বাংলাদেশে জীর্ণশীর্ণ শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে বসবাসকারী হাজার হাজার রোহিঙ্গা এখন নতুন পাচারপথের সন্ধান পেয়ে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখছে। উন্নত প্রযুক্তির মানবপাচার নেটওয়ার্কগুলো তাদের সে ‘স্বপ্ন’ দেখাচ্ছে।
সাগরপথে কড়াকড়ির কারণে এবার স্থল ও আকাশপথে পাঠানো হচ্ছে সহিংসতার মুখে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের। এ জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশি জাল পাসপোর্ট। এ সুযোগে রোহিঙ্গারাও মরিয়া হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে।
গতকাল বুধবার বার্তা সংস্থা এএফপির একটি প্রতিবেদনে এ দাবি করা হয়েছে। আধুনিক মোবাইল মানি ট্রান্সফার প্রযুক্তি পাচারকারীদের কাজটি সহজ করে দিচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তবে সাম্প্রতিককালে কী পরিমাণ রোহিঙ্গা স্থল ও আকাশপথে বাংলাদেশের ক্যাম্প ছাড়ছে, তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাগরপথে পাচারের পথ সিল করে দেওয়ার পর থেকে অনেক রোহিঙ্গা নতুন পথে বিদেশে পালানোর চেষ্টায় থাকে। এ বিষয়ে রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ ইদ্রিস এএফপিকে বলেন, ‘ক্যাম্প ছাড়তে লোকজন মরিয়া হয়ে উঠেছে। যাদের নগদ অর্থ বা সোনার গয়না আছে, তারা পাচারকারীদের পরিশোধ করছে। এর বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের আকাশপথে পাচার করা হচ্ছে। ’
গত বছরের অক্টোবরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানের আগ পর্যন্ত তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করে আসছে। অক্টোবরে সেনাবাহিনীর ওই রক্তাক্ত অভিযানের মুখে আরো প্রায় ৭০ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশ সরকার এই রোহিঙ্গাদের কাজের অনুমতি দিতে অস্বীকার করে আসছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলগুলোতে পাচারের শিকার ব্যক্তিদের অসংখ্যা গণকবর আবিষ্কৃত হয়। ওই সময় পাচারকারীরা অর্থ না পেয়ে অনেক অভিবাসীকে সাগরেই হত্যা করত। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হলে সাগরপথে পাচারের এই পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মূলত এরপর থেকেই পাচারকারীরা নতুন পথের সন্ধানে নামে।
কক্সবাজারে অনিবন্ধিত এক রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ (২০) এএফপিকে বলেন, ‘তিনি সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য ছয় লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। বর্তমানে তিনি সৌদি আরবে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি স্থানীয় এক বন্ধুকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র তৈরির জন্য টাকা দিই। এমনকি সে আমাকে ইমিগ্রেশন অতিক্রম করার ব্যাপারেও সাহায্য করে। ’ তিনি হোয়াটসআপ মেসেজিং সার্ভিস ব্যবহার করে এএফপির সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি তাঁর পরিবারের পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান। তবে যারা বিমানে বিদেশ যাওয়ার সামর্থ্য রাখে না, তারা সড়কপথে বাসে করে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। অনেকে পায়ে হেঁটেও বাংলাদেশ ছাড়ছে। তাদের অনেকে নেপাল ও পাকিস্তানে যাচ্ছে। এ দুটি দেশে যাওয়ার আগে তারা ভারতে যায়। তাদের অনেকে গোলযোগপূর্ণ কাশ্মীর অঞ্চলে অবস্থান নিয়েছে বলেও জানা গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই পাচার বাণিজ্যের আর্থিক মূল্য সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশেই কয়েক মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হচ্ছে। পাচারকারীরা নিজেরাই রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও জন্ম সনদের ব্যবস্থা করে দেয়।
বাংলাদেশে ‘অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন কর্মসূচি’ নামে পরিচিত একটি সমাজকল্যাণমূলক সংস্থার প্রধান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘পাচারকারীদের তৃণমূল নেটওয়ার্ক কত গভীরে এবং তারা সারা দেশে কত সহজে কার্যক্রম পরিচালনা করে, তা বিশ্বাস করার মতো নয়। অভিবাসীবিষয়ক বিশেষজ্ঞ জালালুদ্দিন সিকদার বলেন, মোবাইল ফোন মানি ট্রান্সফার সার্ভিসের বিস্তার ঘটায় পাচারকারীদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজ হয়ে উঠেছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, কক্সবাজারে অবস্থানরত চার লাখ রোহিঙ্গাকে বঙ্গোপসাগরের জনমানবহীন একটি দ্বীপে স্থানান্তরের প্রস্তাব করেছে সরকার। এই প্রস্তাবের পর থেকে শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে তারা দ্বীপে যাওয়া এড়াতে বিদেশে যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও সংগঠিত অপরাধ দমনে নিয়োজিত এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কক্সবাজার কমান্ডার নুরুল আমিন বলেন, ‘আমরা সাফল্যের সঙ্গে নৌকা অভিবাসন ঠেকাতে পেরেছি। এখন আমাদের নজর পাচারের অন্য রুটগুলোর ওপর। কিন্তু অভিবাসনে কেউ যদি মরিয়া হয়ে ওঠে, তাকে আপনি কিভাবে আটকাতে পারবেন?’
No comments:
Post a Comment