শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করা সম্ভব। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসে এমন একটি পরিকল্পনা করে অপহরণকারীরা। আর এরই অংশ হিসাবে গত ১১ জানুয়ারি যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগের পোলার মশার কয়েল ফ্যাক্টরির মালিক জাহাঙ্গীর হোসেনকে অপহরণ করে। পাঁচ কোটি টাকা মুক্তিপণ না পেয়ে তাকে (৪৬) খুনও করা হয়। পরে লাশ একটি লাগেজে ভরে মাইক্রোবাসে করে দাউদকান্দিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে ফেলে দেয়।
জাহাঙ্গীরে সাবেক প্রেমিকার পরিকল্পনায় তাকে অপহরণ করা হয়। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া সাবেক প্রেমিকা আফসানা আক্তার (২৬) আদালতের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এই খুনের ঘটনায় শনিবার বিকালে পুলিশ যাত্রাবাড়ী থেকে আফসানার স্বামী সৈকতের তিন সহযোগী নূর মোহাম্মদ, স্বাধীন ও ইউসুফকে গ্রেফতার করেছে।
গত ১৩ জানুয়ারি কুমিল্লার দাউদকান্দির গৌরিপুরে মহাসড়কের পাশ থেকে পুলিশ জাহাঙ্গীরের লাশ উদ্ধার করে। এর দুইদিন আগে তাকে অপহরণ করা হয়। পরে স্বজনদের কাছে ৫ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। খুনের ঘটনায় জাহাঙ্গীর হোসেনের ছোট ভাই হুমায়ন কবির বাদী হয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার এসআই পরিমল চন্দ্র দাস বলেন, আফসানার পরিকল্পনায় জাহাঙ্গীরকে ডেকে নিয়ে যাত্রাবাড়ির ২৮, শহীদ ফারুক সরনীর বাড়ির তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে আটকে রাখা হয়। এ কাজে সহযোগিতা করেন আফসানার স্বামী সৈকত। ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় সৈকতের সঙ্গে সেখানে একজন সন্ত্রাসী ও চার ভূয়া ডিবি পুলিশের পরিচয় হয়। শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে কোটি কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায়ের তারা পরিকল্পনা করে। জেল থেকে বের হয়ে স্ত্রীর কাছ থেকে শোনেন তার সাবেক প্রেমিকের কাহিনী। এরপর সেই সাবেক প্রেমিককেই অপহরণ করে কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করে। ঘটনাটির তদন্ত করতে গিয়ে আফসানা আক্তার ও তার সহযোগী ভূয়া ডিবি পুলিশ প্রতীককে গ্রেফতার করা হয়। আফসানা এ সংক্রান্ত আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন।
জবানবন্দী অনুযায়ী: দশ বছর আগে পূর্ব রায়েরবাগের দোতালা মসজিদ গলিতে জাহাঙ্গীরের বাড়ির পাশের বাড়িতে আফসানা সপরিবারের ভাড়া থাকতেন। এ সূত্র ধরেই তাদের মধ্যে পরিচয় এবং পরে প্রেমের পর্যায়ে গড়ায়। ঐ প্রেমের বছর দুয়েক পরেই আফসানার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। যাত্রাবাড়ীর ধলপুর এলাকায় সৈকত নামে এক যুবকের সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর জানতে পারে সৈকত একজন মাদক ব্যবসায়ী। কিন্তু করার কিছুই ছিল না বলে মাঝে মধ্যে মোবাইল ফোনে জাহাঙ্গীরের সাথে যোগাযোগ হতো। গত বছরের ৩০ জুন তার স্বামী সৈকত গাঁজাসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। ভ্রাম্যমান আদালত তাকে ৬ মাসের জেল দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। কারাগারে সন্ত্রাসী জহির ও চার ভূয়া ডিবি পুলিশ প্রতীক, ইউসুফ, নূর মোহাম্মদ ও স্বাধীনের সঙ্গে পরিচয় হয়। গত বছরের নভেম্বরে তার স্বামী জেল থেকে মুক্তি পায়।
জবানবন্দী অনুযায়ী আরো জানা গেছে, বাসায় ফেরার পর তার স্বামী তার কাছে প্রায়ই বলে যে একজন শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করা যেতে পারে। একটি ঘটনা থেকে কোটি টাকা পেলেই জীবন পরিবর্তন হয়ে যাবে। এমন কথায় তিনি সাবেক প্রেমিক জাহাঙ্গীরের তথ্য তার স্বামীর কাছে জানান। এক পর্যায়ে জাহাঙ্গীরকে অপহরণ করার পরিকল্পনা করা হয়। অপহরণের অংশ হিসাবে ২ জানুয়ারি একটি সিমকার্ড ও মোবাইল ফোনসেট কিনেন। ঐ মোবাইল ফোন দিয়ে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেন। ১১ জানুয়ারি তাকে তার বাসায় আসার কথা বলেন। ঐ দিন রাতে আফসানার বাসায় আসার কথা জানায় জাহাঙ্গীর। রাতে বাসায় আসলে আফসানা বিস্কুট ও চা খেতে দেন। আফসানা চায়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেন। এ চা পানের কিছু সময় পরে জাহাঙ্গীর দুর্বল হয়ে পড়েন। এ সময় আফসানা বাসার বাইরে থাকা তার স্বামী ও সহযোগীদের খবর দেন। তারা এসে জাহাঙ্গীরকে একটি চেয়ার বসিয়ে হাত-পা ও মুখ বেঁধে ফেলে। পরদিন দুপুরে মুক্তিপণের ১ কোটি টাকা নেয়ার জন্য আফসানা সাভার রওনা দেন। কিন্তু সেখানে কোন মুক্তিপণ না পেয়ে বাসায় ফিরে আসেন। ঐ দিন সন্ধ্যায় বাসায় জাহাঙ্গীরকে মারধর করা হয়। এক পর্যায়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় জাহাঙ্গীর মারা যায়। ১৩ জানুয়ারি ভোরে লাশটি একটি লাগেজে ভরে মাইক্রোবাসে করে দাউদকান্দিতে ফেলে দিয়ে আসেন।
No comments:
Post a Comment