সাম্বার দেশ ব্রাজিল। ফুটবল গ্যালারিতে সাম্বার খানিকটা নমুনার দেখা মিললেও এ নৃত্যের পূর্ণ রূপ দেখা যায় কার্নিভালের সময়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং জমকালো উৎসব ব্রাজিলের রিও কার্নিভালকে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎসবও বলা হয়। জাতি হিসেবে ব্রাজিলিয়ানরা যে কতটা শৌখিন রিও-এর এই কার্নিভালে। ব্রাজিলের রিও-ডি জেনিরোতে প্রতিবছর চন্দ্রবর্ষের প্রথম সপ্তাহে এ উত্সবটি অনুষ্ঠিত হয়। কেবল ব্রাজিলই নয়, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশেই এ সময় শুরু হয় কার্নিভালের মৌসুম।
গত বছর ২১শে ফ্রেব্রুয়ারী ব্রাজিলিয়ানরা জেগে উঠেছিল দেশের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বার্ষিক উৎসব কার্নিভাল উপভোগ করার জন্যে। নগরীর রাস্তায় নেমে আসে লক্ষ লক্ষ মানুষ। তার সঙ্গে শুধু রিও ডি জেনিরোতেই যোগ দিয়েছিলেন ৯ লাখ পর্যটক।
কার্নিভাল ব্রাজিলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছুটির দিন, এবং এই দিনগুলোতে সর্বোচ্চ সংখ্যক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। পুরো দেশের কাজকর্ম প্রায় এক সপ্তাহের জন্য সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে উপকূলবর্তী শহরগুলোতে রাত-দিন অনুষ্ঠান চলতে থাকে। বিয়ারের বিক্রয় সারা বছরেরে তুলনায় ৮০% বৃদ্ধি পায়, এবং কার্নিভালকে সামনে রেখে পর্যটকের আগমন বৃদ্ধি পায় প্রায় ৭০%।
পাঁচ দিনের এ উৎসব কেন্দ্র করে অদ্ভুত রঙে সাজে ব্রাজিল। রাজপথে ড্রাম আর সাম্বার তালে তালে নেচে ওঠে ব্রাজিল। আর তা দেখতে দেশ-বিদেশের লাখো পর্যটকে ভিড় জমায় রিও ডি জেনিরো, সাও পাওলো, পারনামবুকো, মিনাস জেরাইস সহ বিভিন্ন শহর। সাম্বা খাত থেকে গত বছর ব্রাজিল ৪২ কোটি পাউন্ড আয় করেছে।
কার্নিভাল শুরু হয় গালো দা মাদ্রুগা মিছিলের সাথে। ব্রাজিলের বৃহত্তম এই মহোৎসব বিশ্বের বৃহত্তম কার্নিভাল মিছিল হিসেবে গিনেস বুকের বিশ্ব রেকর্ডে স্থান পেয়েছে।
এই উৎসবের ইতিহাস বেশ পুরনো। এটি মুলত ১৬৪১ সাল থেকে চলে আসছে যখন ব্রাজিলের বিত্তবানরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ইউরোপ থেকে মাস্কারেইড পার্টি ভাড়া করে আনত। তাই পুরো উৎসবে এখনো কিছুটা ইউরোপীয় ফ্লেভার রয়েছে। রোমান ক্যাথলিকদের ধর্মীয় উৎসব হিসেবেই মূলত কার্নিভালের পরিচয়। যিশু খ্রিস্টের পুনরুত্থান দিবস 'ইস্টার' উপলক্ষে এ উৎসব পালন করে খ্রিস্টানরা। দেশ ও শহরভেদে কার্নিভাল শুরুর সময় ভিন্নতা থাকলেও সব উৎসবই শেষ করতে হয় 'ইস্টার'-এর অন্তত ৪০ দিন আগে।
ইতালি ও স্পেনে ৮০০ বছর আগেও ধর্মীয়ভাবে কার্নিভাল পালনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে কার্নিভালের এ ধর্মীয় পরিচয় গৌণ হয়ে গেছে অনেক আগেই। পশ্চিমা দেশগুলোতে এখন কার্নিভাল কেবল রোমান ক্যাথলিকদের বিষয় নয়। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষই অংশ নেয় এ উৎসবে।
