আবদুল্লাহ কুইলিয়াম ব্রিটেনের প্রথম মুসলমান ছিলেন তা নয়, তবে ব্রিটেনের লিভারপুল শহরে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি যে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, সেটা ছিল সর্বপ্রথম মসজিদ। মসজিদটির নাম শাহজাহান মসজিদ। এরপর ধারাবাহিকভাবে মসজিদ নির্মিত হতে থাকে এবং আজ অবধি হচ্ছে। বর্তমানে পুরো ব্রিটেনে দেড় হাজারেরও বেশি মসজিদ রয়েছে।
কুইলিয়াম একজন বড় শিক্ষাবিদ এবং প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ইসলামই ছিল তার জীবনের প্রথম, প্রধান ও একক বিষয়। তার দৃঢ় ঈমান এবং শক্তিশালী যুক্তি ৬ শতাধিক ব্রিটেনবাসীকে ইসলাম গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। সেজন্য সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ তাকে ব্রিটেনের ‘শায়খুল ইসলাম’ আখ্যায়িত করেছেন।
হেনরি কুইলিয়াম ১৮৫৬ সালের ১০ এপ্রিল লিভারপুল শহরে বিত্তশালী এক খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই কুইলিয়াম ধর্মপরায়ণ ছিলেন। কখনও মদ পান করেননি; বরং মদ্যপায়ীদের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন।
১৮৭৮ সালে তিনি লেখাপড়া শেষ করেন এবং অ্যাডভোকেট ও সলিসিটর হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র; তার স্পষ্টভাষিতা এবং আইন বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের কারণে।
একসময় তিনি জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন। বিজ্ঞ ডাক্তাররা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য স্পেন যেতে পরামর্শ দিলেন। তিনি ঠিকই স্পেনের উদ্দেশে বের হয়ে পড়লেন। সমুদ্রপথে ছিল তার যাত্রা। যাত্রাপথে তিনি দেখতে পেলেন কিছু মুসলমান জাহাজে নামাজ আদায় করছে। সে দৃশ্যটি তার হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি দেখলাম, একদল মুসলমান খুব সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াল এবং অত্যন্ত মনোযোগ ও শান্তিপূর্ণভাবে নামাজ পড়তে শুরু করল। জাহাজের এদিক-ওদিক হেলা কিংবা বাতাসের প্রকম্পন তাদের নামাজের মনোযোগ বিঘ্নিত করতে পারল না। তাদের মুখাবয়বে ঈমানের সত্যতার যে জ্যোতি আমি অবলোকন করলাম, সেটা আমার হৃদয়জগৎকে নাড়া দিল। ’
বস্তুত তার মাঝে ইসলাম সম্পর্কে আরও পড়ার ও জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়ে গেল। ফলে ১৮৮৭ সালে তিনি মরক্কো ভ্রমণের সিদ্ধান্ত করলেন। সেখানে পবিত্র কোরআনের অনুবাদ পাঠ করলেন। মহামানবদের নিয়ে লেখা স্কটিশ দার্শনিক ও প্রখ্যাত লেখক টমাস কার্লাইলের বইটিও তিনি পড়লেন; যেখানে লেখক শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তার মুগ্ধতা ও ভালো লাগার কথা তুলে ধরেছেন।
তাঞ্জিয়ায় মুসলমানদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার দরুন ইসলাম কবুল করতে তার হৃদয় উন্মুখ হয়ে ওঠে। ৩১ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে নেন। পরবর্তী বছর লিভারপুল ফিরে আনুষ্ঠানিকভাবে তার ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করেন। নিজের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেন আবদুল্লাহ।
ইসলামের দাওয়াত প্রচারের জন্য কুইলিয়াম একটা বড় শক্তিতে পরিণত হলেন। সম্ভাব্য সব উপায় কাজে লাগিয়ে তিনি ইসলাম প্রচারে ব্রত হলেন। কুইলিয়াম শুধু ব্যক্তিগত দাওয়াত দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি বরং মানুষকে ইসলাম চিনিয়ে দিতে লেখালেখিও করেন। ‘দ্য ফেইথ অব ইসলাম’ নামে ১৮৮৯ সালে তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটির কয়েক হাজার কপি ছাপানো হয়। তেমনিভাবে একাধিক ভাষায় সেটার অনুবাদও প্রকাশিত হয়। ফলে ব্রিটেনবাসী তাদেরই এক সন্তানের লেখা থেকে ইসলাম সম্পর্কে অবগতি লাভ করে। এজন্য গ্রন্থটির প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
লিভারপুল শহরেই কুইলিয়াম ব্রিটেনের সর্বপ্রথম মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। ১৮৮৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর মসজিদটির আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। বিলাসিতা ও আড়ম্বরপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতার বদলে মসজিদটির সূচনা হয় ১৩০ জন দরিদ্র মুসলিম শিশুকে খাবার প্রদানের মাধ্যমে। এভাবে মসজিদটি ইউরোপের প্রাচীনতম মসজিদ হিসেবে গড় ওঠে। বস্তুত এটি ছিল ব্রিটেনে ইসলামের নতুন এক ইতিহাসের সূচনা। ১৯৩২ সালের ২৩ এপ্রিল আবদুল্লাহ কুইলিয়াম এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে আপন মাওলার সান্নিধ্যে পাড়ি জমান। আল্লাহ তায়ালা যেন তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করেন।
লেখক: আলোচক, ইকরা টিভি, লন্ডন
No comments:
Post a Comment