(কে এই মহাত্মা গ্লাউবার রোসা? এক কথায় ব্রাজিলের প্রভাবশালী চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা ও লেখক। তাঁর একটি বিখ্যাত ছবি ‘কালো ঈশ্বর, সাদা শয়তান’ (১৯৬৪)। রোসা জন্মেছেন ১৯৩৯ সালের ১৪ মার্চ আর ইন্তেকাল করেছেন ১৯৮১ সালের ২২ আগস্ট। তাঁর কর্মকালের সোনালি সময় ১৯৫৯ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। এই সময়কালে তিনি পুঁজিবাদের ধ্বংস ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার খোয়াব দেখেছেন। ব্রাজিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন সিনেমা নভো আন্দোলনের। মহাত্মা রোসা বলতেন, শিল্প শুদ্ধ মেধা নয়, সাহস তার বড় সহায়। কেবল ব্রাজিল নয়, পুরো লাতিন আমেরিকা এমনকি সারা বিশ্বের চলচ্চিত্র নির্মাতা ও তাত্ত্বিকদের কাছে এই রোসা দরিয়া-সমান। সিনেমা নভোকে রোসা মনে করতেন ব্রাজিলের আন্তর্জাতিক জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের এক সৃষ্টিশীল সংশ্লেষণ (Creative Synthesis)| ব্রাজিলের ইউটোপিয়ার লগেই এই সিনেমা নভোর বাস। হয়ত এর রূপ কদাকার, নোংরা, অসামঞ্জস্যপূর্ণ, গোলমেলে এবং বিশৃঙ্খল। তারপরও রোসা বলতেন এই সিনেমা নভো সুন্দর, ঝকঝকে আর বিপ্লবী। বলে রাখি সিনেমা নভো মানে নতুন সিনেমা। এটা একটা সিনেমা আন্দোলন অন্য ভাষায় বলতে পারেন চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে শ্রেণি সংগ্রাম। তো লাতিন আমেরিকায় এই আন্দোলন বেগবান থাকে গত শতাব্দির ছয় ও সাতের দশক পর্যন্ত। চলচ্চিত্র ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন নিয়ে ঐতিহাসিক গুরু গ্লাউবার রোসা বর্তমান প্রবন্ধটি রচনা করেন এবং এটি প্রকাশ পায় ১৯৬৯ সালে। আমি এই লেখা ভাষান্তর করেছি জন ডেভিসের ইংরেজি অনুবাদ থেকে। লেখাটির ইংরেজি শিরোনাম ‘সিনেমা নভোর ইতিহাস’ তবে বাংলায় ‘ব্রাজিলের চলচ্চিত্রে সংকট’ কথাটি নতুন যোগ করা হয়েছে। ভাষান্তরিত রচনার মাঝে বন্ধনীর ভেতর ইটালিক হরফে লেখাগুলো আমার মন্তব্য। -অনুবাদক)
এই দুনিয়ায় মাতব্বরি করে প্রযুক্তি, এখানে এমন কোনো বান্দা নেই, যিনি প্রযুক্তিনির্ভর সিনেমার প্রভাবকে পাশ কাটাতে পেরেছেন। এমনকি যিনি সিনেমায় কোনোভাবে শরিক হননি কোনোদিন, তিনিও সিনেমার দ্বারা প্রভাবিত। জাতীয় সংস্কৃতি বহু কায়দা করেও প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেনি, বিশেষ নৈতিকতা বা এমনতর কোনো কিছুই তেমন কাজে আসেনি, অপ্রতিরুদ্ধভাবে একটা কাল্পনিক জগতের প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়েছে আর তা যোগান দিয়েছে কল্পনার সিনেমা।
যখন কেউ সিনেমা নিয়ে বাৎচিত করেন, যেমন আমেরিকার সিনেমা নিয়ে অনেকে কথা বলতে পারেন। আমেরিকার সিনেমার প্রভাব নিয়ে। এই সিনেমা পুরো দুনিয়ায় আমেরিকার সংস্কৃতির একটা আক্রমণাত্মক ও সর্বব্যাপী চেহারা। এর প্রভাব খোদ মার্কিনীদেরই এমনভাবে প্রভাবিত করছে যে, অবস্থা জানাবুঝা সত্ত্বেও ওই জনগণ চায় নিজেদের পছন্দের ইমেজই যোগান দিক সিনেমা।
যখন কেউ সিনেমা নিয়ে বাৎচিত করেন, যেমন আমেরিকার সিনেমা নিয়ে অনেকে কথা বলতে পারেন। আমেরিকার সিনেমার প্রভাব নিয়ে। এই সিনেমা পুরো দুনিয়ায় আমেরিকার সংস্কৃতির একটা আক্রমণাত্মক ও সর্বব্যাপী চেহারা। এর প্রভাব খোদ মার্কিনীদেরই এমনভাবে প্রভাবিত করছে যে, অবস্থা জানাবুঝা সত্ত্বেও ওই জনগণ চায় নিজেদের পছন্দের ইমেজই যোগান দিক সিনেমা।
