আমরা সবাই জানি -চারপাশের পরিবেশ ও পরিবার একটা মানুষের চরিত্র গঠনে কতটুকু ভূমিকা রাখে।প্রতিটা মানুষ তার পরিবার , চারপাশের পরিবেশ যেমন -প্রতিবেশী , স্কুল , চলা-ফেরার সাথীদের কাছ থেকে ভালো-মন্দ দুটোই শিখে।তাই যে যে পরিবেশে বেড়ে উঠে তার চরিত্রে সে পরিবেশের প্রতিফলন ঘটে।যেমন-
১। যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক খারাপ থাকে , অনবরত ঝগড়া -ঝাঁটি , চিৎকার চেঁচামেচি লেগেই থাকে সে পরিবারের ছেলেমেয়েরা ভীতু , আত্মবিশ্বাসহীন , বাবা-মায়ে র প্রতি অশ্রদ্ধা নিয়ে বেড়ে উঠে । তারা ভবিষৎতে বাবা-মায়ের সাথে কেমন আচরণ করবে তা সহজেই অনুমেয় এবং তারা যখন সংসারী হবে তারা কখনই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে সফল করতে পারবে না ।
২। একটি বাচ্চা ছেলে যদি তার পরিবারে তার মাকে তার বাবার দ্বারা শারিরীক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হতে এবং তার মাকে এসব সহ্য করে নিতে দেখে বড় হয় তবে সে এটাকেই স্বাভাবিক ব্যাপার বলে ধরে নেয় । পরবর্তীতে সে যখন স্বামী হয় সেও তার স্ত্রীর সাথে একই ব্যবহার করে এবং আশা করে তার মা যেভাবে সব সহ্য করেছে তার স্ত্রীও সেভাবে সহ্য করবে । স্ত্রী যখন প্রতিবাদী হয় তখনই স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালোবাসার বদলে রাগ জন্মে , অথবা সে ভাবতে থাকে তার স্ত্রী বুঝি তাকে ভালোবাসে না ! কারণ সে চায় সবকিছু সহ্য করে স্ত্রী শুধু তাকেই ভালোবাসবে , তার কাছে এটাই নিয়ম !
২। একটি বাচ্চা ছেলে যদি তার পরিবারে তার মাকে তার বাবার দ্বারা শারিরীক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হতে এবং তার মাকে এসব সহ্য করে নিতে দেখে বড় হয় তবে সে এটাকেই স্বাভাবিক ব্যাপার বলে ধরে নেয় । পরবর্তীতে সে যখন স্বামী হয় সেও তার স্ত্রীর সাথে একই ব্যবহার করে এবং আশা করে তার মা যেভাবে সব সহ্য করেছে তার স্ত্রীও সেভাবে সহ্য করবে । স্ত্রী যখন প্রতিবাদী হয় তখনই স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালোবাসার বদলে রাগ জন্মে , অথবা সে ভাবতে থাকে তার স্ত্রী বুঝি তাকে ভালোবাসে না ! কারণ সে চায় সবকিছু সহ্য করে স্ত্রী শুধু তাকেই ভালোবাসবে , তার কাছে এটাই নিয়ম !
আবার সে পরিবারের মেয়েটিও তার মায়ের মতো স্বামীর সমস্ত অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করার মানসিকতা নিয়ে বড় হয়। তার প্রতিবাদ করার সাহস বা স্বাধীনতা মরে যায়।
আবার উল্টো করে বললে যে পরিবারে বাবা-মা একে অপরকে সম্মান করে সে পরিবারের শিশুটি বড় হয়ে তার সঙ্গীকে সম্মান দেখায়।
৩।যে পরিবারে গৃহপরিচারিকা নির্যাতিত হয় সে পরিবারের শিশু বড় হয়ে কাজের মানুষকে নির্যাতন করাকে স্বাভাবিক ভাবে।
আবার উল্টো করে বললে যে পরিবারে বাবা-মা একে অপরকে সম্মান করে সে পরিবারের শিশুটি বড় হয়ে তার সঙ্গীকে সম্মান দেখায়।
৩।যে পরিবারে গৃহপরিচারিকা নির্যাতিত হয় সে পরিবারের শিশু বড় হয়ে কাজের মানুষকে নির্যাতন করাকে স্বাভাবিক ভাবে।
৪।যে ছাত্র শিক্ষকের দ্বারা পিটুনি খেয়ে বড় হয় সে পরবর্তীতে যদি শিক্ষকতা পেশা বেছে নেয় তবে পিটুনি দেয়া শিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে।যেমন-মাদ্রাসায় বেতের বাড়ি সহ যেকোনো শাস্তি গ্রহনযোগ্য।তাই বাসায় পড়াতে আসলেও দেখবেন আরবি শিক্ষকরা অল্পতেই ছোট ছোট বাচ্চাদের গায়ে হাত তুলে ফেলে।মারার জন্য তাদের হাত যেন নিশপিশ করে।
৫।যে পরিবারে অতি কৃপণতা বা অতি খরুচে স্বভাবের বাবা-মা থাকে সে পরিবারের শিশুও সে অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়।
৬।অতি রক্ষণশীল পরিবারের শিশুদের মানসিকতায়ও রক্ষণশীলতার বহি:প্রকাশ ঘটে । আবার অতি আধুনিক পরিবারে বড় হওয়া শিশুদের ক্ষেত্রেও অতি আধুনিকতার প্রকাশ ঘটে।
৭।কথায় আছে -‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস।অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’!
৮।গ্রামে বসবাসকারী পরিবারগুলোর বাচ্চাদের মধ্যে গ্রাম্য স্বভাব , মানসিকতা দেখা যায় । সে বাচ্চা বড় হয়ে যত বড় শহরে পা রাখুক না কেন , যত বড় ডিগ্রীই অর্জন করুক না কেন!
তবে এমনও অনেক উদাহরণ আছে অসুস্থ পারিবারিক পরিবেশে অনেকে বড় হয়েও নিজেকে পরিবার থেকে স্বতন্ত্রভাবে তৈরি করেছে ।যেমন-মাকে নির্যাতিত হতে দেখে মায়ের কষ্টের মাঝে সম্পূর্ণ নারীজাতির কষ্ট উপলব্ধি করে সে তার স্ত্রীকে প্রাপ্য সম্মান দিয়েছে।সে ‘ভুল’কে ‘সঠিক’ হিসেবে গ্রহণ করেনি,’ভুল’কে ভুল হিসেবে গ্রহণ করেছে।
আবার এমন উদাহরণও অনেক আছে যারা সুস্থ পরিবেশে বড় হয়েও অসুস্থ মানসিকতায় নিজেকে তৈরি করেছে
পরিবার হচ্ছে ‘কুমোর ‘আর পরিবারের শিশুটি হচ্ছে ‘কাদামাটি’।পরিবার তার চরিত্রকে যে রূপ বা আকৃতি দিবে সে ঠিক সে রূপেই পরিণত হবে।একেই বলে ‘পরওয়ারিশ’!
‘সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে
গুণবান পতি যদি থকে তার সনে’।
কবি নিশ্চয়ই বলতে চেয়েছেন -সংসার সুখের করার জন্য পতি ও পত্নী উভয়েরই অবদান থাকা জরুরী।তাই দ্বিতীয় লাইনটা ছাড়া প্রথম লাইনটা অসম্পূর্ণ ও আধা সত্য।
বেগম রোকেয়া বলেছিলেন ‘ একটি গাড়ির দুটি চাকা , গাড়ি চলতে হলে চাকা দুটোকে সমান হতে হবে । একটি চাকা বড় এবং একটি চাকা ছোট হলে গাড়ি চলবেনা । নারী পুরুষের বেলায়ও তাই।’ একটি সংসার সুখের হওয়ার জন্য কি প্রয়োজন? আবেগী কেউ হয়তো বলবেন ভালোবাসা ? বাস্তববাদীরা হয়তো বলবেন টাকা ! শুধু ভালোবাসায় যেমন পেট ভরে না তেমনি টাকা দিয়েও সুখ বা শান্তি কেনা যায় না।
ধরুন। একটি সংসারে ভালোবাসা ও সচ্ছলতা দুটোই আছে ! তবুও সে সংসারে সুখ থাকে না কেন ?
উত্তর কি ? এডজাস্টমেন্টের সমস্যা বা মতের অমিল অথবা বোঝাপড়ার অভাব !
ভাইয়ে-ভাইয়ে , বোনে-বোনে , বাবা-ছেলে , মা-মেয়ের মতের অমিল হতে পারলে স্বামী-স্ত্রীতে হবে না কেন ?
ভিন্ন ভিন্ন পরিবারে বড় হওয়া মানুষগুলোই আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।এদের মধ্য থেকেই আমরা আমাদের জীবনসঙ্গী খুঁজে নেই।তাই মতের অমিল হওয়াটা কী অস্বাভাবিক কিছু? যেমন ধরুন-অতি আধুনিক স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে এবং গ্রাম থেকে উঠে আসা শিক্ষিত , ভালো চাকুরী করে এমন ছেলের মধ্যে যদি বিয়ে হয় এডজাস্টমেন্টে প্রব্লেম হওয়াটাই স্বাবাভাবিক ।সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন পরিবেশ থেকে এসে যখন দুটি মানুষ এক হয় তাদের মধ্যে ভালোবাসাতো তৈরি হয়ে যায় কিন্তু সব বিষয়ে মতের মিল হয় না ! যখন একটা মানুষ আরেকটা মানুষের প্রেমে পড়ে তখন তার অনেক বাজে অভ্যাসও অগ্রাহ্য করে ফেলে। প্রেম অন্ধ বলেই হয়তো !! কিন্তু যখন তারা সংসার জীবনে প্রবেশ করে তখন তিলকে তাল বানাতে বেশিক্ষণ সময় লাগেনা।
বিয়ের প্রথম দু’এক বছর হেসে-খেলে,আনন্দে কেটে যায়।সেই সময়ে একজনকে আরেকজনের যতটুকু জানা হয় মনে হতে পারে সেটাই পুরোপুরি জানা।কিন্তু না!সেই সময়টায় শুধু সঙ্গীর অভ্যাস,পছন্দ-অপছন্দের জিনিসের নামগুলোই জানা যায়।যত দিন যায় একটু একটু করে একজন আরেকজনকে জানার পাশাপাশি বুঝতে শিখে আর এমনিভাবে সম্পর্ক পরিণত ও পরিপক্কতা লাভ করে।মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে মনের পরিপক্কতা যেমন আসে তেমনি সম্পর্কের বয়সের বেলায়ও তাই।শুনেছি -একটা মানুষকে জানার জন্য একটা পুরো জীবনও নাকি কম হয়ে যায়।।বুঝুন -মানুষের মন কতটা জটিল!অর্থাৎ সম্পর্কের শুধু আনন্দের সময়টায় থেকে যেমন দু:খ উপলব্ধি করা যায় না তেমনি শুধু দু:খের সময়টাতে থেকেও সুখটাকে উপলব্ধি করা যায় না।তাই সম্পর্কটাকে টাইম ও স্পেস দুটোই দিতে হয়।
প্রত্যেকটা মানুষ একজন আরেকজন থেকে আলাদা।একই বস্তু একেকজন একেকরকম দৃষ্টি দিয়ে দেখে।তিন অন্ধের হাতি দেখার গল্পেটা নিশ্চয়ই জানেন।যে যার জায়গা থেকে রাইট।তাই সঙ্গী যখন আপনার বিরুদ্ধে মত দিবে তখন আপনার উচিত একবার হলেও তার দৃষ্টিভঙ্গিতে সেই জিনিস বিচার করে দেখা।
অনেককে রাগ করে বলতে শুনি ‘কোন কিছুতেই তার সাথে আমার ম্যাচ হয় না।জীবনতো একটাই কেন সমঝোতা করে জীবন পাড় করবো?’