ব্রাজিলের মানুষের কাছে অবশ্য রিও কার্নিভাল একান্তই উৎসবের উপলক্ষ। এ সময়টাতে নিজদের নাচ ও গানের দক্ষতা তুলে ধরতে সারা বছর প্রতীক্ষায় থাকে মানুষ। বছরজুড়ে চলে প্রস্তুতিও। এ প্রস্তুতির কেন্দ্রে থাকে সাম্বা।
রিও শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট সাম্বা ক্লাব গড়ে সমাজের সব স্তরের মানুষই উৎসবের প্রস্তুতি নেয়। কার্নিভালের সময় একটি প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে এই সাম্বা ক্লাবগুলো পৃথকভাবে শোভাযাত্রা বের করে। 'সাম্বোড্রোমো' নামের এ প্রদর্শনীই কয়েক বছর ধরে রিও কার্নিভালের মূল আকর্ষণ হয়ে আছে।
উৎসবের আগে প্রস্তুতি নিতে থাকা হাজারো সাম্বা স্কুল থেকে বের হয় সাম্বা ব্লক প্যারেড। প্রত্যেকটি প্যারেড ই মিউজিক আর গানের তালে চলতে থাকে ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী সাম্বা ড্যান্স। পুরো শহরের রাস্তায় লাল নীল হাজারো রঙের মেলা বসে। আর মানুষজন মাতিয়ে নাচে গানে মাতিয়ে রাখে পুরো রিও ডি জেনিরোকে।
সাম্বা নাচ ব্রাজিলের ঐতিহ্যের অংশ। ১৬ শতকে আফ্রিকা থেকে দাস আনা হয়েছিল ব্রাজিলে। এই দাসদের হাত ধরেই ব্রাজিলের বাহাই এবং রিও ডি জেনিরো প্রদেশে আমদানি হয়েছিল আফ্রিকার ধর্ম আর সংস্কৃতি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আফ্রিকার কালো মানুষদের বাটুক নাচ। কালের পরিক্রমায় ব্রাজিলের স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আফ্রিকার দাসদের আনা সংস্কৃতি মিলেমিশে সৃষ্টি হয় সাম্বা নাচ।
কিন্তু সাম্বা নামের উৎপত্তি এখনো এক রহস্য।
সাম্বা শব্দের উৎপত্তি নিয়ে কয়েকটি মতবাদ প্রচলিত আছে। আরবি শব্দ জুম্বা বা জাম্বা থেকে এর উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কিংবা অনেক আফ্রিকান ভাষার একটি কিমবুনদু থেকে শব্দের উৎপত্তি হছে; যেখানে স্যাম অর্থ দাও এবং বা অর্থ গ্রহণ কর।
আফ্রিকার অ্যাঙ্গোলা ও কঙ্গো থেকে জাহাজে ব্রাজিলে আনা দাসদের বোঝাতে সেম্বা শব্দটি ব্যবহার করা হতো। সেখান থেকেই সাম্বার উৎপত্তি। আরেক দলের মত, আরবি শব্দ জুম্বা বা জাম্বা থেকে সাম্বার উৎপত্তি। দ্বিতীয় দলের মতে, স্পেনে আরবের মুর শাসকদের কাছ থেকে শব্দটি ইউরোপে যায়। সেখান থেকে ব্রাজিলে পর্তুগিজদের কলোনি স্থাপনের সময় শব্দটি ওই দেশে স্থানান্তরিত হয়।
অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে সাম্বার দ্বৈত নৃত্য শহরাভিমূখী অগ্রসর হয়। ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে আন্তর্জাতিকভাবে এটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে।