আর এই কারণেই হলিউডের বাইরে বানানো সব ছবির আলোচনা বিসমিল্লাহ করা উচিত হলিউড দিয়ে, আর ব্রাজিলের সিনেমার জন্য তো এটা ফরজ। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ইউরোপের চেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি হওয়ায় আমাদের মানুষজন আমেরিকান সিনেমার ভেতর দিয়েই নিজেদের জীবনের ইমেজ তৈরি করেছে। সেজন্য যখনই কোনো ব্রাজিলিয়ান ছবি বানাতে যান, তিনি চিন্তা করেন আমেরিকার মতো চলচ্চিত্র বানাবেন, আর সেটা করাটা জরুরি কারণ ব্রাজিলের লোকজন চায় তাদের ব্রাজিলের মুভিগুলা হবে ‘আমেরিকান মার্কা’ ব্রাজিলিয়ান মুভি। যদি কোনো ছবি আমেরিকান মার্কা না হয়, শুদ্ধ ব্রাজিলিয়ান হওয়ার দোষে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নেয়, হতাশ হয়। দর্শক গ্রহণ করতে পারে না যে, একজন ব্রাজিলের নির্মাতার মধ্যে ব্রাজিলের ছাপ থাকবে, কারণ ওই ছাপ বা ইমেজ হলিউডের মুভিতে দেখা উন্নত প্রযুক্তি ও মার্কিনীদের সাপ্লাই করা আদর্শ দুনিয়ার যে নৈতিকতার ইমেজ, তার সঙ্গে মেলে না।
কাজেই সহজেই ধরা পড়ছে কোন ধরনের ব্রাজিলিয়ান ফিল্ম দর্শকপ্রিয় হচ্ছে। সেগুলোই হচ্ছে যেগুলো কি না জাতীয় ভাবধারার ধ্বজা ধরে আছে ঠিকই, সঙ্গে আবার আমেরিকান চলচ্চিত্রের কৌশল ও শিল্পকে নকল করছে। দুটি আবশ্যিক উদাহরণ হলো, লিমা ব্যারেতোর সিনেমা O Cangaceiro (1953)এবং রবার্ট ফারিয়াসের O Assalto ao Trem Pagador (লোকাল ট্রেনে বেইজ্জতি,1953)।
O Cangaceiro,এর প্লট নেওয়া হয়েছে আমেরিকান ওয়েস্টার্ন থেকে এবং সেই প্লটকে ঢেলে সাজানো হয়েছে cangaco১ অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে। এটা করতে গিয়ে সেরতাওয়ের (ব্রাজিলের একটি অঞ্চল) সামাজিক জীবনটাই যেন গায়েব আর পশ্চিমা ঐতিহ্যের অনুসরণ, ঐতিহ্য বলতে পশ্চিমা যেসব চিত্র আমাদের মগজে ছাপ মারা রয়েছে : লম্বা চুল, ল্যান্ডস্কেপের বাড়াবাড়ি, আগ্নেয়াস্ত্র, ঘোড়া (এমনকি এটা জানা সত্ত্বেও যে cangaceiros২ কালেভদ্রে ঘোড়ার পিঠে চড়তেন), সংগীত, স্থানীয় নৃত্য ইত্যাদি। চলচ্চিত্রের কাহিনি মনে রাখার জন্য খাসা বটে, চারটা লোক, তাদের মধ্যে একদল ভালো, অন্য দলটি বদ। কম বয়সী স্কুলশিক্ষিকাকে নিয়ে থিওডোর(Teodor) চম্পট দেওয়ার পর থেকেই দর্শক দেখতে থাকে সেই পুরনো ছকের পুনরাবৃত্তি, মানে ভালোর দল ছুটছে, আর পেছন পেছন ধাওয়া করছে বদমাশ। শেষাঙ্কে যথারীতি স্কুলশিক্ষিকা, যিনি পূতঃপবিত্র, তিনি রক্ষা পান। আর থিওডোর, পয়লা যে কি না ছিল বদ, ভালোর কোনো লক্ষণই ছিল না তার মধ্যে, সেই শেষবেলা পরপাড়ে যায় বীরের মতো। মারা যাওয়ার সময় জাতীয়তাবাদের এক নিদর্শনও রাখে সে, চুম্বন করে মাটি, মাতৃভূমিকে। এই চলচ্চিত্রের কৌশল পুরোটাই চালান হয়েছে আমেরিকার ছবিগুলো থেকে। চরিত্র বিশ্লেষণ করার জন্য ক্যামেরা স্থির থাকেনি।
দেখেই বোঝা যায় এসব ছবির বাস্তবতা কতটা অবাস্তব। ক্যানগাচোর যেমন দুনিয়া তুলে ধরা হয়েছে বা বলা ভালো যে ভ্রম তৈরি করা হয়েছে সেটার সঙ্গে মিল রয়েছে টেক্সাসের অপরাধ জগৎ নিয়ে যে ভ্রম ফিল্মে দেখা যায় সেটার সঙ্গে। শত শত কাউবয় মার্কা ছবি দেখতে দেখতে বড় হওয়ায় ওই বিশেষ ধারাটাকে গভীর দৃষ্টিতে দেখার আলাদা তাগিদ অনুভব করেনি জনগণ। তারা দেশের মাটিতেও ওই রকম জিনিস দেখতে চেয়েছে এই প্রত্যাশাকে বলতে পারেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে চাওয়া। ফলে নির্মাতারাও ভেবেছেন ওয়েস্টার্ন ছবির মতো কিছু একটা বানাতে পারলে জাতে ওঠা যাবে।
নকল করা অসম্ভব কিছু নয়, নকল ভালো হলে তৃপ্তিও পাওয়া যায়, তবে এর বিপরীতে কোনো চলচ্চিত্র যদি দেখাতে চায় যে ব্রাজিল যুক্তরাষ্ট্র নয় তাহলে পাবলিক ঠিক গ্রহণ করবে না সেটাই স্বাভাবিক। কোনো চলচ্চিত্র যদি ভিন্ন মাত্রার দ্বন্দ্ব উপস্থাপন করে ও ভিন্ন আঙ্গিকের ভাষা ব্যবহার জারি রাখে তাহলে সেটা অগ্রহণযোগ্যই হবে পশ্চিমা কাউবয়ে অভ্যস্ত দর্শকের কাছে।
এবার আসা যাক গোয়েন্দা জঁরার চলচ্চিত্রে। O Assalto ao Trem Pagador ছবিতে আমেরিকান ‘গ্যাংস্টার’ ছবির অনেক উপাদান নকল করা হয়েছে। যেহেতু ওয়েস্টার্নের চেয়ে গোয়েন্দা ঘরানা অনেক বেশি বাস্তব ঘেঁষা, সেই কারণে গোয়েন্দা কিসিমের চলচ্চিত্রে সামাজিক বক্তব্যও উঠে আসে বেশি বেশি। আর এ কারণেই রবার্তো ফারিয়াসের চলচ্চিত্র অর্জন করেছে এক অন্য সাংস্কৃতিক স্তর। গোয়েন্দা ঘরানার ছবিতে যে ধরনের ‘উৎকণ্ঠা’ আমদানি করা, সেসব মৌলিক কৌশল এড়িয়ে যায় না ফারিয়াসের চলচ্চিত্র, সবই অবশ্য থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।
