এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব বাংলাদেশি পরিচয় প্রদান করে টাকা জমা রেখেছেন এটি হল তার চিত্র। কিন্তু এর বাইরে যারা নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে টাকা রেখেছেন সে হিসাব এখানে নেই। ধারণা করা হচ্ছে, পরিচয় গোপনকৃত টাকা যুক্ত হলে এর পরিমাণ হবে আরও কয়েকগুণ।
এ ছাড়া এর বাইরেও বিদেশে বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা পাচার হয়ে থাকে। হুন্ডি ছাড়াও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়। এমনকি ভুয়া এলসি খুলে কোনো কিছু আমদানি না করেও পুরো টাকা বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঁজি পাচার হচ্ছে। আলোচ্য সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের আমানত কমেছে। আমানত রাখার ক্ষেত্রে এ বছরও প্রথম অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি গভীর উদ্বেগজনক। কারণ সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের যে টাকা রাখা হয়েছে, সেটা মূলত দুর্নীতির।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের মূলত তিনটি কারণ। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি বেড়েছে বলেই অর্থ পাচারও বেড়েছে।
এ ছাড়া দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অর্থ পাচার বাড়ছে। তার মতে, অর্থ পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। পাশাপাশি বিনিয়োগ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। নাগরিক জীবনেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা যুগান্তরকে বলেন, ‘সুইস ব্যাংক কীভাবে রিপোর্ট তৈরি করেছে, তা আমার জানা নেই। তবে টাকা পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময় কাজ করছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
বাংলাদেশিদের আমানত : গত ১২ বছরের মধ্যে ২০১৬ সালেই সবচেয়ে বেশি আমানত সুইস ব্যাংকে। আলোচ্য সময়ে আমানতের পরিমাণ ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৫ সালে ৫৫ কোটি ৮ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৪ সালে যা ছিল ৫০ কোটি ৬০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৩ সালে ৩৭ কোটি ২০ লাখ ফ্র্যাংক, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা।
অপরদিকে ২০১২ সালে ছিল ২২ কোটি ৯০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১১ সালে ছিল ১৫ কোটি ২০ ফ্র্যাংক। স্বর্ণালংকার, শিল্পকর্ম এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র জমা রাখলে তার আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে আমানতে যোগ হয় না।
১০ বছরে বাংলাদেশিদের আমানত : ২০০২ সালে ছিল ৩ কোটি ১০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০০৪ সালে ৪ কোটি ১০ লাখ, ২০০৫ সালে ৯ কোটি ৭০ লাখ, ২০০৬ সালে ১২ কোটি ৪০ লাখ, ২০০৭ সালে ২৪ কোটি ৩০ লাখ, ২০০৮ সালে ১০ কোটি ৭০ লাখ, ২০০৯ সালে ১৪ কোটি ৯০ লাখ এবং ২০১০ সালে ২৩ কোটি ৬০ লাখ ফ্র্যাংক রয়েছে।
মোট আমানত : প্রতিবেদন অনুসারে আলোচ্য সময়ে বিশ্বের সব দেশের আমানত কমেছে। ২০১৫ সালে সুইস ব্যাংকে বিদেশিদের মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি ফ্র্যাংক।
আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে ১ লাখ ৩৮ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। এ হিসাবে মোট আমানত কমেছে ৫ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। ২০১৩ সালে ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি, ২০১২ সালে ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি ফ্র্যাংক। এছাড়াও ২০১১ সালে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি, ২০১০ সালে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি এবং ২০০৯ সালে ছিল ১ হাজার ৩৩ হাজার কোটি ফ্র্যাংক।
এর আগে মালয়েশিয়ান সরকারের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। চীন প্রথম অবস্থানে। এগুলো সবই হয়েছে টাকা পাচারের মাধ্যমে। নিয়মানুযায়ী কোনো নাগরিকের বিদেশে টাকা নিতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়।
