আশা পটাবি। ৯ বছর বয়সে বিক্রি হয়ে গিয়েছিলেন কলকাতার যৌনপল্লিতে। শবনম শিসোদিয়া। ৮ বছর বয়সে নিজেরই বাবা যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কল্যাণী চক্রবর্তী। ১৬ বছর বয়সে জোর করে বিয়ে দিয়েছিলেন অভিভাবকেরা। স্বামী নিজের বন্ধুদের সঙ্গে তাকে সহবাসে বাধ্য করেছিল দিনের পর দিন। সঙ্গীতা মণ্ডল। ৯ বছর বয়সে লোকের বাড়ি কাজে ঢুকে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। তার পরে বিক্রি হয়ে যান যৌনপল্লিতে। ওদের পেছনের গল্পগুলো সবার প্রায় একই।
ওরা মোট ১৯ জন। ছিঁড়েখুঁড়ে যাওয়া শৈশব-কৈশোর। বিধ্বস্ত শরীর, বিধ্বস্ত মন। তবু নাছোড়বান্দা জেদ। তীব্র লড়াই করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। ছিনিয়ে আনতে চাইছেন কাঙ্ক্ষিত ন্যায়, অধিকার, মুক্তি। নিজেদের জন্য ও নিজেদের মতো আরো অনেক মেয়ের জন্য। বার্তা দিচ্ছেন— যারা তাদের মতো অসংখ্য মেয়েকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে, তাদের আর রক্ষা নেই। তাদের শাস্তি দিতে সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধে নামতে চলেছে এই ভারতীয় মেয়েরা।
যৌন অত্যাচার থেকে উদ্ধার হওয়ার পরে এরা ঠাঁই পেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন হোমে। সেখানেই নতুন জীবন শুরু। দাঁতে দাঁত চেপে পড়াশোনা করে ভালো নম্বরে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছেন, স্নাতক হয়েছেন। পরে এক সর্বভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ‘ফ্রি আ গার্ল মুভমেন্ট’ এর মাধ্যমে সামিল হয়েছেন আঘাতকারীদের পাল্টা আঘাত দেওয়ার অভিযানে। ১৯ জনই এখন আইনজীবী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কলকাতার হোম থেকে রয়েছেন আশা, শবনম, কল্যাণী আর সঙ্গীতা।
জানা গেছে, তারা সবাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতি শুরু করেছেন। যাতে নিজেদের ও তাদের মতো অন্য নির্যাতিতাদের হয়ে মামলা লড়ে ন্যায় ছিনিয়ে আনতে পারেন। আর এজন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যাসাগর, বর্ধমান ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রাথমিক কথাও হয়েছে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার।
সংস্থাটির এক মুখপাত্র ফ্রান্সিস গ্রেসিয়াসের কথায়, ‘নারী পাচারের ঘটনায় আমাদের দেশে যতজন ধরা পড়ে, তার মধ্যে মাত্র ১০-১৪ শতাংশ শাস্তি পায়। বাকিরা ছাড়া পেয়ে অত্যাচারিত মেয়েদের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়ায়। বুক ফুলিয়ে ফের পাচার শুরু করে।’ তার বক্তব্য, ‘এই অবস্থা তখনই বদলাবে যখন নির্যাতনের অভিজ্ঞতা থাকা মহিলাই আইনজীবী হয়ে অন্য নির্যাতিতার পক্ষে আদালতে দাঁড়াবেন, সওয়াল করবেন। কারণ ওই মেয়েদের যন্ত্রণাটা তাদের মতো করে আর কেউ বুঝবে না।’
ঠিক এই কথাটাই বলছেন আশা, শবনম, সঙ্গীতা, কল্যাণীরাও। পাচার হয়ে উদ্ধার হওয়া মেয়েরা বছরের পর বছর আদালতের চক্কর কেটে যায়, সমাজে এক ঘরে হয়ে থাকে আর পাচারকারীরা অবলীলায় ঘোরে। এই অন্যায় বন্ধ করাটাই এখন তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আর এই লড়াইয়ের শুরুতে তারা ঠিক করেছেন, নিজেদের নাম ও মুখ লুকোবেন না। বরং এমন প্রত্যাঘাত দেবেন যাতে অন্ধকার জগতের কারবারিরাও মুখ লুকোতে মরিয়া হয়। আনন্দবাজার।
No comments:
Post a Comment