সৈন্যদের ভয়ে সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু গত শুক্রবার শান্তি মিটিং করার কথা বলে গ্রামের সবাইকে ডাকা হয়। সবাই জড়ো হওয়ার পর চারপাশ থেকে সৈন্যরা ঘিরে ফেলে। প্রায় একশ’ নারী-পুরুষ সেখানে ছিল। সৈন্যরা সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে উলঙ্গ করে। তারপর পুরুষদের চোখ কালো কাপড়ে বেঁধে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে থাকে। আর নারীদের ওপর নির্যাতন ও ধর্ষণ চালাতে থাকে। প্রতিবাদ করলে সৈন্যরা গুলি করে। অন্তত ১৫/২০ জন পুরুষ সেখানেই মারা যায়। বাকি পুরুষদের ধরে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। কয়েকজন মেয়েকেও ধরে নিয়ে যায় তারা এ সময়।’
গতকাল রবিবার টেকনাফের লেদা বস্তিতে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের এমন লোমহর্ষক বর্ণনা দেন মিয়ানমারের মংডুর উত্তরাঞ্চল থেকে আসা ছমির আহমদ। তার পাশের গ্রাম হাতিপাড়াতে এ ঘটনা ঘটে বলে জানান তিনি। আর নির্যাতনের ভয়াবহতা দেখে ৫৫ বছরের এই বাবা ছয় সন্তান নিয়ে গত শুক্রবার রাতেই টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। এরপর পাহাড়, প্যারাবন ডিঙ্গিয়ে দুদিন উপোস থেকে গতকাল ভোরে এসে পৌঁছান লেদা বস্তিতে। নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ছমির। তার চোখে মুখে ছিল চাপা আতঙ্ক।
ছমির জানান, সৈন্যরা তার ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। যদিও তার নিজের ও পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে থাকায় নির্যাতন থেকে রেহাই পেয়েছেন। কয়েকদিন ধরে অন্যান্য এলাকায় নির্যাতনের পরিমাণ কমে আসলেও শুক্রবার নতুন করে নির্যাতন শুরু করে তারা। কিশোরী-তরুণীদের গণহারে ধরে নিয়ে যায়। এসময় তারা বলতে থাকে, ‘তোদের বাবারা (যেসব দেশ সহিংসতার প্রতিবাদ জানাচ্ছে) তোদের জন্য কথা বলছে। ওদের এখানে আসতে বল। যতক্ষণ আসবে না ততক্ষণ তোদের নির্যাতন করা হবে।’
সেই হাতিপাড়া থেকে আসা রহমত নামের আরেকজন বলেন, ‘ভেবেছিলাম আপাতত নির্যাতন বন্ধ হবে। কিন্তু শুক্রবার যেভাবে ওই পাড়ায় সৈন্যরা হামলা করেছে সেটা দেখে সেখানে থাকার আর সাহস পাইনি। যেসব পুরুষকে ধরে নেওয়া হয়েছে তারা কেউ আর ফেরত আসেনি। যেকোনো মুহূর্তে সৈন্যদের হাতে ধরা পড়তে পারি। তার চেয়ে এপারে এসে না খেয়ে মরে গেলেও ভালো। আমার দুই মেয়ে ও তিন ছেলের কথা ভেবে চলে এসেছি।’
টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা বস্তি ও বস্তি সংলগ্ন লোকজন জানিয়েছেন, শুক্রবার সেনাবাহিনী নতুন করে নির্যাতন শুরু করার পর রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ নতুন করে বেড়েছে। সর্বশেষ গতকালও লেদা ও কুতুপালং বস্তিতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে নানাপথে শতাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। সীমান্তে কর্মরত একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। যদিও তিনি অনুপ্রবেশের সঠিক সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন।
লেদা বস্তি ও আশপাশের এলাকায় রহমত ও ছমিরের মত আরো অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা হয়। যাদের বেশিরভাগই শনিবার দিবাগত রাত থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এখানে এসে পৌঁছেছেন। তাদের সবারই বক্তব্য প্রায়ই একরকম। তারা বলছেন, গত কয়েকদিনে কিছুটা থেমে থেমে বিচ্ছিন্নভাবে সৈন্যরা আক্রমণ ও নির্যাতন করছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাত ও শুক্রবার থেকে হাতিপাড়া, বড়গজির বিল, খেয়ারীপাড়াসহ বেশকিছু গ্রামে নতুন করে পাশবিক আক্রমণ চালায় মিয়ানমারের সৈন্যরা। অনেক এলাকায় সৈন্যদের সঙ্গে স্থানীয় রাখাইনরাও নির্যাতনে অংশ নিচ্ছে। বিশেষ করে, ১২-৩০ বছরের কোনো মেয়ে নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ওরা ধর্ষণ করতে আসে। রাজি না হলে বুকের ওপর বুট তুলে দিয়ে বুক থেঁতলে দিচ্ছে। বাবা-মা প্রতিবাদ করলে তাদের গুলি করে। ঘরের ভেতরে বেঁধে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারছে। কোল থেকে নিয়ে শিশুদের পর্যন্ত আগুনে নিক্ষেপ করছে সৈন্যরা।
বড়গজির বিল এলাকার গৃহবধূ কুলসুমা অভিযোগ করেন, সৈন্যরা অনেক রাখাইন যুবকের হাতেও অস্ত্র তুলে দিয়েছে। যার ফলে এসব যুবক অস্ত্র নিয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের বাড়ি ডাকাতি করছে। ধান-চাল, গবাদিপশু, নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। কিশোরী-যুবতীদের টানাটানি করছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটতরাজ চালাচ্ছে।
