‘লাব্বাইক, আলাহুম্মা! লাব্বাইক! লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হা’মদা ওয়াননি’ মাতা লাকা ওয়ালমুলক লা শারিকা লাক..মধুরধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে পবিত্র আরাফাতের পাহাড় ঘেরা ময়দান ছাপিয়ে আকাশ-বাতাস মুখর ও প্রকম্পিত এখন। উচ্চকণ্ঠ নিনাদের তালবিয়ায় মহান আল্লাহ তায়ালার একত্ব শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের কথা বিঘোষিত হচ্ছে প্রতিক্ষণ। ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির। তোমার কোনো শরিক নেই।
সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধুই তোমার। সাম্রাজ্য তোমার। তোমার কোনো শরিক নেই।’ শুরু হলো বিশ্ব মুসলিমের মহাসম্মিলন পবিত্র হজ। আদিগন্ত মরুপ্রান্তর এক অলৌকিক পুণ্যময় শুভ্রতায় ভরে উঠেছে। সফেদ-শুভ্র দুই খণ্ড কাপড়ের এহরাম পরিহিত হাজিদের অবস্থানের কারণে সাদা আর সাদায় একাকার। পাপমুক্তি আর আত্মশুদ্ধির আকুল বাসনায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ এই পবিত্র হজ পালন করছেন।
আজ ফজরের পর গোটা দুনিয়া থেকে আগত ২০ লক্ষাধিক মুসলমান ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হয়েছেন। এখানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকবেন তারা। আরাফাত ময়দানের মসজিদে নামিরায় জোহরের নামাজের আগে খুতবা পাঠ করবেন মক্কার গ্র্যান্ড ইমাম। খুতবা পাঠশেষে জোহর ও আছরের ওয়াক্তের মাঝামাঝি সময়ে হাজিরা জামায়াতের সাথে কছর নামাজ আদায় করবেন। সূর্যাস্ত পর্যন্ত তারা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে আল্লাহ তা’আলার জিকির-আসকার ইবাদতে মশগুল থাকবেন। অতঃপর মুযদালিফার উদ্দেশে আরাফার ময়দান ত্যাগ করবেন এবং মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশা’র নামাজ এশা’র ওয়াক্তে একত্রে পড়বেন এবং সমস্ত রাত অবস্থান করবেন। মীনায় জামরাতে নিক্ষেপ করার জন্য ৭০টি কংকর এখান থেকে সংগ্রহ করবেন। মুজদালিফায় ফজরের নামাজ পড়ে মীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। ১০ জিলহজ মীনায় পৌঁছার পর হাজিদের পর্যায়ক্রমে চারটি কাজ সম্পন্ন করতে হয়। প্রথমে মীনাকে ডানদিকে রেখে হাজিরা দাঁড়িয়ে শয়তানকে (জামারা) পাথর নিক্ষেপ করবেন। দ্বিতীয় কাজ আল্লাহর উদ্দেশে পশু কোরবানি করা। অনেকেই মীনায় না পারলে মক্কায় ফিরে গিয়ে পশু কোরবানি দেন। তৃতীয় পর্বে মাথা কামানো। চতুর্থ কাজ তাওয়াফে জিয়ারত। হাজিরা মক্কায় ফিরে ক্বাবা শরীফ ‘তাওয়াফ’ ও ‘সাঈ’ (ক্বাবার চারদিকে সাতবার ঘোরা ও সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দৌড়ানো) করে আবার মীনায় ফিরে যাবেন।
জিলহজের ১১ তারিখ মীনায় রাত যাপন করে দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে হাজিরা বড়, মধ্যম ও ছোট শয়তানের উপর সাতটি করে পাথর নিক্ষেপ করবেন। এ কাজটি করা সুন্নত। পরদিন ১২ জিলহজ মীনায় অবস্থান করে পুনরায় একইভাবে হাজিরা তিনটি শয়তানের উপর পাথর নিক্ষেপ করবেন। শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা শেষ হলে অনেকে সূর্যাস্তের আগেই মীনা ছেড়ে মক্কায় চলে যান। আর মক্কায় পৌঁছার পর হাজিদের একটি কাজ অবশিষ্ট থাকে। সেটি হচ্ছে ক্বাবা শরীফ তাওয়াফ করা। একে বলে বিদায়ী তাওয়াফ। স্থানীয়রা ছাড়া বিদায়ী তাওয়াফ অর্থাত্ ক্বাবা শরিফে পুনরায় সাতবার চক্কর দেওয়ার মাধ্যমে হাজিরা সম্পন্ন করবেন পবিত্র হজব্রত পালন।
গতকাল শনিবার সারাদিন এবং গতরাতে হজযাত্রীরা মীনায় অবস্থান করেন। সেখানেই শুরু হয় পবিত্র হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা। শুক্রবার জুমার নামাজ আদায়ের পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যাওয়া ১৩ লাখ ২৩ হাজার ৫২০ জন মক্কা নগরী থেকে হেঁটে, বাসে করে মীনায় পৌঁছেন। প্রতি বছর হজের সময় মুসলিমদের অস্থায়ী আবাস হিসেবে মীনায় বসানো হয় লাখ লাখ তাঁবু। এবারও এক লাখ ৬ হাজার তাঁবুর নীচে প্রায় ১৪৪ ঘণ্টা অবস্থান করবেন বিভিন্ন দেশ থেকে আসা হজযাত্রীরা। পবিত্র মসজিদুল হারাম থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরের মীনা যেন তাঁবুর শহর। যেদিকে চোখ যায়, তাঁবু আর তাঁবু। তাঁবুতে প্রত্যেকের জন্য আলাদা ফোম, বালিশ, কম্বল বরাদ্দ। ফোমের নীচে বালু। মীনায় অবস্থান করা হজের অংশ। হজযাত্রীরা নিজ নিজ তাঁবুতে নামাজ আদায় ও অন্যান্য ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকেন। পবিত্র হজ উপলক্ষে মক্কা, মদীনা, মীনা, আরাফাত ময়দান, মুজদালিফা ও এর আশে-পাশের এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে সৌদি সরকার। মোতায়েন আছে এক লাখের বেশি নিরাপত্তাকর্মী।
পদত্যাগ করলেন সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি আবদুল আজিজ
আরাফার দিন হজের খুতবা প্রদান ও নামিরা মসজিদে ইমামতি থেকে পদত্যাগ করেছেন সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আল শায়খ।
তিনি ১৯৮১ সাল থেকে দীর্ঘ ৩৫ বছর যাবত্ হজের খুতবা দিয়ে আসছিলেন। স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গতকাল শনিবার সৌদি আরবের জাতীয় দৈনিক ‘ওকাজ’ এ খবর জানিয়েছে। ‘ওকাজ’ জানায়, গ্র্যান্ড মসজিদের ইমাম মুফতি সালিহ বিন হুমাইদ গ্র্যান্ড মুফতি আবদুল আজিজের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন। বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে ‘ওকাজ’ জানায়, হুমাইদ ছাড়াও গ্র্যান্ড মুফতি নির্বাচনে দু’জনের নাম শোনা যাচ্ছে। তারা হলেন- ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স মিনিস্টার শায়খ সালিহ আল-আশ শায়খ ও দুই পবিত্র মসজিদের প্রেসিডেন্সি চেয়ারম্যান গ্র্যান্ড মসজিদের ইমাম শায়খ আবদুর রহমান আস সুদাইস।
No comments:
Post a Comment