দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনের প্রথম উদ্যোগেই হোঁচট খেয়েছে নির্বাচন কমিশন। নিবন্ধিত ৪০টি দলের মধ্যে মাত্র ১২টি দল দলীয় মনোনয়ন দেয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্তদের নমুনা স্বাক্ষর সংবলিত চিঠি নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছে। বাকি ২৮টি দলের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত নেতার তালিকা দেয়ার শেষ দিনে গতকাল এসব দলের পক্ষ থেকে কোনো চিঠি পায়নি নির্বাচন কমিশন। কমিশন সূত্র বলছে, যেহেতু নির্ধারিত দিনে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্তদের নামের তালিকা পাঠানো হয়নি, তাই ওইসব দলের নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়টিও স্পষ্ট নয়। তবে নির্ধারিত দিনের পরে নাম জমা দেয়া যাবে কিনা বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম জমা না দিলেও প্রার্থী দেয়া যাবে কিনা এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। যেসব দল নাম জমা দেয়নি তারা বলছে নির্বাচন কমিশন থেকে বিষয়টি সময়মতো তাদের জানানো হয়নি। এ কারণে তারা নাম জমা দিতে পারেনি। এখন দলের প্রার্থী কে মনোনয়ন দেবে বা আদৌ দিতে পারবেন কিনা এ বিষয়ে তারা নিজেরাও অন্ধকারে রয়েছেন। স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার বিধি এবারই নতুন করে করা হয়েছে। এ বিধি সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোরও স্পষ্ট ধারণা নেই। এ বিধি করার আগে নির্বাচন কমিশন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও আলোচনা করেনি।
আগামী ৩০শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য দেশের ২৩৬টি পৌরসভায় ভোট গ্রহণের দিন ধার্য করেছে নির্বাচন কমিশন। ২৪শে নভেম্বর পৌরসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই দলগুলোকে একক প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার বিধান উল্লেখ করে চিঠি দেয় ইসি। নতুন বিধি অনুযায়ী, দলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক/সমপদাধিকারী/ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রত্যয়নে দলকে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে। ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ২৮শে নভেম্বরের মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ইসিকে দলের চিঠি দেয়ার কথা বলা হয়। সে হিসেবে ওই নাম জমা দেয়ার শেষ দিন ছিল গতকাল। প্রথমবারের মতো দলভিত্তিক পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে দল মনোনীত প্রার্থী ছাড়াও দলীয় প্রত্যয়নের পাশাপাশি ১০০ ভোটারের সমর্থন তালিকা দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, এমনিতেই সময় কম দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আবার শুক্র ও শনিবার পড়েছে। তাই অনেক দল সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, আইনে যা বলা আছে, তাই হবে।
এদিকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করবেন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজেই। গতকাল নির্বাচন কমিশনে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠি দেয়ার পর সহ-সম্পাদক এবিএম রিয়াজুল করিম কাওছার বলেন, দল মনোনীত প্রার্থীরা দলীয় প্রধানের স্বাক্ষরে প্রত্যয়ন পেলে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, যা দলীয় প্রার্থী, নেতাকর্মী, সমর্থক ও ভোটারদের উজ্জীবিত করবে।
এদিকে গতকাল বেলা ১২টায় বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব মো. শাহজানকে মনোনয়ন দেয়ার ক্ষমতা দিয়ে তার নমুনা স্বাক্ষর জমা দেয় দলের একটি প্রতিনিধি দল। এ সময় দলটির যুগ্ম-প্রচার সম্পাদক ইমরান সালেহ প্রিন্স সাংবাদিকদের জানান, ইসি চাইলে নির্বাচন পেছাতে পারে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, নিয়মানুযায়ী তফসিল ঘোষণার পর থেকে ছুটির দিনেও কমিশন খোলার থাকার কথা। কিন্তু এখানে এসে তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি। বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, ইসি বিএনপির বক্তব্যগুলো আমলে নিচ্ছে না।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদও নিজেই চূড়ান্ত করবেন প্রার্থীদের প্রত্যয়নপত্র। একইভাবে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সাধারণ সম্পাদক শরীফ নুরুল আম্বিয়া, জাতীয় পার্টি-জেপির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম নিজেদের দলের মনোনীতদের প্রত্যয়নকারী হিসেবে থাকছেন। এছাড়া বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, এনপিপির চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নীলু ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির মহাসচিব সাইফুল হক নিজ দলের মনোনীত প্রার্থীদের প্রত্যয়ন করবেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব ইউনুছ আহমদ দলটির মনোনীত প্রার্থী প্রত্যয়ন করবেন। পিডিপি ও বিএনএফও তাদের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম জমা দিয়েছে।
যে ২৮টি দল নমুনা স্বাক্ষর জমা দেয়নি, সেগুলো হলো- কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, এলডিপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), গণফোরাম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, জাকের পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, গণফ্রন্ট, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি), বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, জাতীয় গণতান্ত্রিক পাটি (জাগপা), খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (মুক্তিজোট)।
ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম জমা না দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বীর প্রতীক বলেন, নির্বাচন কমিশন আমাদের যথেষ্ট সময় দেয়নি। তাই আমরা পেরে উঠতে পারিনি।
জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন জানান, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে আমরা কোনো চিঠিই পাইনি। তাই আমরা তারিখ হিসাব করতে ভুল করেছি। এখন দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবো কিনা এ বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারছি না।
ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ জানান, ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম ও নমুনা স্বাক্ষর জমা দেয়ার বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। শনিবার বিকালে নির্বাচন কমিশন থেকে বিষয়টি আমাদের জানানো হয়। এ কারণে আমরা এর কোনো জবাব দিতে পারিনি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে তারা নির্বাচন কমিশনের কোনো চিঠি পাননি। তাই জবাব দিতে পারেননি।
আগামী ৩০শে ডিসেম্বর ভোট গ্রহণের দিন ধার্য করে গত মঙ্গলবার দেশের ২৩৪টি পৌরসভার তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এরপর আরও দুটি পৌরসভা তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করে ইসি। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনের এটাই প্রথম ধাপ। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন ৩রা ডিসেম্বর। মনোনয়নপত্র বাছাই ৫ ও ৬ই ডিসেম্বর। এছাড়া মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৩ই ডিসেম্বর। এদিকে তফসিল ঘোষণার পর সময় পেছানোর দাবি জানায় বিএনপি ও সরকারের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সময় না পেছানোর সিদ্ধান্তে অবস্থান নেয়। গত ১৮ই নভেম্বর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ রেখে কয়েকটি বিল পাস করা হয় সংসদে। গত ১২ই অক্টোবর স্থানীয় সরকার নির্বাচন (সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউপি) সংশোধন আইন অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এর ফলে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল দলীয় প্রতীক নিয়ে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে। যদিও নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থীরা নির্দলীয় লড়াইয়ে থাকছেন।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment