গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে দেশি-বিদেশি ২০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যাকারী জঙ্গিদের দু’জন বগুড়ার। তারা আহলে হাদিস মতাদর্শের অনুসারী ছিল। তাদের একজন মাদ্রাসায় ও অপরজন স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করেছে। তারা ছোটবেলা থেকেই ধার্মিক ছিল। পরিবারের সদস্যদের নামাজ, রোজা করতে ও পর্দা মেনে চলতে অনুরোধ করতো। সর্বশেষ ডিসেম্বরে দু’জনই বাড়িতে এসেছিল।
তাদের একজন হলো বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার চুপিনগর ইউনিয়নের বৃ-কুষ্টিয়া গ্রামের কৃষক আবুল হোসেনের ছেলে খায়রুল ইসলাম পায়েল। অপরজন হলো ধুনট উপজেলার ভারবাড়ি ইউনিয়নের বানিয়াজান গ্রামের কৃষক বদিউজ্জামানের ছেলে শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল।
জঙ্গি খায়রুল ইসলাম পায়েল: বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব শাজাহানপুর উপজেলার চুপিনগর ইউনিয়নের বৃ-কুষ্টিয়া গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন ও সুফিয়া বেগম দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে পায়েল সবার ছোট। এই পরিবার আহলে হাদিস-এর অনুসারী। খায়রুলের বড় দুই বোন হোসনে আরা ও জোস্নার বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে টিনের তৈরি তিনটি ঘর। ঘরে ভাল আসবাবপত্রও নেই। টিনের দরজায় পায়েলের হাতে আরবিতে ‘লা-ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স.)’ কলেমা লেখা।
বড় বোন হোসনে আরা জানান, তাদের আদরের পায়েল ছোটবেলা থেকেই ধার্মিক ছিল। সে স্থানীয় বৃ-কুষ্টিয়া দারুল হাদিস সালাফিয়া মাদ্রাসায় ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। এরপর পাশের বিহিগ্রাম এডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। ২০১৫ সালে সেখান থেকে আলিম (এইচএসসি) পাশ করেছে। সহপাঠী ও বন্ধু কামারপাড়া গ্রামের আবদুর রহমানের ছেলে আবদুল হাকিম তাকে (পায়েল) ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কথা বলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে সে বাড়িতে খুব কম আসা যাওয়া করতো। গত ডিসেম্বরে বন্ধু হাকিমের সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি এসেছিল। এরপর আর কোনও যোগাযোগ নেই।
তার বোনের দাবি, যদি তার ভাই খারাপ হয়ে থাকে তাহলে বন্ধু হাকিমের কারণে হয়েছে। সে তাকে ঢাকায় পড়াশোনা করানোর নামে বিপথে নিয়ে গেছে। তিনি ও পরিবারের সদস্যরা এখন খায়রুলের লাশের জন্য অপেক্ষা করছেন।
পাশের বাড়ির আবদুর রাজ্জাক জানান, পায়েলের পরিবার আওয়ামী লীগ বিরোধী ও জামায়াত সমর্থক। সে আহলে হাদিসের অনুসারী। জিহাদি বই পড়াশোনা করতো। তাকে গ্রামের একটি মসজিদে তারাবির নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হাত তুলে মোনাজাত না করায় গ্রামবাসী আপত্তি জানালে, সে মসজিদে নামাজ পড়ানো বন্ধ করে দেয়। সর্বশেষ প্রায় ৭ মাস আগে পাশের গ্রামের হাকিমের সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে বাড়িতে এসেছিল।
শাজাহানপুর উপজেলার চুপিনগর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদ্য বিদায়ী সদস্য শাহজাহান আলী জানান, গ্রামের দু’টি মাদ্রাসার কারণে অনেকে বিপথগামী হয়েছে। খায়রুল ইসলাম পায়েল, পার্শ্ববর্তী কামারপাড়া গ্রামের আবদুল হাকিম এবং এর আগে গ্রেফতারকৃত আবদুল মোমিনসহ অনেকে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। প্রভাবশালী হওয়ায় অনেকে গ্রেফতার হয়নি। আবার অনেকে গা ঢাকা দিয়েছে।
তবে হাকিমের মা সুফিয়া বেগম দাবি করেছেন, তার ছেলে জঙ্গি নয়, সে চাকরির জন্য গত ৩০ জুন রাতে আজারবাইজানে চলে গেছে।
তবে ওই ইউনিয়নের বর্তমান ইউপি সদস্য আবুল ফকির জানান, পায়েলের দাদা আওয়ামী লীগ সমর্থক হলেও তার বাবা কোনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেই। পায়েলের বন্ধু আবদুল হাকিম ‘বড় শয়তান’। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হাকিম হঠাৎ করে অনেক জমি ও সিএনজি অটোরিকশা কিনেছে। হয়তো জঙ্গি সংগঠন থেকেই তাকে টাকা দেওয়া হয়েছে। সে বিদেশে যাওয়ার নামে হয়তো দেশেই লুকিয়ে আছে। তাকে গ্রেফতার করতে পারলে এলাকার সব জঙ্গিকে শনাক্ত করা সম্ভব। পায়েলের বাবা ও মাকে ডিবি পুলিশ ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিল। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও লাশ শনাক্তসহ ডিএনএ পরীক্ষার জন্য রক্ত নেওয়া হয়েছে।