এই একই রবার্তো ফারিয়াস মতিস্থির করলেন ভিন্ন চলচ্চিত্রে তিনি এক সামাজিক প্রশ্নের মোকাবিলা করবেন। ফারিয়াস বানালেন Selva tragica (শোকাবহ বন, ১৯৪৬), সেখানে তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করলেন নিজেকে আমেরিকান ফর্মুলা থেকে মুক্ত করতে। এজন্য তিনি মধ্য ব্রাজিলের দাস সমস্যাকে বিদ্ধ করলেন। শ্রেণি বিভক্ত সমাজকে তিনি ভাগ করলেন ‘ভালো’ ও ‘খারাপ’ এই দুই দলে এবং করার চেষ্টা করলেন গভীর বিশ্লেষণ। একটা জটিল কাঠামোর ভেতর প্রবেশ এবং যে ভাষা এই চলচ্চিত্রে খাটে তেমন এক ভাষাকে আয়ত্ত করার চেষ্টা করে এমন এক ছবি বানালেন যেটা ওই সময়ে বিচ্ছিন্ন কাজ বলে মনে হয়েছে। তাঁর অন্য কাজের থেকে বিচ্ছিন্ন এই ছবি আর যাই হোক অনেক বেশি বাস্তবসম্মত ও জাতীয় বলে মনে হয়েছে, অন্তত O Assalto ao Trem Pagador ছবির জন্য গৃহীত বদ্ধ ও পূর্বনির্ধারিত সূত্রের চেয়ে।
এই একই রবার্তো ফারিয়াস মতিস্থির করলেন ভিন্ন চলচ্চিত্রে তিনি এক সামাজিক প্রশ্নের মোকাবিলা করবেন। ফারিয়াস বানালেন Selva tragica (শোকাবহ বন, ১৯৪৬), সেখানে তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করলেন নিজেকে আমেরিকান ফর্মুলা থেকে মুক্ত করতে। এজন্য তিনি মধ্য ব্রাজিলের দাস সমস্যাকে বিদ্ধ করলেন। শ্রেণি বিভক্ত সমাজকে তিনি ভাগ করলেন ‘ভালো’ ও ‘খারাপ’ এই দুই দলে এবং করার চেষ্টা করলেন গভীর বিশ্লেষণ। একটা জটিল কাঠামোর ভেতর প্রবেশ এবং যে ভাষা এই চলচ্চিত্রে খাটে তেমন এক ভাষাকে আয়ত্ত করার চেষ্টা করে এমন এক ছবি বানালেন যেটা ওই সময়ে বিচ্ছিন্ন কাজ বলে মনে হয়েছে। তাঁর অন্য কাজের থেকে বিচ্ছিন্ন এই ছবি আর যাই হোক অনেক বেশি বাস্তবসম্মত ও জাতীয় বলে মনে হয়েছে, অন্তত O Assalto ao Trem Pagador ছবির জন্য গৃহীত বদ্ধ ও পূর্বনির্ধারিত সূত্রের চেয়ে।
‘শোকাবহ বন’কে জনগণ গ্রহণ করেনি। তখন ফারিয়াস বুঝলেন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষমতা আর পরিচালক হিসেবে আপনকার মেধা, দুটির কোনো যোগসূত্র নেই। তবে বিষয় বাছাইয়ে নিজের মেধা ব্যবহার তো করতেই পারতেন। যাহোক, আবারো পরিচালক পুঁজি করলেন শহর ও নৈতিকতাকে, Toda donzela tem pai que e’uma fera (‘সকল সুন্দরী তরুণীর বাবা ভয়ানক’) ছবিতে, এতে আনা হলো বুর্জোয়াদের প্রতি মধ্যবিত্তের দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি এর মাধ্যমে একটা ধারণা পোক্ত করলেন, কোন বিষয়ের ওপর আমেরিকান বয়ান রীতি প্রয়োগ করলে সেটাতে সাফল্য পাওয়া যায়, অথচ এই ফর্মুলা সামাজিক ও নৈতিকভাবে মিথ্যা।
Selva tragic ছবিকে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচক ও আর্ট সিনেমার পরিম-ল স্বাগত জানানোয় রবার্তো ফারিয়াসকে নিয়ে একটা উভয় সংকট পয়দা হয়। যাক শেষ পর্যন্ত একজন কারিগর পরিচালক সফল হয়েছে, অন্ধকারে চাপা পড়েছে একজন অতর পরিচালক, আর এই কারণেই তাঁর ইদানীংকালের ছবি, আমেরিকান কায়দায় ব্রাজিলিয়ান দ্রবণের পরিবেশন, এই টোটকাতেই Robert Carlos em ritmo de aventura(‘দুঃসাহসী অভিযানে রবার্ট কারলোস’) আমাদের বক্স অফিসে ঝড় তুলেছেন অবধারিতভাবে।
পরীক্ষা
কিন্তু প্রশ্ন হলো এভাবে এলিয়েনেশনকে ব্যবহার করে রবার্তো ফারিয়াস কি সত্যিই জনগণকে জয় করতে পারবেন? জনগণ যা চায় তাকে সেটা দেওয়ার নামই কি জয় করা? নাকি এটা সংস্কৃতি চর্চার বাইরে থাকা জনগণকে এক ধরনের বাণিজ্যিক শোষণ? তাহলে হয় তো Selva tragic ছবিতেই সঠিক পথের সন্ধান রয়েছে, যে পথ ধরে দর্শকের মন জয় করা যায়? তাই নয় কি?