১৯৬০-এর দশকে নতুন, কিঞ্চিৎ জাজ টাইপের বসা নোভাসঙ্গীতের সুর, স্বর, ছন্দ ব্রাজিলে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে।
১৮৭০ সালে সাম্বা প্যারেডে যোগ হয় মুখোশ এবং স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী পোশাক। সেরা সাম্বা স্কুল মনোনীত করতে থাকে ৪০ জন বিচারকের একটি প্যানেল। কার্নিভালের প্যারেডে অংশ নেয়া স্কুলগুলোর মধ্য থেকে তারা সেরা সাম্বা স্কুলকে নির্বাচন করেন।
১৯২০-এর দশকে গান ও নৃত্যকলায় এটি সম্পৃক্ত হয়। এটি বিশ্বের সর্বত্র ব্রাজিলের প্রতীক এবং ব্রাজিলীয়ান উৎসবের স্বীকৃতি পায়। সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আবেগ-অনুভূতিসম্পন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে এটি ব্রাজিলের জাতীয় পরিচয় বহন করছে। সাম্বা কারিওকার প্রধান শাখা বাহাইয়ের। সাম্বা ডি রোডা বা বৃত্তাকারে নৃত্য ২০০৫ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক হেরিটেজের মর্যাদা পায়।
সাম্বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বার্ষিক উৎসবে যোগদানের জন্য প্রতি বছর পাঁচ হাজারেরও বেশী ব্যক্তিকে প্রতিযোগিতা করার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। আধুনিক সাম্বা নৃত্য কোরাস গানসহযোগে বিংশ শতকের শুরুতে বিকাশ লাভ করে। ঐতিহ্যগতভাবে সাম্বায় তার সহযোগে ক্যাভাকুইনহো, বিভিন্ন ধরণের গিটারও নানাবিধ বাদ্যযন্ত্রের সংমিশ্রণ ঘটে। ২য় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে আমেরিকান অর্কেষ্ট্রায় এটি প্রভাব ফেলে।
যুদ্ধ-পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক অঙ্গন সমৃদ্ধিতে সাম্বা নৃত্যে ট্রমবোন, ট্রামপেট, বাঁশীচোরো, বাদকইত্যাদির ব্যবহার শুরু হয়। ছন্দ ও তালের পাশাপাশি সাম্বা বিভিন্ন বিষয়াদি তুলে এনেছে। তন্মধ্যে - ঐতিহাসিক খাদ্যসম্ভার, নানাবিধ নৃত্য (মিউদিনহো, কোকো, সাম্বা ডি রোডা এবং পেরান্দা), আমোদ-প্রমোদ, পোষাক হিসেবে লিনেন শার্ট ইত্যাদি অন্যতম। পাশাপাশি প্রাচীন চিত্রকর্মে নেলসন সার্গেন্তো, গিলহার্ম ডি ব্রিটো, হিতোর দোস প্রাজেরেস প্রমূখ চিত্রকরদেরকে তুলে ধরা হয়েছে।
সব কার্নিভালের উদ্দেশ্য একটিই মন খুলে আনন্দ করা। কার্নিভাল মানেই উন্মাতাল উৎসব। রাস্তায় রাস্তায় নানা বর্ণের পোশাকে বিরামহীন হৈ-হুল্লোড় আর নাচ-গান কার্নিভালের সবচেয়ে বড় পরিচয়। এ পরিচয়ের সবচেয়ে সার্থক প্রদর্শনী করে রিও ডি জেনিরোর মানুষ। তাই নানা স্থানে কার্নিভাল চললেও বিশ্ববাসীর নজর থাকে রিও'র দিকে। অনেকে কার্নিভাল রাজধানী হিসেবেও অভিহিত করেন রিও ডি জেনিরোকে।
রিও কার্নিভালের বিপুল এই জনপ্রিয়তা ব্রাজিলের অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখে। দেশটির বার্ষিক মোট পর্যটন আয়ের ৭০ ভাগই আসে কার্নিভালের সময়।
No comments:
Post a Comment