বগুড়া ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর আমিরুল ইসলাম জানান,খায়রুল ইসলাম পায়েল তাদের তালিকাভুক্ত জেএমবির জঙ্গি। এছাড়া গত ২৬ এপ্রিল রাতে কামারপাড়া মধ্যপাড়া গ্রাম থেকে জেএমবির ইসাবা গ্রুপের সদস্য আবদুল মোমিন ও তার সহযোগীকে একে-২২ রাইফেল, একটি পিস্তল ও ৫২ রাউন্ড গুলিসহ গ্রেফতার করা হয়। এই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েই গত বছরের ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় বগুড়ার শিবগঞ্জের চককানু গ্রামে মসজিদ-ই-আল মোস্তফা শিয়া মসজিদে গুলিবর্ষণ করলে মুয়াজ্জিন নিহত এবং ইমামসহ তিন মুসল্লি আহত হন।
জঙ্গি শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল: শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বলের ভাতিজি টাঙ্গাইল মেডিক্যাল কলেজের নার্সিং ডিপ্লোমার ছাত্রী কেয়া আকতার জানান, বদিউজ্জামানের তিন ছেলের মধ্যে উজ্জ্বল সবার ছোট। সে ২০০৫ সালে গোসাইবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০০৭ সালে গোসাইবাড়ি ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি ও ২০১১ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাশ করে। এরপর বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে মাস্টার্সে ভর্তি হয়। মাস্টার্সের ফরম ফিলাপ করলেও পরীক্ষা দেয়নি। উজ্জ্বল ডিগ্রি পাশ করার পরপরই ঢাকার আশুলিয়া থানার শাহজাহান মার্কেট এলাকার মাদারী মাদবর কেজি স্কুলে শিক্ষকতার চাকুরি নেয়। পাশাপাশি লেখাপড়াও চালিয়ে যাচ্ছিল। সে আশুলিয়া এলাকায় বড় ভাই গার্মেন্টস শ্রমিক আসাদুল ইসলামের বাড়িতে থাকতো। চার মাস আগে আসাদুল গার্মেন্টসের চাকরি ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসে। তখন উজ্জ্বল আরেকটি বাসা ভাড়া নিয়ে চাকরি করছিল। প্রতি মাসে বাড়িতে কিছু টাকাও পাঠাতো। বাড়িতে এলে সে সবাইকে পর্দা করতে এবং ঠিকমত নামাজ আদায় করতে পরামর্শ দিতো।
উজ্জ্বলের বড় ভাই আসাদুল ইসলাম বলেন, গত ডিসেম্বরে উজ্জ্বল ঢাকায় চিল্লায় যাওয়ার কথা বলে ধুনটের বাড়ি থেকে বের হয়। পরবর্তীতে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। সে কিভাবে ও কখন জঙ্গি হয়েছে তা পরিবারের অজানা।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,কিছুদিন আগে উজ্জ্বল কালো পোশাক ও মাথায় পাগড়ি বেঁধে এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছে এবং ইসলামের কথা বলেছে। কিন্তু তাদের তখনও ধারণা হয়নি এটি আইএসের পোশাক।
উজ্জ্বলের মা আসিয়া বেগম জানান, প্রায় ৭ মাস আগে উজ্জ্বল ঢাকায় চিল্লায় যাওয়ার নামে বাড়ি থেকে বের হয়। সে কিভাবে ও কখন জঙ্গি হয়েছে তা পরিবারের কারোর জানা নেই। গত ৪ জুলাই সকালে টিভিতে ছবি দেখে তিনি ছেলের লাশ শনাক্ত করেন। বিকালে পুলিশ এসে তার স্বামী বদিউজ্জ্বামান ও ছেলে আসাদুল ইসলামকে থানায় নিয়ে যায়। ছেলের চিন্তায় অসুস্থ আসিয়া বেগম অবিলম্বে উজ্জ্বলের লাশ ফেরত চান। তিনি তরুণ সমাজকে তার ছেলের মত জঙ্গি না হয়ে সঠিকভাবে লেখাপড়া ও বাবা-মার কথামত চলার পরামর্শ দেন।
গোসাইবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে সহপাঠী পার্শ্ববর্তী খোকসাবাড়ি গ্রামের শামীম আহমেদ জানান, উজ্জ্বল তার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল। সে লেখাপড়ায় ভাল ছিল এবং সব সময় সৎভাবে চলাফেরা করতো। তার বাবা বদিউজ্জামান আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। পুরো পরিবার হানাফী মাজহাবের হলেও সে আহলে হাদিস মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিল। পুলিশ তার বাবা ও ভাইকে ঢাকায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও বাবার শরীর থেকে রক্ত নিয়েছে। ঈদের আগেরদিন পুলিশ তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে।
জঙ্গি শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল এবং খায়রুল ইসলাম পায়েলের মরদেহ এক নজর দেখতে এবং দাফন করতে দু’টি পরিবারের সদস্যরা অপেক্ষা করছেন বলে তারা জানান। উজ্জ্বলের মা আসিয়া বেগম তার ছেলের এবং পায়েলের বড় বোন হোসনে আরা বেগম তার ভাইয়ের লাশ ফেরত চেয়েছেন।
No comments:
Post a Comment