আল্লাহর পক্ষ থেকে তার অনুমতিক্রমে কোরআন বহনকারী জিবরাইলসহ (আ.) অন্য বহু ফেরেশতার নাজিল হওয়া এবং এ রাতেই তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আর তারপরই আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে সৃষ্টি ও স ষ্টার যোগাযোগ স্থাপনের চিত্র কদর নামক সূরাটির মধ্যে আঁকা হয়েছে। এ সবকিছু মিলে আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে এর মাধ্যমে এক অভাবনীয় উপহার দান করেছেন।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এ উপহারের কথা এভাবে ঘোষণা করছেন, ‘নিঃসন্দেহে আমি মহিমান্বিত রজনীতে কোরআন অবতীর্ণ করেছি। আপনার কি জানা আছে যে, মহিমান্বিত রজনী কী? মহিমান্বিত রজনী হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। সে রাতে ফেরেশতারা এবং রুহুল কুদুস জিবরাইল (আ.) প্রতিপালকের নির্দেশে প্রত্যেক মঙ্গলময় বস্তু নিয়ে অবতরণ করেন। এটি শান্তিময় রজনী, ফজর হওয়া পর্যন্ত তা থাকে।’
আজ বহু বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর আমরা যখন সে পবিত্র ও সৌভাগ্যময় রাতের দিকে তাকাই তখন আমরা অবশ্যই সে ঐশী দূতের মধুর পরশকে স্মরণ করি, কল্পনা করি অপরূপ সেই ওহির বার্তাজনিত আনন্দ উৎসবের দৃশ্যটিকে, যা সে মধুর রাতে বর্ষিত হয়েছিল। তাই তো আল্লাহর পক্ষ থেকে জিজ্ঞাসার সুরে বলা হচ্ছে, তুমি কি জান লাইলাতুল কদর কী? এ রাতে বিজ্ঞানময় প্রতিটি কাজ, যুক্তিভিত্তিক কথা ও জ্ঞানপূর্ণ বার্তা পৃথকভাবে বিবৃত হয়।
সবকিছু যথাযথ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বরকতময় এ রাতেই উন্মোচিত হয়েছে। মানুষের প্রকৃত মূল্যায়নে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা এবং অবিচার-অনাচারে ভরা ধরায় প্রতিষ্ঠিত হল সুবিচারের মানদণ্ড। মানুষ তার বঞ্চিত অধিকার ফিরে পেল, মানবতা খুঁজে পেল পৃথিবীতে ঠিকানা। সমাজের বুকে প্রত্যেকেই যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত হল।
ইবনে আবী হাতেমের (রা.) রেওয়ায়েতে আছে, রাসূল (সা.) একবার বনি ইসরাইলের একজন মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। সে ব্যক্তি সারারাত ইবাদতে মশগুল থাকত আর সকালে জিহাদের জন্য বের হয়ে পড়ত এবং সারাজীবন জিহাদ করেই অতিবাহিত করত। এভাবে এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম সে দিনে জিহাদ ও রাতে ইবাদতে কাটিয়েছিল। সাহাবারা এ কথা শুনে বিস্মিত হলে সূরা কদর নাজিল হয়। এতে এ উম্মতের জন্য শুধু এক রাতের ইবাদতই সেই মুজাহিদের এক হাজার মাস ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়েছে।
ইবনে জারীর (রা.) অপর একটি বর্ণনায় লেখেন, পূর্ববর্তী যুগের দীর্ঘায়ু ধার্মিকরা বহু বছর পর্যন্ত ইবাদত-বন্দেগি করে এবং তাদের দীর্ঘ জীবনে বহু সৎকর্ম করে অশেষ পুণ্যের অধিকারী হয়ে গেছেন। সুতরাং রাসূলের (সা.) সমসাময়িক অথবা পরবর্তী যুগের অল্পায়ু মুমিনদের পক্ষে প্রার্থনা বা ইবাদত-বন্দেগি ও পূর্ণ কাজে তাদের সমকক্ষ হওয়া সম্ভব হবে কী?
এক সময় নবীর (সা.) মনে এ চিন্তা উদিত হওয়ায় আল্লাহতায়ালা এ সূরা অবতীর্ণ করে তাঁকে সুসংবাদ প্রদান করলেন- হে রাসূল! আমি আপনার এবং আপনার অনুসারীদের জন্য এমন এক মহামহিমান্বিত রজনী নির্ধারিত করে দিয়েছি, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। তাদের এক রজনীর উপাসনা হাজার মাসের উপাসনার চেয়েও উত্তম। এ রজনী আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে উম্মতে মুহাম্মাদীকে বিশেষ দান। এবং এটি এ উম্মতেরই বৈশিষ্ট্য।
তাই হে সিয়াম সাধক, হে নবীর আদরের উম্মত, আসুন আমরা আল্লাহর এ বিশেষ উপহার কাজে লাগিয়ে নিজের ভাগ্য বদল করি। সুন্দর এক আগামীর প্রত্যয়ে আজ থেকেই শুরু হোক আমাদের পথচলা। মোবারক এ রাতে সৌভাগ্য প্রদীপ জ্বেলে পাপ-পঙ্কিলতায় ভরা আমাদের জীবনকে ধুয়ে সাফ করি, খোদার রহমতের চাদরে আবৃত করি মনকে ও জীবনকে।
লেখক : জামেয়া শারইয়্যাহ মালিবাগের শাইখুল হাদিস ও মুহতামিম এবং বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সিনিয়র সহসভাপতি
No comments:
Post a Comment