যাচ্ছেন। অথচ একজন মুসলমানের জন্য কারো নিয়ে আসা এ ধরনের কোনো খবর যাচাই না করে বিশ্বাস করার কোনো সুযোগ নেই। মুমিন তো কোনো গুজবে কান দিতে পারে না। পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনগণ! কোনো পাপাচারী ব্যক্তি যদি তোমাদের কাছে কোনো খবর নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে। যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও। ’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৬)
একটি মেয়ের ছবি দিয়ে লিখে দেওয়া হলো, ‘এই হিজাবি বোনটির জন্য কত লাইক? সবাই লিখুন মাশাআল্লাহ। সেই ছবিতে ‘মাশাআল্লাহ’ লেখা কমেন্টের ধুম পড়ে গেল। শেয়ারের ঝড়ে ছবিটি ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুক কমিউনিটিজুড়ে। এ নিয়ে ধর্মবিরাগী অনলাইন এক্টিভিস্টরা হাসাহাসি করে মজাও নিচ্ছেন বেশ। উপহাসের পাত্র বানিয়ে দেওয়া হলো হিজাবকে। এ জন্য যারা এসব কথার সত্যতা না জেনেই প্রচার করবেন, তাঁরাও নবীজি (সা.)-এর ভাষায় মিথ্যাবাদী বলে প্রতীয়মান হবেন। মহানবী (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে সে যা-ই শুনবে (সত্যতা যাচাই না করে) তা-ই বর্ণনা করবে। ’ (সহিহ মুসলিম)
সত্যতা যাচাই না করেই ‘ইসলাম প্রচার’ করতে গিয়ে কত বড় গুনাহর ভাগী হয়ে যাচ্ছেন—ফেসবুক ব্যবহারকারীরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন।

No comments:

Post a Comment

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি

সম্পাদকীয় কার্যলয়

Rua padre germano mayar, cristo rio -80040-170 Curitiba, Brazil. Contact: +55 41 30583822 email: worldnewsbbr@gmail.com Website: http://worldnewsbbr.blogspot.com.br

সম্পাদক ও প্রকাশক

Jahangir Alom
Email- worldnewsbb2@gmail.com
worldnewsbbbrazil@gmail.com
 
Blogger Templates