শার্টের সাথে টাই ম্যাচ করেন ,সালোয়ার কামিজের সাথে ওড়না ম্যাচ করেন ! সবই কি সেইম কালারের ? সব সময় কি সব একই রঙের ভালো লাগে ! ভিন্ন ভিন্ন রঙে কনট্রাস্ট করেন না ! সব একই রঙের চেয়ে কনট্রাস্ট করাটাই মানুষের কাছে এতো জনপ্রিয় কেন ? চুম্বক কেন বিপরীত ধর্মকে আকর্ষণ করে?
আপনি সিরিয়াস টাইপ , আপনার সঙ্গীও তাই , জীবনে কিছু হিসাব ছাড়া আনন্দ উপভোগ করা হবে আপনার ? আপনি বদমেজাজী আপনার সঙ্গীও তাই , আপনাদের সংসারে শান্তি থাকবে ? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেন তো ! বরং দুজন দুরকম হলে একজন আরেকজনকে বুঝতে গিয়ে একগেয়েমী জীবন থেকে দূর হয়ে যায়।তাই হয়তো আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই আমাদের জুড়ি উপর থেকে তৈরি করে দেন।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শুধু সন্তান জন্ম দেয়া আর এক ছাদের নিচে থাকা নয়।এক ছাদের নিচে থাকাটা ঘর বা আশ্রয় হতে পারে সংসার হতে পারে না । সংসার নামক দীর্ঘ পথ আগে-পিছে থেকে পাড়ি দেয়া যায় না , পাশাপাশি হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয় । স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এতো মজবুত না যে দিনের পর দিন একজনের ভুল আরেকজন সহ্য করে নিয়ে একসাথে থেকে যাবে। আবার এতো বেশি নাজুকও না যে একজনের সামান্য একটু ভুলেই সম্পর্কের ইতি ঘটে যেতে পারে । শুধুমাত্র সন্তানের সাথে পিতমাতার সম্পর্ক ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো সম্পর্ক চিরস্থায়ী না।সুতরাং সম্পর্ককে দুইদিক থেকেই যত্ন করতে হয়।সম্পর্কটাকে সুপ্ত একটা বীজ থেকে সবে অংকুরিত চারা বলা যায়। যাকে যত্ন করে জাগিয়ে ঠিক সময়মতো পানি , নিড়ানি দিতে হয়।তবেই পাতা বের হয়ে সে , গাছে পরিণত হতে থাকবে। সময়ের আবর্তনে একসময় সে গাছে ফুল , ফল দুইই আসবে।সম্পর্ক নামক চারা গাছের বাগানের নাম হচ্ছে সংসার । আর এ বাগানের মালি একজন নয় , দুজন।
সংসার সুখের করার জন্য দরকার:
পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস,ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ধরে রাখা।
প্রয়োজন ইগো বিসর্জন দেওয়া।অনেকে ইগোকে আত্মসম্মানের নাম দিয়ে থাকেন।ইগোকে আত্মসম্মানের সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না।দুটো দুই জিনিস।
একে অপরকে বুঝতে চাওয়ার ইচ্ছা অর্থাৎ বোঝাপড়া
ক্ষমা করার মানসিকতা (সঙ্গী কখনো ভুল করলে তাকে একবার সুযোগ দিয়ে দেখুন হয়তো সে আগের থেকেও ভালো হয়ে আপনার কাছে আসবে)
উভয় উভয়ের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা।
এক সঙ্গীতে সন্তুষ্ট থাকার চেস্টা।
চাওয়া-পাওয়ার হিসাবে নমনীয়তা
জীবন তো মানুষের একটাই।এই ছোট্ট জীবনটা ঝগড়া-ঝাঁটি করে কাটিয়ে লাভ কী ? ‘আমার একটু স্যাক্রিফাইস যদি আমার সংসারে সুখ আনে তবে আমি তাই করবো’-এই মনোভাব দুজনে সমানভাবে পোষণ করুন।সংসারজীবন সুখী করার জন্য দুজনেই সমানভাবে অংশগ্রহণ করুন।আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে সন্তানদের বড় হতে সাহায্য করুন।
No comments:
Post a Comment