রবার্তো হয় তো চোখ বন্ধ করেই জবাব দেবেন সিনেমা একটা কারখানা এবং ব্রাজিলের চলচ্চিত্র কারখানার প্রয়োজন। এই কারখানার সাহায্যেই একদিন হয়ত তিনি দেশের সমস্যা নিয়ে মৌলিক সিনেমা বানাতে পারবেন। কিন্তু জাতীয় চলচ্চিত্র কারখানা গড়ে উঠবে কীভাবে? সিনেমা একটা কারখানা, এখান থেকে সংস্কৃতি উৎপাদন হয়। আমেরিকান সিনেমা এরই মধ্যে একটা স্বতন্ত্র স্বাদ তৈরি করে নিয়েছে। এই ক্ষেত্রে ব্রাজিলের সিনেমা কারখানা হিসেবে যদি উন্নতি করতে চায় এবং খুব সহজে, তাহলে আমেরিকান ফর্মুলা বটিকা ব্যবহার করা যেতে পারে। এমনটা হলে ব্রাজিলের কারখানা থেকে উৎপাদিত চলচ্চিত্র হবে বৃহৎ শক্তিরই প্রতিফলন, সেই আধিপত্যশীল সংস্কৃতিরই পুনঃউৎপাদন করবে এসব চলচ্চিত্র। এই সংস্কৃতি হতে পারত ফরাসি, রুশ কিংবা বেলজিয়ান- এতে আর ওতে কোন তফাৎ নেই; কিন্তু নির্দিষ্ট সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতরে, বাইরে থেকে কোনো চর্চা প্রবেশ হওয়া বা না হওয়া একটি অনুন্নত দেশের জন্য অনেক অর্থ বহন করে।
ব্রাজিলিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সামনে প্রথম পরীক্ষা হলো কীভাবে আমেরিকান ফর্মুলা ব্যবহার না করে জনগণের মন জয় করা যায়, এই ফর্মুলা অবশ্য এখন ব্যবহার হচ্ছে দেদারসে, ইউরোপেও ব্যবহৃত হচ্ছে এক-আধটু পরিবর্তন করে। কাউকে দিয়ে জোর করে এমন সিনেমা বানানোর কি মানে আছে যেখানে সমাজের একটা নির্দিষ্ট সংস্কৃতি কাঠামোর ভেতর ওই ছবি ভালো কিংবা খারাপ কি, কোন মানদ-েই পাশ করবে না? এই ‘অচলাবস্থা’, গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে যে অনুন্নত সমাজ রয়েছে সেটার আধুনিক ধারণাকেই প্রতিফলিত করে। এই প্রতিফলনে দুই মুখো এবং সাংঘর্ষিক নীতির প্রতিঘাত স্পষ্ট। একদিকে ফুটে ওঠে চলচ্চিত্র নির্মাতার নিশ্চিত দুর্নাম কারণ তিনি ‘নকল উৎপাদন করছেন’, অন্যদিকে ফুটে ওঠে ‘মৌলিক প্রচেষ্টাকে বাতিল করে দেওয়া’ দর্শকের বিরক্তি।
যাহোক, বিষয়টি পুরোপুরি বুঝে ওঠা দর্শকের জন্য দুরূহ। কারণ বাজারের চাহিদামাফিক নিখুঁত সিনেমার ধারণা এবং এই ধারণাকে সহজেই তৃপ্ত করতে বানিয়ে ফেলা নকল সিনেমার বিপরীতে মৌলিক সিনেমা বানানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে দর্শক সচেতন নয়। মৌলিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে নিখুঁতের কাছাকাছি পৌঁছানো বেশি কষ্টকর যেহেতু বিষয়াদি নতুন, খুতটুত আছে তাই দর্শকের কাছে তেমন আদর পায় না ছবিটি। তাই বলা যায়, দর্শকের এক প্রকার সম্মতি নিয়েই তৈরি হতে থাকে নকল সিনেমা আর এই প্রবণতায় দর্শকের সম্মতি উত্তেজক পদার্থের মতো।
নকলপ্রবণ সিনেমা আর মৌলিক সিনেমা এই দুই ধারণার ভেতর থেকে ব্রাজিলে জ্বলে উঠেছে একটা শব্দবন্ধ ‘সিনেমা নভো’। এই সিনেমা নভো যেহেতু ব্রাজিলের বাস্তবতার মোকাবিলা করবে বলে স্থির করেছে তাই দ্বিতীয় আরেক পরীক্ষার উদ্ভব হয় এখানে : নকলের ভাষা বাতিল করে, মৌলিক কোনো কাঠামো দিয়ে এর জায়গা পূরণ করা কি সম্ভব?
