ঢাকা থেকে মোঃ নুর হুসাইন ------------
যানজটের কাছে অসহায় বাসিন্দারা ,
ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে খোলা ড্রেন,
সেবা সংস্থার কাজের সমন্বয় বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের ।
টানা বৃষ্টিতে নজিরবিহীন ভোগান্তিতে পড়েছে রাজধানীবাসী। গতকাল প্রধান প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি, সবই ডুবে যায় পানিতে। কোথাও হাঁটু কিংবা কোমর পানি, আবার কোথাও বুকপানি। জলজটের কারণে যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ হয় যায়। গণপরিবহন ছিল না বললেই চলে। অনেক জায়গায় রিকশাও পাওয়া যায়নি। কোথাও পাওয়া গেলে ভাড়া দিতে হয়েছে কয়েকগুণ বেশি। এ যেনো দুঃসহ এক নগরজীবন।
প্রতিবছর বর্ষাকাল এলেই এমন নরকযন্ত্রণায় পড়তে হয় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদের। তবে দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সেবা সংস্থার এ নিয়ে যেন কোন মাথাব্যথা নেই। প্রকল্প নেওয়া হয়, অর্থও বরাদ্দ হয়। তবে কাজের কাজ কিছুই হয় না।
এদিকে রাজধানীর অনেক সড়কে চলমান উন্নয়ন কাজের কারণে খোঁড়াখুড়ি করা হয়েছে। সেসব সড়কে লেজেগোবরে অবস্থা। স্বাভাবিকভাকে পানি মাড়িয়ে হাঁটার অবস্থাও নেই। আর গর্ত থাকায় একাধিক সড়কে ঘটেছে দুর্ঘটনা। অনেক এলাকায় নৌকা চলেছে। রূপনগরের তুরাগ, উত্তরা ১৩ ও ১৪ নম্বর, বাড্ডা সাতারকুল, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, মুগদা, মান্ডা ও মেরাদিয়ায় রাস্তা পারাপারে মানুষ নৌকা ব্যবহার করেছে। বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে অফিস ও স্কুল-কলেজগামীরা। এদিকে প্রায় হাঁটু পানি জমে যায় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের ভেতরেও। এক ভবন থেকে আরেক ভবনে যাওয়ার উপায়ও ছিল না। একদিকে ডুবে থাকা রাজপথ, অন্যদিকে ঘন্টার পর ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা যানবাহনের দীর্ঘ সারি- দুইয়ে মিলে রাজধানী হয়ে উঠে অচল নগরী।
রাজধানীর ব্যস্ততম মতিঝিলের অফিসপাড়ার অবস্থাও ছিল করুণ। পানি ভেঙে, আবার কখনো হেঁটে, কখনো গাড়িতে করে যেতে হয়েছে অফিসগামীদের। তার ওপর বেশির ভাগ ফুটপাত কেটে রাখায় হাঁটারও উপায়ও ছিল না। জলাবদ্ধতার কারণে বহুমুখী ভোগান্তির শিকার হন নগরবাসী।
সরেজমিনে মানিক মিয়া এভিনিউয়েও গিয়ে দেখা যায়, পানি থৈ থৈ করছে। ধানমন্ডি ১৬ নম্বরে (পুরনো ২৭ নম্বর) কোমর পানি। ইঞ্জিনে পানি ঢুকে যাওয়ায় রাস্তায় বন্ধ হয়ে পড়ে আছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, প্রাইভেট কার।
মঙ্গলবার রাতে বেশি না হলেও বুধবার সকাল থেকে অবিরাম বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমতে শুরু করে। নগরীর প্রধান সড়কের মধ্যে মানিক মিয়া এভিনিউ, ধানমন্ডি ১৬ নম্বর থেকে শুরু করে শান্তিনগর, সেগুনবাগিচা, সচিবালয়, পুরান ঢাকার বেশিরভাগ এলাকা চলে যায় পানির নিচে। ফার্মগেট থেকে কাওরান বাজার পর্যন্ত পানি জমে থাকায় এই এলাকায় সকালের দিকে গাড়ি ধীরে ধীরে এগুতে পারলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে থমকে যায়।
রাজধানীতে দুই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন খোলা ড্রেনগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার না করায় সেগুলো পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। তাই সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর রাস্তাঘাট ও অলিগলিতে পানি জমে যায়। তুলনামূলক উঁচু এলাকাগুলো থেকে ধীরে ধীরে একটা পর্যায়ে পানি নেমে গেলেও ভারি বৃষ্টি হলে নিচু এলাকাগুলোতে জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নেয়। অথচ পানি নিষ্কাশনের দায়িত্বে থাকা ঢাকা ওয়াসা হাত গুটিয়ে বসে আছে। দখল-দূষণে একাকার হয়ে আছে ছোট-বড় ২৬টি খাল।
সংস্থাটির বিশাল জনবল রয়েছে ড্রেনেজ (রক্ষণাবেক্ষণ-মেরামত) বিভাগে। বৃষ্টির পর রাস্তায় পানি-কাদায় নগরবাসী হাবুডুবু খেলেও ওয়াসার এই বিভাগ কয়েক বছর ধরে সম্পূর্ণ বেকার অবস্থায় রয়েছে। এখন তারা অর্পিত দায়িত্ব ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওপর ছেড়ে দিতে মরিয়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সেবা সংস্থার কাজের সমন্বয় করতে হবে। এসব কাজে জনগণের সম্পৃক্ততা ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। এছাড়া দখল হয়ে যাওয়া খাল উদ্ধারের উদ্যোগ নিতে হবে। সমপ্রতি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ২৩টি খাল উদ্ধারের উদ্যোগ নিলেও তা পিছিয়ে যাচ্ছে। এজন্য অপরিকল্পিত নগরায়ণের পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা ওয়াসা, পরিবেশ অধিদফতর, ভূমি অধিদফতর, বাংলাদেশ রেলওয়ে ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত। এছাড়া ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডও এর সঙ্গে রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে এই সংস্থাগুলো কাজ করছে।
জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ড্রেনেজ লাইন রয়েছে দুই হাজার কিলোমিটারের বেশি। আর ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ লাইন রয়েছে ৩৭০ কিলোমিটার। যদিও ঢাকা ওয়াসার আওতাভুক্ত এলাকা ৪০০ বর্গকিলোমিটার। বিভিন্ন এলাকায় জমা হওয়া পানি নিষ্কাশনের জন্য নগরীর ২৫০টি পাম্প থাকলেও ব্যবহূত হচ্ছে ১৬০টির মতো। মতবিরোধ থাকলেও শেষ পর্যন্ত দুই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো রাজধানীর ২৩টি খাল উদ্ধারের কথা জানিয়েছিল। সহযোগী সংস্থার সমন্বয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন একটি খাল উদ্ধারে নামলেও পরবর্তীতে আর কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি।
ঢাকা উত্তর সিটির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ বলেন, উত্তর সিটিতে ১ হাজার ২৩০ কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে। আমরা এগুলো নিয়মিতই পরিষ্কার করি। উন্নয়ন ও সংস্কারমূলক কাজ সব সময়ই চলে। কাজ করার পরও জলাবদ্ধতা মুক্ত না হওয়ার জন্য রাজধানীর খালগুলো দখল হওয়াকে দায়ী করেন এই প্রকৌশলী।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান জানান, প্রায় এক হাজার কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে দক্ষিণ সিটির। জলাবদ্ধতা নিরসনে চলতি অর্থবছরে ২৮০ কিলোমিটার ড্রেনের উন্নয়ন ও সংস্কারমূলক কাজ করা হবে।
রাজউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আব্দুর রহমান বলেন, ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ৫ হাজার ২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। কুড়িল থেকে বালু নদী পর্যন্ত ১শ’ ফুট চওড়া খাল খনন শুরু হয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান এ প্রসঙ্গে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ওয়াসার কাজ অব্যাহত রয়েছে। দখল হওয়া খাল উদ্বার করতে পারলে এই সংকট দূর করা সম্ভব।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, শহরের জলাবদ্ধতার সবচেয়ে বড় কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ন। পাশাপাশি সরকারের সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা তো রয়েছেই। ওয়াসা আজ কাজ করবে, তো পিডিবি করবে কাল, সিটি করপোরেশন করবে পরশু। তাই ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সমস্যা। মেগাসিটির উন্নয়নে পরিকল্পনা হয় কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। আমাদের ঘাটতি রয়েছে পদে পদে। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজাতে হবে। এসব সংস্থাকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে হবে। না হলে এ শহরে বসবাসরত মানুষের সামনে আরো দুঃখ-দুর্দশা অপেক্ষা করছে।
রাস্তায় দুই মেয়র : রাজধানী জুড়ে জলাবদ্ধতার চিত্র সরেজমিনে দেখতে রাস্তায় নামেন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি মেয়র। গতকাল বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ধানমন্ডি-২৭, রাপা প্লাজা এলাকার জলাবদ্ধতা দেখতে যান দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন। বিকেল সোয়া ৩টার দিকে বনানী এলাকা পরিদর্শনে নামেন মেয়র আনিসুল হক।
পরিদর্শনকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, টানা বর্ষণের কারণে নগররীতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এ সমস্যা সমাধানে কাজ করছি। বৃষ্টি থামার ৩/৪ ঘন্টার মধ্যে পানি অপসারিত হয়ে যাবে। এটি মূলত ঢাকা ওয়াসার কাজ হলেও আমাদের লোকেরা মাঠে নেমে এই কাজ করছে। ওয়াসার লোকজনকে মাঠে পাওয়া যায় না। একসঙ্গে ১০০/১৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে পানি যাওয়ার মত ড্রেনেজ সিস্টেম এ নগরীতে নেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী এটা করা হলে এ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যেত।
No comments:
Post a Comment