মো. ইদ্রিস নামের একজন রোহিঙ্গা জানান, তার সেখানে পাঁচ বিঘা জমি ছিল, পাঁচটি গরু ছিল, জমিতে অনেক ফসল ছিল। স্থানীয় রাখাইনরা সব দখলে নিয়েছে। গরুগুলো নিয়ে গেছে। এখন তিনি সেখানে আর ফিরতে চান না। এখানে শুধু বেঁচে থাকার সুযোগ চান তিনি।
এদিকে মিয়ানমারের মংডুর উত্তরাংশের গ্রামগুলোতে গত শুক্রবার নতুন করে আক্রমণের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তেমন চোখে না পড়লেও বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম ঢাকা ও মিয়ানমারের কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে এই খবর প্রকাশ করেছে। নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের বক্তব্যের সাথে এই খবরের মিল পাওয়া যাচ্ছে।
গতকাল ভোরে লেদা বস্তিতে পৌঁছানো মো. সৈয়দ জানান, তিনি তার পরিবারসসহ সর্বমোট ২৪ জনকে নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে চেয়েছিলেন। শুক্রবার রাতে রওয়ানা হয়েছিলেন। কিন্তু দালালকে টাকা কম দেওয়ায় তারা টেকনাফের জাডিপাডা সংলগ্ন মিয়ানমার অংশের একটি দ্বীপে রেখে চলে গেছে। এরপর তিনি পরিবারকে রেখে কোনোমতে লেদা বস্তিতে এসেছেন, যাতে তাদের আনার কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন। কিন্তু গতকাল দুপুর পর্যন্ত তিনি কোনো ব্যবস্থা করতে পারেননি। ফলে তার পরিবার ও বাকিরা সেই দ্বীপে অবর্ণনীয় কষ্টে সময় কাটাচ্ছে। অনেকে খাবার ও পানির অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
যদিও বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশসহ সংশ্লিষ্টসূত্রগুলো থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়টি সরাসরি স্বীকার করছে না। তবে একাধিক স্থানীয় সূত্র গতকাল ভোরে লেদা ও কুতুপালং বস্তিতে শতাধিক রোহিঙ্গা নানাভাবে অনুপ্রবেশ করেছে বলে দাবি করেছে। তারা জানান, বিজিবি ও কোস্টগার্ড যেসব রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাচ্ছে তাদের বাইরেই এসব রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করেছে। বিজিবি টেকনাফ ব্যাটালিয়ন-২ এর অধিনায়ক আবুজার আল জাহিদ জানিয়েছেন, শনিবার রাত থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত বিজিবি সদস্যরা রোহিঙ্গাদের বহন করা ৭টি নৌকা নাফ নদীর বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা থেকে ফেরত পাঠিয়েছেন।
টেকনাফ থানার ওসি আবদুল মজিদ জানিয়েছেন, দালালের সহযোগিতায় কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছে। তবে ইতিমধ্যে ১৩ জন দালাল উখিয়া ও টেকনাফ থেকে আটক করা হয়েছে। আরো প্রায় ৩০ জন দালালের তালিকা করা হয়েছে।
আমাদের উখিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা রফিক উদ্দিন বাবুল জানান, প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয়হীন হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু এপারে চলে আসার জন্য সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে অপেক্ষা করছে। এদিকে সেনাদের হাত থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা এক তরুণী (২৪) জানিয়েছেন, ‘বিছানার সঙ্গে ওরা তাদের দুই বোনকে বেঁধে রেখেছিল। এরপর এক এক করে সেনা এসে তাদের ধর্ষণ করেছে।’ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এলেও সেই আতঙ্ক এখনও তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সেনাদের অত্যাচারের বিবরণ দিতে গিয়ে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল ওই তরুণীর মুখ। পাশে বসে ছিল তার আরো দুই ভাই-বোন, তারাও সেনাদের অত্যাচারের সাক্ষী। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে উখিয়ার কুতুপালং বস্তিতে। দুই বোনের সঙ্গে প্রাণ হাতে করে সীমান্ত পেরিয়ে কুতুপালং বস্তিতে এসেছে আব্দুল হাসেম। এখানে অন্তত কেউ তাদের খুন করার চেষ্টা করবে না বা শারীরিকভাবে অত্যাচার করবে না ভেবে যেন কিছু স্বস্তি পাচ্ছে তারা। ওই তরুণীর ছোট বোন (১৭) জানান, মিয়ানমারের কাউয়ারবিল গ্রামে ছিল তাদের বাড়ি। সেখানে হানা দেয় সেনা সদস্যরা। দুই বোনকে পালাক্রমে ধর্ষণের পর তাদের ঘরে আগুন দিয়ে চলে যায় সেনারা। এর আগেই তাদের বাবাকে হত্যা করা হয়। কুতুপালং বস্তিতে আশ্রয় নেওয়া খেয়ারীপ্রাং গ্রামের আলী আহমদ (৬৫) জানান, তার স্ত্রী, পুত্রসহ ৭ সদস্যের মধ্যে ৬ জনের কোন খোঁজ খবর না পেয়ে তিনি একাই ৩দিন পায়ে হেঁটে উনচিপ্রাং সীমান্ত দিয়ে বস্তিতে চলে আসে। তিনি জানান, তার মতো হাজার হাজার রোহিঙ্গা এদেশে আসার জন্য সীমান্তে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। গতকাল সকালে থাইংখালী থেকে কুতুপালং ঘুরে দেখা যায়, বিজিবি সদস্যরা সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে যাত্রীবাহী গাড়ি তল্লাশি করছে।
No comments:
Post a Comment