লোকবাদকে ‘না’
সিনেমা যেহেতু সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ারই একটা উপাদান তাই শেষ বিচারে একে সমাজের ভাষাই হয়ে উঠতে হবে। কিন্তু সওয়াল হলো কোন সমাজের? ‘পরিবর্তনের’ ভেতর দিয়ে যাওয়া ব্রাজিল হলো : দেশজবাদী/অহংকারী, রোমান্টিক/বিলোপবাদী, প্রতীকবাদী/প্রকৃতিবাদী, বস্তুনিষ্ঠ/ভাবালুতাপ্রবণ, প্রজাতান্ত্রিক/ দৃষ্টবাদমূলক, নৈরাজ্যবাদী/স্বজাতিগ্রাসী, জাতীয় লোকবাদী/সংস্কারবাদী, বাস্তববাদী/অনুন্নত, বিপ্লবী/প্রথানুসারী, ক্রান্তীয়/ কাঠামোবাদী ইতি ও আদি। আমাদের সংস্কৃতি আন্দোলন থেকে উৎসারিত সচেতনতাÑ উপরিকাঠামো দিয়ে এমনভাবে ঠাসা (উল্লেখ্য, আমরা এলিটদের উৎপাদিত শিল্পকে ইঙ্গিত করছি, যেটা জনগণের উৎপাদিত ‘জনপ্রিয় শিল্পের’ চেয়ে একেবারেই আলাদা)Ñ যা দিয়ে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরার মতো সচেতনতা তৈরি সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে প্রশ্ন করতে হয়, আমাদের পরিচয় কী? কি ধরনের চলচ্চিত্র আছে আমাদের?
লোকবাদকে ‘না’
সিনেমা যেহেতু সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ারই একটা উপাদান তাই শেষ বিচারে একে সমাজের ভাষাই হয়ে উঠতে হবে। কিন্তু সওয়াল হলো কোন সমাজের? ‘পরিবর্তনের’ ভেতর দিয়ে যাওয়া ব্রাজিল হলো : দেশজবাদী/অহংকারী, রোমান্টিক/বিলোপবাদী, প্রতীকবাদী/প্রকৃতিবাদী, বস্তুনিষ্ঠ/ভাবালুতাপ্রবণ, প্রজাতান্ত্রিক/ দৃষ্টবাদমূলক, নৈরাজ্যবাদী/স্বজাতিগ্রাসী, জাতীয় লোকবাদী/সংস্কারবাদী, বাস্তববাদী/অনুন্নত, বিপ্লবী/প্রথানুসারী, ক্রান্তীয়/ কাঠামোবাদী ইতি ও আদি। আমাদের সংস্কৃতি আন্দোলন থেকে উৎসারিত সচেতনতাÑ উপরিকাঠামো দিয়ে এমনভাবে ঠাসা (উল্লেখ্য, আমরা এলিটদের উৎপাদিত শিল্পকে ইঙ্গিত করছি, যেটা জনগণের উৎপাদিত ‘জনপ্রিয় শিল্পের’ চেয়ে একেবারেই আলাদা)Ñ যা দিয়ে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরার মতো সচেতনতা তৈরি সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে প্রশ্ন করতে হয়, আমাদের পরিচয় কী? কি ধরনের চলচ্চিত্র আছে আমাদের?
এসব প্রশ্ন দিয়ে জনগণকে বিরক্ত করার মানে নেই-আম জনতা সিনেমা দেখতে যাই বিনোদনের খাতিরে কিন্তু আচানক যদি আবিষ্কার করে তারা দর্শক বনে গেছে এমন জাতীয় চলচ্চিত্রের- যে চলচ্চিত্র সংলাপ রচনায় ব্যাপক কাঠখড় পোড়ায়, ঘাম ঝরায় নির্মাতার, নির্মাতা জনগণের সঙ্গে কথা কওয়ার কোশেশ করেন- নয়া ভাষায়, নিঃসন্দেহে জনগণ ধাক্কা খাবে!