তবে বিদেশে যারা আয় করেন তাদের সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে বাংলাদেশের আইনে কোনো সমস্যা নেই। আর তিনি আয়করের আওতায় এবং প্রবাসী কোটায় কোনো সুবিধা নিয়ে থাকলে বিদেশে সম্পদ থাকার তথ্যও তার আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করতে হবে। এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো নাগরিক বিদেশে টাকা রাখলে তা দেশ থেকে পাচার বলে গণ্য হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত কাউকে বিদেশে টাকা জমা রাখার অনুমোদন দেয়া হয়নি। কোনো প্রবাসীও সরকারকে জানাননি যে তিনি সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রেখেছেন। ফলে সুইস ব্যাংকে জমা পুরো টাকাটাই দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে বলে গণ্য হবে। এর আগেও আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপেও বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনা উঠে এসেছে।
দীর্ঘ সময় ধরে ধনীদের অর্থ গোপনে জমা রাখার জন্য খ্যাত সুইজারল্যান্ড। ৮০ লাখ মানুষের এ দেশটিতে ব্যাংক আছে ২৬৬টি। বিশ্বের বড় বড় ধনী অর্থ পাচার করে দেশটিতে জমা রাখে। ব্যাংকগুলোও কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে।
আগে সুইস ব্যাংকে জমা টাকার কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতো না। এমন কী আমানতকারীর নাম-ঠিকানাও গোপন রাখা হতো। একটি কোড নম্বরের ভিত্তিতে টাকা জমা রাখা হতো। কিন্তু ২০০২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী টাকা পাচার রোধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ব্যাপকভাবে কার্যকর করা হয়।
এরপর আন্তর্জাতিক চাপে সুইস ব্যাংক জমা টাকার তথ্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ওই সময় থেকে বিভিন্ন দেশের জমা টাকার তথ্য প্রকাশ করছে। ওই প্রতিবেদনে কোন দেশের কত টাকা জমা আছে, সে তথ্য তারা প্রকাশ করছে। কিন্তু আমানতকারীদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করছে না। এ কারণে পাচারকারীদের ঠেকানো যাচ্ছে না।
টাকা পাচার : অর্থনীতির স্বাভাবিক অনুসারে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্যহীনতায় পুঁজি পাচার হয়। এ হিসেবে দেখা গেছে, দেশে সঞ্চয় বাড়ছে; কিন্তু বিনিয়োগ বাড়ছে না। ওই টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। নানাভাবে টাকা পাচার হচ্ছে। পণ্য আমদানির নামে ঋণপত্রের মাধ্যমে। কম দামে কম পণ্য এনে দেনা শোধ করা হচ্ছে বেশি দাম ও বেশি পণ্য দেখিয়ে। রফতানি পণ্যের একটি অংশের মূল্য দেশে আসছে না। ওই টাকাও পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। নগদ ডলার বা স্বর্ণের মাধ্যমেও দেশ থেকে টাকা চলে যাচ্ছে।
এছাড়া চিকিৎসা ব্যয়, বিদেশ ভ্রমণ, লেখাপড়ার খরচ- এসব মাধ্যমেও টাকা পাচার হচ্ছে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমেও টাকা পাচার হচ্ছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা দেশের মোট জাতীয় বাজেটের দেড়গুণ।
প্রতিবছর গড়ে পাচার হয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছরই এই পাচারের হার বাড়ছে। এর মধ্যে শুধু ২০১৫ সালে পাচার হয়েছে ৭৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থ পাচারে দক্ষিণ এশিয়াতে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান।
সুইস ব্যাংকের পরিচিতি : সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) হল সুইজারল্যান্ড সরকারের স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশেষ আইন দ্বারা পরিচালিত এ ব্যাংকটি। এর নীতিনির্ধারণ সবই স্বাধীন। ২০০ বছরের পুরনো ইউরোপের এ প্রতিষ্ঠানটি মুদ্রা পাচারকারীদের নিরাপদ স্বর্গ।
১৯০৭ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। এরপর থেকে ব্যাংকটির মুদ্রানীতি এবং সুশৃঙ্খল কার্যক্রম বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অনুসরণ করে। তবে পাচারকারীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে দেশটির পরিচিতি রয়েছে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০০২ সাল থেকে দেশভিত্তিক আমানতকারীদের তথ্য প্রচার শুরু করেছে তারা।
যেসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি রয়েছে, সেসব দেশের ব্যক্তিগত পর্যায়ে তথ্য দেয়া হয়। এর কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশিদের আমানত কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সুযোগ থাকলেও তা ব্যবহার করা হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশিরা সুইচ ব্যাংককে এখনও পাচার করা টাকা রাখার নিরাপদ স্থান হিসেবে মনে করে।
No comments:
Post a Comment