*ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে ভারতকে :চীনা সেনাবাহিনীর হুঁশিয়ারি *সিকিম সীমান্ত পরিদর্শনে ভারতীয় সেনা প্রধান
ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। সীমান্তে দুই দেশের সেনাবাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে আছে। ভারতকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার আহবান জানিয়েছে চীনা সেনাবাহিনী। পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে সৈন্যদের প্রস্তুতি দেখতে গতকাল বৃহস্পতিবার সিকিম সীমান্ত পরিদর্শন করেন ভারতীয় সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেই সমুদ্রে শক্তি দেখিয়েছে চীন। গতকাল সাংহাই বন্দরে নিজেদের সবচেয়ে শক্তিশালী রণতরীটিকে সামনে নিয়ে এসেছে চীন। ভারত চীনকে মোকাবেলায় বাণিজ্যকে ব্যবহার করতে পারে বলেও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
চীন ভারতীয় সেনাদের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের অভিযোগ তুলেছে। ভারতও পাল্টা অভিযোগ করেছে এবং চীন ভারতের দুটি বাঙ্কার উড়িয়ে দিয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। এরপর দুই দেশের মধ্যে দু’বার ফ্ল্যাগ মিটিং অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও কাটছে না ২৩ দিনের অচলাবস্থা। সিকিম-তিব্বত-ভুটান সীমান্তে ডোকা লা এলাকায় সেনাবাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে। ভারত তার সীমান্তে চার হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। চীনও পাল্টা সমসংখ্যক সেনা মোতায়েন করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘নো ওয়ার-নো পিস অবস্থা অর্থাত্ না যুদ্ধ, না শান্তি’। তবে পরিস্থিতি যে কোনো সময় ভিন্ন দিকে ঘুরে যেতে পারে বলেও জানান ওই সেনা কর্মকর্তা।
চীনা সেনাবাহিনীর হুঁশিয়ারি
চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির মুখপাত্র উ কিউইয়ান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ভারতকে ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পরাজয় থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। নয়াদিল্লির উচিত অবিলম্বে সিকিম সীমান্ত থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা। তিনি বলেন, চীন তার নিজের এলাকায় নতুন রাস্তা তৈরি করছে। ভুটানের জায়গায় নয়। মুখপাত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর মন্তব্য নিয়েও কড়া প্রতিক্রিয়া জানান। সমপ্রতি ভারতীয় সেনাপ্রধান বলেন, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যুতে চীন ও পাকিস্তানকে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত ভারত। কিউইয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাসিক ব্রিফিংয়ে বলেন, এই ধরনের মন্তব্য চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন। আমরা আশা করি, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওই ব্যক্তি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবেন এবং যুদ্ধাবস্থা তৈরির চেষ্টা বন্ধ করবেন। ব্রিফিংয়ে কিউইয়ান চীনের আক্রমণাত্মক অবস্থানের বিষয়টির দিকেও ইঙ্গিত দেন। চীনা সেনারা তিব্বত স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চলে ৩৫ টন ওজনের ট্যাংক চলতে পারে এমন রাস্তা তৈরি করছে। এই রাস্তা কোনো দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হচ্ছে না বলেও এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে জানান কিউইয়ান। তিনি বলেন, আমরা কেবল পরীক্ষা করছি। তিনি অভিযোগ করেন, ভারতীয় সেনারা অবৈধভাবে ডোকা লা এলাকায় প্রবেশ করে আমাদের সেনাবাহিনীর স্বাভাবিক কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমরা আমাদের কাজটি করেছি। ডোকা লা এলাকায় চীন ও ভুটানের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই বলেও জানান মুখপাত্র কিউইয়ান। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও পৃথক এক ব্রিফিংয়ে সিকিম সীমান্ত থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের জন্য ভারতের প্রতি আহবান জানিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লু ক্যাং বলেন, সমঝোতার পূর্বশর্ত এটি। তিনি সাংবাদিকদের চীনা সেনাবাহিনীর কাজের একটি মানচিত্রও দেখান।