এই ভাষা সংক্রান্ত আলোচনা গজিয়ে উঠেছে এবং প্রকাশিত হচ্ছে। নকলপ্রবণ সিনেমাকে বাতিল করে, আমলে নেওয়া হচ্ছে ভাবভঙ্গি প্রকাশের ভিন্ন কাঠামোকে, সিনেমা নভো এরই মধ্যে তথাকথিত জাতীয় শিল্প, ‘লোকবাদ’, এসবের ব্যবহৃত নতুন ভাষার হাজিরা ও ইঙ্গিত ইস্তেমালের সহজ পথ পরিহার করেছে। আমাদের গলাধঃকৃত অতিসাধারণ রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্য দিয়ে এসব ভাষার প্রতিফলন দেখা যায়। কাউদিও caudiho যেমন- শিল্পী নিজেকে জনগণের বাপ মনে করে : অনুশাসন মোতাবেক ‘সহজ করে বাৎচিত করো যাতে পাবলিক বুঝতে পারে।’
আমার অনুভূতি হলো ‘সাধারণ পাবলিকের জন্য সহজ জিনিস পয়দা করা’ প্রকৃত অর্থে জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা কম দেখানোরই সামিল, এই জনগণ হতে পারে অনুন্নত। জনগণ হতে পারে রোগাক্রান্ত, ক্ষুধার্ত কিম্বা নিরক্ষর কিন্তু তারা সাধারণ নয়, তাদের অবস্থান জটিল। পিতৃতান্ত্রিক শিল্পীরা জনপ্রিয় বিষয়বস্তুকে ফ্যান্টাসি হিসেবে হাজির করে, গরিবি দশার মধ্যেও তারা লালন করে দর্শন, আর গরিব বেচারা সামনে আগুয়ান হতে এদের শুদ্ধ একটুখানি ‘রাজনৈতিক সচেতনতা’ দরকার, যাতে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াকে এরা ঘুরিয়ে দিতে পারে।
ভাঙাশিল্পের (Derivative art) চেয়ে এই ধারণার (পাবলিককে হেয় করে সস্তা জিনিস পয়দা করে যাওয়া) পুরনো চরিত্র শেষ পর্যন্ত বেশি ক্ষতিকর কারণ ভাঙাশিল্পের নিদেনপক্ষে সাহসটা আছে, অন্যকে নকল করলেও নিজেকে জানার প্রচেষ্টা আছে, সামনে এগিয়ে ‘শৈল্পিক রসবোধ কারখানা’র পক্ষে সাফাই গাইতে পারে, নিজেদের লক্ষ্যে অটল থেকে।
ভাঙাশিল্পের (Derivative art) চেয়ে এই ধারণার (পাবলিককে হেয় করে সস্তা জিনিস পয়দা করে যাওয়া) পুরনো চরিত্র শেষ পর্যন্ত বেশি ক্ষতিকর কারণ ভাঙাশিল্পের নিদেনপক্ষে সাহসটা আছে, অন্যকে নকল করলেও নিজেকে জানার প্রচেষ্টা আছে, সামনে এগিয়ে ‘শৈল্পিক রসবোধ কারখানা’র পক্ষে সাফাই গাইতে পারে, নিজেদের লক্ষ্যে অটল থেকে।
লোকবাদী শিল্প, অন্যদিকে,নিজের পুরনো বৈশিষ্ট্যকে জায়েজ করতে চায় ‘সাফ বিবেক’ দিয়ে। লোকবাদী শিল্প সবসময়ই বলতে থাকে, ‘আমি আঁতেল নই, আমি জনমানুষের সঙ্গে, আমার শিল্প সুন্দর কারণ এটা সংযোগ গড়তে পারে সহজে,’ ইত্যাদি। আসলে এটা জনগণের সঙ্গে নিজেদের বিচ্ছিন্নতা, নিজেদের শিক্ষার অভাব এবং স্থূলতার সংযোগ স্থাপন করে। এক ধরনের দৈন্যদশা থেকে এদের উৎপত্তি বলেই জীবনকে এরা অবজ্ঞার চোখে দেখে।
ব্রাজিলের মানুষ এই দীনতা মেনে নিচ্ছে কিন্তু সমালোচনা করতে ছাড়ছে না। জনপ্রিয় সঙ্গীতে অনেক সাম্বাতেই গাইতে শোনা যায় : ‘আমার কোনো শিম নাই, পাথর থেকে সুপ বানাই’, ‘আমি পথের ধারে মারা যাব, হাসতে হাসতে’, অথবা ‘শহরের বস্তি স্বর্গে ঢোকার প্রবেশপথ’ ইত্যাদি সব কথা। লোকবাদ যেমন জায়গা থেকে উৎপন্ন হয় সেখানেই ফিরে যায় মানে লোকজনকে সে তুষ্ট করে, যেকোনো গভীর বিশ্লেষণের কাছেই এর অগোছালো চেহারা ধরা পড়ে। অনুন্নয়নের পুরনো হাস্যকর অবস্থার মধ্যে কীভাবে শিল্প নিজেকে সাজায় সেটা দেখে মানুষ নিজেদের দুর্ভাগ্য নিয়ে তামাশা করে আর হেসে গড়াগড়ি যায়।
chanchada3-এর সাফল্যের ব্যাখ্যা তাই নতুন করে দেওয়ার দরকার নেই,caboclo4গোষ্ঠীর দারিদ্র্য অথবা মধ্যবিত্তকে নিয়েই নির্মিত হয় এ ধরনের চলচ্চিত্র। এটাই সামাজিক বক্তব্য সম্বলিত যেকোনো নাটকের সাফল্যের চাবিকাঠি।
‘বিচ্ছিন্নতা বা এলিয়েনেশনের বিপক্ষে…যোগাযোগের সব কাঠামো ব্যবহার করা উচিত’, লোকবাদীরা অবশ্য এই ধারণারও বিরোধিতা করবে। কিন্তু ‘যোগাযোগের যেসব কাঠামো’ আমরা এরই মধ্যে দেখেছি সেগুলো হলের ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রপাতি।
একটা অনুন্নত দেশের অনুন্নত শিল্প থাকাটা বাধ্যতামূলক ব্যাপার নয়। শিল্প ক্ষতি করে এমন ভাবাটাই শিশুসুলভ কখনো কখনো প্রতিক্রিয়াশীলও বটে। ব্রাজিলিয়ান সংস্কৃতির এই সাধারণ দৈন্যদশা তুলে ধরে সিনেমা নভো বাতিল করেছে লোকবাদকে। এভাবেই জনগণের সঙ্গে সমূহ রণের সম্ভাবনাকে সংকুচিত করেছে সিনেমা নভো। এর মাধ্যমে কি সিনেমা নভো এড়িয়ে চলার পন্থা অবলম্বন করছে?
যখন যোগাযোগের সমস্যা আলোচনাকে বিস্তৃত করছে, তখন নির্মাণের সমস্যাকে গ্রাহ্য করেছে সিনেমা নভো। সৃজনশীলতা আর সিনেমাটোগ্রাফির মধ্যে কি নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না?
একটা অনুন্নত দেশের অনুন্নত শিল্প থাকাটা বাধ্যতামূলক ব্যাপার নয়। শিল্প ক্ষতি করে এমন ভাবাটাই শিশুসুলভ কখনো কখনো প্রতিক্রিয়াশীলও বটে। ব্রাজিলিয়ান সংস্কৃতির এই সাধারণ দৈন্যদশা তুলে ধরে সিনেমা নভো বাতিল করেছে লোকবাদকে। এভাবেই জনগণের সঙ্গে সমূহ রণের সম্ভাবনাকে সংকুচিত করেছে সিনেমা নভো। এর মাধ্যমে কি সিনেমা নভো এড়িয়ে চলার পন্থা অবলম্বন করছে?
যখন যোগাযোগের সমস্যা আলোচনাকে বিস্তৃত করছে, তখন নির্মাণের সমস্যাকে গ্রাহ্য করেছে সিনেমা নভো। সৃজনশীলতা আর সিনেমাটোগ্রাফির মধ্যে কি নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না?
অধিকাংশ পর্যবেক্ষক/ দর্শক প্রত্যুত্তরে বলেন, চলচ্চিত্র হলো যোগাযোগের শিল্প এবং সেটা চলচ্চিত্রের পক্ষেই হয়ে ওঠা সম্ভব। এই দর্শকদের কাছে নির্মাণ আর যোগাযোগ দুটি বিপরীত জিনিস। তাই যোগাযোগের অগ্রদূতরা এড়িয়ে চলবেন বিষয়টিকে। যাহোক, তাদের কাছে প্রশ্ন : কয় স্তরে যোগাযোগ উৎপাদন হয় এবং এর চেয়েও দরকারী প্রশ্ন সত্যিকারের যোগাযোগ কি?
সিনেমা নভো দাবি করতে পারে সত্যিকারের যোগাযোগ তারা লাভ করছে। আর এই দাবির মধ্য দিয়ে সিনেমা নভো লোকবাদের সাচ্চা যোগাযোগের নিশ্চয়তা থেকে নিজেকে আজাদ করেছে। এই লোকবাদের যোগাযোগ স্থাপনের নিশ্চয়তা নিয়ে যে বড়াই সেটা বিভ্রান্তিকর। কারণ গভীরে, লোকবাদ অনুন্নত সমাজের ‘সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ’ নিয়ে চর্চা করে না বললেই চলে। আর এসব ‘মূল্যবোধ’ ফালতু জিনিসÑ আমাদের সংস্কৃতিÑ শৈল্পিক দক্ষতার একটা মাত্রা অর্জন করতে যে দক্ষতা লাগে তার অভাবের ফল অথবা বলতে পারেন আলসেমির ফল কিংবা শিক্ষার অভাবের ফল, অক্ষম রাজনীতির ফলও বলা যেতে পারে, বন্ধ্যা সমাজের ফল বললেও ভুল বলা হয় না। অতএব বলা যেতে পারে এই সংস্কৃতি হলো ‘শূন্য বছরের’, কাজেই পুড়িয়ে দাও সব গ্রন্থাগার!
প্রতিটি চলচ্চিত্রে, লুমিয়ের ভাইদের মতো, সিনেমা নভো শুরু করেছে শূন্য থেকে। শূন্য থেকে শুরুর জন্য চলচ্চিত্র নির্মাতারা যখন নিজেদের প্রস্তুত করে, তখন তাদের ভাবনায় থাকে নতুন কিসিমের প্লট, যেখানে কাজের ধরনটাও হবে নতুন, সিনেমার ছন্দটাও হবে ভিন্ন যেন আলাদা কবিতার স্বাদ পাওয়া যায়। এই চলচ্চিত্র নির্মাতারা নিজেদের ফেলে দেয় এক ভয়ানক বৈপ্লবিক অভিযানের ভেতর, যেখানে কাজের ভেতর থেকেই তারা প্রতিনিয়ত শেখে, সেই সঙ্গে টিকে থাকার তত্ত্বটা আয়ত্ত করে, চর্চাও করে। চর্চার মাধ্যমে সব তত্ত্বকেই ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ে নেয়, পর্তুগিজ কবিদের কাছ থেকে নিয়ে নেলসন পেরেরা ডস সান্তোস যেমনটা বলেন : ‘জানি না কোথায় যাচ্ছি আমি, কিন্তু এটা জানি ওইখানটায় যাচ্ছি না’Ñ এই বাক্যকে নিজেদের বেদবাক্যে পরিণত করে।
পাবলিক আপনা থেকেই তাড়িত হয়ে হলে যায়। নয়া জাতের সিনেমা পাঠে তারা একধরনের তুষ্টি বোধ করে : কারিগরি মানে ত্রুটি আছে, নাটকে মিলান্তি নেই, কাব্যিক বিচারে বিদ্রোহী, সামাজিকভাবে বেঠিক, কার্যত ব্রাজিলের সমাজবিজ্ঞান যেমন ঠিকঠাক নেই তেমনি রাজনৈতিকভাবে আগ্রাসী ও অনিরাপদ। ব্রাজিলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যতটা না তীব্র আছে তার থেকে দুঃখটাই বেশি। আমাদের কার্নিভালের মতো, যাতে আনন্দের চেয়ে দুঃখটাই বেশি। আমাদের কাছে নতুন মানেই নিখুঁত তা নয়, যেহেতু নিখুঁতের ধারণা এসেছে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি থেকে, এই সংস্কৃতিই তাদের নিখুঁতের ধারণাকে নির্ধারিত করেছে বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শের সুবিধাকে তুলে ধরতে।
আধুনিক শিল্প যা সত্যিই বিপ্লবী নৈতিকতার বিচারে এবং নন্দনতত্ত্ব বিরোধী হয়ে উঠেছে নিজস্ব ভাষার ভেতর দিয়ে, এই ভাষা হয়ে উঠেছে কর্তৃত্বপরায়ণ। যদি অপরাধের যোগফল বুর্জোয়া শিল্পীরা অনুভব করতে পারেন এবং সেটা তাদের নিজের দুনিয়ার উল্টা দিকে দাঁড় করাতে পারেন, যে দুনিয়া সচেতনতার দোহাই দিয়ে গড়া, সচেতনতা বস্তুটা পাবলিকের দরকার হলেও জিনিসটা তাদের কাছে নেই। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আধুনিক শিল্পের যে ভেজাল আগ্রাসী চেহারা আছে সেটার বিরোধিতা করতে হবে, দাঁড়াতে হবে এই আধুনিক শিল্পের নৈতিক ও নন্দনতাত্ত্বিক ভ-ামির বিরুদ্ধে। কারণ এগুলো শিল্পীদের বিচ্ছিন্নতার পথে ধাবিত করে।
বোঝাই যাচ্ছে সিনেমার নভোর লক্ষ্য এমন জায়গায় ধরা হয়েছে যা সিনেমার ওপারে, উপরে। সিনেমাকে সবাই বিনোদনের একটা ধরন বলেন। যারা সিনেমা দেখতে প্রেক্ষাগৃহে যান তারা নিজেরা মজা পেতে যান। সিনেমায় কেউ সমস্যা মোকাবিলা করতে চান না। শিল্প হলো মঞ্চনাটক, পেইন্টিং, কাব্য এসবের চারণভূমি। অন্যদিকে সিনেমা করতে গেলে পয়সা লাগে। চলচ্চিত্র নির্মাতা শিল্পী হলো দায়িত্বজ্ঞানহীন, নির্বোধ নয় তো আঁতেল!
ব্রাজিলে আঁতেল বা বুদ্ধিজীবীর সমার্থক শব্দ হলো সমকামিতা। কাজেই আপনি বুদ্ধিজীবী হতে চাইলে আপনার যথেষ্ট সাহস দরকার। আর বুদ্ধিজীবী হিসেবে সিনেমার শক্তি কেড়ে নিতে হলে তো কথাই নেই। আমার মনে হয় ব্রাজিল এমন একটা দেশ যার বেপরোয়াভাবে সিনেমাকে দরকার, এরচেয়েও বড় কথা, সিনেমা ব্রাজিলের চমৎকারিত্বের পরাকাষ্ঠা ছোঁয়া শিল্প হয়ে উঠবে। সবারই জানা, রোম একদিনে গড়ে ওঠেনি, আর সিনেমা নভো কেবল শুরু হলো ১৯৬২ সালে আর এ পর্যন্ত মানে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সিনেমা নভো উৎপাদন করেছে মাত্র ৩২টি চলচ্চিত্র।
(আংশিক)
(আংশিক)
টীকা
১. Cangaco ব্রাজিলের প্রত্যন্ত অঞ্চল।
২. Cangaceiro হলো রবিন হুড মার্কা ডাকাত। ব্রাজিলের উত্তর- পূর্বাঞ্চলের অপরাধী। O Cangaceiro হলো ব্রাজিলের প্রথম দিককার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া চলচ্চিত্র। কানে পুরস্কার জেতা এই চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় ২২টি দেশে এবং এই ছবির মাধ্যমে ভেরা ক্রুজে চলচ্চিত্র নির্মাণের সর্বোচ্চ দিকটাও প্রমাণ হয়ে যায়, যেখানে সাও পাওলোতে অনেক বড় বড় ফিল্ম স্টুডিও ইউরোপীয় তরিকার বিনোদন তৈরিতে মনযোগী ছিল।
৩. Chanchada ঐতিহ্যগতভাবে ব্রাজিলের চলচ্চিত্র কারখানার এই জরাটি সবচেয়ে ব্যবসাসফল। এই ধারার ছবিতে থাকে সাধারণ প্লট ও ফর্মুলা। এগুলো মিউজিক্যাল কমেডি।
৪. Caboclo এক ধরনের ব্রাজিল মিশ্রিত সাদা ও ভারতীয় রক্তের শংকর জাতি।
১. Cangaco ব্রাজিলের প্রত্যন্ত অঞ্চল।
২. Cangaceiro হলো রবিন হুড মার্কা ডাকাত। ব্রাজিলের উত্তর- পূর্বাঞ্চলের অপরাধী। O Cangaceiro হলো ব্রাজিলের প্রথম দিককার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া চলচ্চিত্র। কানে পুরস্কার জেতা এই চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় ২২টি দেশে এবং এই ছবির মাধ্যমে ভেরা ক্রুজে চলচ্চিত্র নির্মাণের সর্বোচ্চ দিকটাও প্রমাণ হয়ে যায়, যেখানে সাও পাওলোতে অনেক বড় বড় ফিল্ম স্টুডিও ইউরোপীয় তরিকার বিনোদন তৈরিতে মনযোগী ছিল।
৩. Chanchada ঐতিহ্যগতভাবে ব্রাজিলের চলচ্চিত্র কারখানার এই জরাটি সবচেয়ে ব্যবসাসফল। এই ধারার ছবিতে থাকে সাধারণ প্লট ও ফর্মুলা। এগুলো মিউজিক্যাল কমেডি।
৪. Caboclo এক ধরনের ব্রাজিল মিশ্রিত সাদা ও ভারতীয় রক্তের শংকর জাতি।
No comments:
Post a Comment