উন্নত জীবন আর ভাগ্য ফেরানোর আশায় গত এক দশকে প্রায় লক্ষাধিক বাংলাদেশি অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। যাদের অধিকাংশই ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের প্রবেশদ্বার ইতালি হয়ে জার্মানি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক আশ্রয়, চিকিৎসা, ট্যুরিস্ট এবং স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করলেও পরবর্তীতে আর দেশে ফিরে আসেনি।
অবৈধ এসব বাংলাদেশি অভিবাসীদের দেশে ফিরিয়ে নিতে গত একবছর ধরে বাংলাদেশকে চাপ দিয়ে আসছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারই অংশ হিসেবে গত বুধবার ব্রাসেলসে বাংলাদেশ এবং ইইউ যৌথ কমিশনে ইউরোপীয় নেতারা অবৈধ এসব অভিবাসীদের ফিরিয়ে নিতে যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে ইউরোপে ভিসা পাওয়া ও অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে বাংলাদেশ।
দুই পক্ষের আলোচনার ধারাবাহিকতায় এবার কথা ছিল এক বছর ইইউর দেওয়া খসড়া চুক্তির আলোকে একটি এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর) অর্থাৎ নাগরিক ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। বুধবারের ওই বৈঠকে ইইউ প্রস্তাব করে, তাদের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী দুই দিনের মধ্যে আটক লোকজনের পরিচয় বাংলাদেশকে নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে দুই দিনের সময়সীমা শেষে তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি পরবর্তী সময়ে ফেরত পাঠানো লোকজন বাংলাদেশি নয় এমনটা নিশ্চিত করতে পারে, তবে এমন ব্যক্তিকে আবার ফেরত নেওয়া হবে। নতুন প্রস্তাব মেনে নিয়ে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসওপি চূড়ান্ত করতে বলেছে ইইউ।
বাংলাদেশি কূটনৈতিকেরা জানায়, অবৈধ বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে নতুন করে চাপ দেওয়ার পাশাপাশি শ্রম অধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশিদের থেকে প্রতিশ্রুতি আদায়ে কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে ইইউ।
তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে যে, বাংলাদেশ বিদ্যমান আইন এবং নীতিমালা অনুসরণ করেই বাংলাদেশিদের ফেরত আনা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ওই সকল ব্যাক্তিদের নাগরিকত্ব যাচাই-বাছাই করবে বাংলাদেশ।
যৌথ ওই আলোচনায় অবৈধ কত বাংলাদেশি আছে, তা নিয়ে কোনো তালিকা ইইউ প্রকাশ করেনি। তবে এ পর্যন্ত শুধু অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের সময় আট হাজার লোককে গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করেছে ইইউ প্রতিনিধিদল। এর আগে অভিবাসী নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক ইইউ এর কাছে কোন দেশে কত সংখ্যাক অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিক গ্রেফতার রয়েছে তার তালিকা চাইলেও তারা তা এখনও দিতে পারেনি। তাই বিষয়টি এক ধরণের ধোয়াশার ভিতরেই রয়ে গেছে। তাছাড়া ইইউ’র এই সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অভিবাসন নিয়ে ভোগান্তিতে ফেলতে পারে বলে মনে করছে বিশ্লেষকরা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান বিভাগের ওয়েবসাইট ‘ইউরোস্ট্যাটের’ হিসাব অনুযায়ী গত আট বছরে ইউরোপে অনুপ্রবেশ করেছে প্রায় ৯৩ হাজার বাংলাদেশি। অবৈধ এসব বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে নিতে গত একবছর ধরে চাপ প্রয়োগ করে আসছে ইইউ। নতুন করে ইইউ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা বাংলাদেশ মেনে না নিলে ইইউভুক্ত দেশগুলি বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা প্রাপ্তিতে কঠোরতা আরোপ করতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। তবে বাংলাদেশের অবৈধ এসব অভিবাসীদের বিষয়ে সুনিদিষ্ট সিন্ধান্ত না হওয়া পযন্ত বৈধভাবে ইউরোপে বসবাসকারীদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা ।
অভিবাসন আর ভিসা প্রসঙ্গটি তখনই সামনে আসলো যখন শরণার্থীদের চাপে হিমশিম খাচ্ছে গোটা ইউরোপ। কেননা অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের ক্ষেত্রে নাইজেরিয়ার পরেই বাংলাদেশিদের অবস্থান।
অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট- রামরু’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন ড. তাসনিম সিদ্দিকীর বলেন, ‘ভিসা কড়াকড়ি করার ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়। এটাকে আমি অন্যায় ও বিশ্বায়নবিরোধী মনে করি। আর এটা করে অবৈধ অভিবাসন ঠোকানো যাবে না। বরং যাদের পড়াশোনাসহ নানা কাজে ইউরোপের দেশে যেতে হয়, তারা হয়রানির মুখে পড়বেন।
তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের অনেক ক্ষতি হবে। শিক্ষা, গবেষণা, ব্যবসা ও উন্নয়নবিষয়ক কাজে এ সিদ্ধান্ত বাধার সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান ক্ষতির মুখে পড়বে। বাংলাদেশের উচিত জোরের সঙ্গে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা।
অবৈধভাবে যেসব বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছিল তাদেরকে ফিরিয়ে নিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে যে তাগিদ দিচ্ছে। তাতে বাংলাদেশ সাড়া দেয়নি বলে মনে করে ইইউ। তাই জোটভুক্ত দেশগুলি এসব অবৈধ অভিবাসীদের দেশে ফেরাতে যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা নিছক ইউরোপে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের জন্য নতুন ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে এক ধরণের নিষেধাজ্ঞা। তবে গত বুধবারে যৌথ কমিশনের আলোচনায় ইউরোপীয় নেতারা যে বিষয়টি জোর দিয়ে বলেছেন তা হলো- ‘দু’দিনের মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত অভিবাসীর তথ্য’। বিষয়টি এবারের আলোচনায় বেশ জোর দিয়ে বলেছেন তারা। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মনে করছে, বিষয়টি সম্ভব হলেও প্রক্রিয়াটা অনেক কঠ্নি এবং সময় সাপেক্ষ। অভিবাসন প্রক্রিয়ার এই বিষয়টি যদি বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে সমাধান করতে না পারে তাহলে অবৈধ এসব অভিবাসীদের বিষয়ে বাংলাদেশকে বড় ধরণের ধাক্কা খেতে হতে পারে। তাই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারেকে গুরুত্ব সহকারে কমিশনের নেতাদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে বলে মনে করেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা ।
No comments:
Post a Comment