ভারতের পক্ষ থেকে জানা গেছে, ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পর ১৪ হাজার ফুট উপরে ভারত, ভুটান ও চীন সামান্তে ডোকা লা মালভূমি এলাকায় ইন্দো টিবেটান বর্ডার পুলিশ (আইটিবিপি) মোতায়েন থাকে। আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে তাদের শিবির ১৫ কিমি ভিতরে। কিন্তু সেনাবাহিনীও ওই চত্বরে নিয়মিত লং রুট পেট্রলিং করে। সমপ্রতি সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়াররা ডোকা লা (পাস বা গিরিবর্ত্ম) পর্যন্ত সুন্দর রাস্তাও তৈরি করেছে। সেনাবাহিনীর সূত্র জানায়, ডোকা লা ভারতীয় সীমান্তের মধ্যে হলেও চীন ওই এলাকায় রাস্তা নির্মাণের ছক কষেছে। ফলে ওই সীমান্তে টহল বাড়িয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর থেকেই ওই অঞ্চলে অনেক অস্থায়ী বাঙ্কার রয়েছে। টহলদারির সময় সেখানে সেনারা বিশ্রাম নেন। মাস দু’য়েক আগে চীনা সীমান্ত বাহিনী ডোকা লা’র লালটেন এলাকার বাঙ্কারগুলো ভেঙে দিতে বলে। ভারত তাতে পাত্তা দেয়নি। এরপর থেকেই দুই বাহিনীর মধ্যে তত্পরতা বাড়তে থাকে। একেবারে উত্তরের ‘ফিঙ্গার টিপ’ অঞ্চল ছাড়া সিকিম সীমান্তে আর কোথাও কখনো আগে যা হয়নি। দু’পক্ষের সেনা ডোকা লা অঞ্চলে বারবার সামনাসামনি চলে আসতে থাকায় উত্তেজনা বাড়ে। ভারত সীমান্তে প্রবেশ করে চীন কেন রাস্তা তৈরি করছে, তা নিয়েও প্রতিবাদ জানায় ফোর্ট উইলিয়াম। গত ৬ জুন এ নিয়ে ফ্ল্যাগ মিটিংও হয়। কিন্তু তার দু’দিন পরই ৮ জুন চীনা সেনাবাহিনী ভারতের ভূখণ্ডে ঢুকে দু’টি বাঙ্কার গুড়িয়ে দেয়। এরপরই ভারতের সেনাবাহিনীর গ্যাংটকের ১৭ নম্বর ব্ল্যাক ক্যাট ডিভিশন থেকে এবং পরে সুকনার কোর কমান্ডারের অফিস থেকে বাড়তি সেনা পৌঁছায় ওই এলাকায়। সব মিলিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই চার ব্যাটেলিয়ন সৈন্য মোতায়েন করা হয়। চীনও বাড়তি সেনা মোতায়েন করে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ভারত ফ্ল্যাগ মিটিংয়ের অনুরোধ করে। কিন্তু কোনো জুনিয়র অফিসারের উপস্থিতিতে বৈঠক করতে চায়নি চীন। শেষ পর্যন্ত ২০ জুন ভারতের এক ব্রিগেডিয়ার এবং চীনের এক মেজর জেনারেলের উপস্থিতিতে সেই বৈঠক হয়। কিন্তু তাতেও সমস্যা মেটেনি। কারণ চীন কোনোমতেই আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে পিছিয়ে যেতে নারাজ। ফলে ভারতীয় সেনাও পূর্ণ প্রস্তুতি বজায় রাখছে।
সিকিম সীমান্ত পরিদর্শনে ভারতীয় সেনাপ্রধান
সিকিম পরিদর্শন করেছেন ভারতের সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত। সেনাবাহিনী সূত্র জানিয়েছে, জেনারেল রাওয়াতের এই সিকিম সফর আসলে রুটিনমাফিক। কিন্তু ভারত-ভুটান-চীন সীমান্তে উত্তেজনা হঠাত্ করে যেভাবে বেড়েছে, তার প্রেক্ষিতে সেনাপ্রধানের সিকিম যাওয়া এবং বাহিনীর প্রস্তুতি ও বিন্যাস খতিয়ে দেখার কর্মসূচিকে বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। ভারতীয় বাহিনী সিকিমে ঠিক কতটা প্রস্তুত তা নিজেই খতিয়ে দেখবেন সেনাপ্রধান। কোন অঞ্চলে বাহিনীর বিন্যাস কেমন, সীমান্তে কত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, সেসব নিয়ে বাহিনীর অন্য পদস্থ কর্তাদের সঙ্গে সেনাপ্রধানের আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
চীনের শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ
ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেই সমুদ্রে শক্তি দেখাল চীন। গতকাল সকালে সাংহাই বন্দরে নিজেদের সবচেয়ে শক্তিশালী রণতরীটিকে সামনে নিয়ে আসে বেইজিং। ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলোর তুলনায় এটি অনেক বেশি শক্তিশালী বলেই প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ভারত মহাসাগরে চীনের নৌ বাহিনীর ডুবোজাহাজগুলোর তত্পরতাও ভাবাচ্ছে নয়াদিল্লিকে। এই সময়েই শক্তি দেখাল চীন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদীর বৈঠকের ঠিক পরেই। চীন এমন চারটি ডেস্ট্রয়ার তৈরি করতে চলেছে, যার প্রথমটি গতকাল সামনে আনা হলো। প্রায় ১২ হাজার টন অস্ত্র বোঝাই এই রণতরী বিশ্বের প্রথমসারির যুদ্ধ জাহাজগুলোর অন্যতম। এতে প্রায় ১২০টি ক্ষেপণাস্ত্র রাখা যেতে পারে। তবে ভারত এখনো পর্যন্ত যেসব আধুনিক রণতরীর পরিকল্পনা করেছে, সেগুলোতে প্রায় ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র নেওয়া সম্ভব বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
তথ্যসূত্র : হিন্দুস্তান টাইমস, এনডিটিভি ও আনন্দবাজার পত্রিকা।
Thursday, June 29, 2017
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment