প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকরা নানা সময়ে নানা কারণে সংবাদের শিরোনাম হন। আর এখন মালয়েশিয়া, বাহরাইন, কুয়েত সৌদিসহ নানা দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মানবেতর জীবন যাপনের খবর আমরা জানতে পারছি। বাংলাদেশের সহজ সরল সাধারণ মানুষের গন্তব্য হলো এই দেশগুলি। প্রবাসে পাড়ি দেওয়ার শুরু থেকেই এই সকল বাংলাদেশিরা কেউ নির্যাতিত আবার কেউ প্রতারণার শিকার হন। বিদেশে আমাদের রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেন। কেননা অনেক সময় দূতাবাস থেকে সহযোগীতাও পাওয়া যায় না।
প্রবাসে বাংলাদেশিদের নানা ধরণের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এম্ব্যাসীর ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন অভিবাসী বিষয়ক সাংবাদিক সংগঠনের অন্যতম একজন সংগঠক, সিনিয়র সাংবাদিক ফিরোজ মান্নান। ভয়েস বাংলার সঙ্গে আলোচনায় তিনি বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রদূতদের অবস্থা এমন যেন তারা হানিমুনে গিয়েছেন। কাজের জন্য তারা যায় কিনা আমার সন্দেহ আছে। একজন কর্মী যখন কাজের খোঁজে দেশের বাইরে যায় শুরু থেকেই তাকে নানা রকমের সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। প্রতি পদে পদে তাদের অপমানিত হতে হয়। এমন চাকরি তারা পায় যে দুই তিন বছর কাজ করেও খরচ উঠাতে হিমসিম খেতে হয়। দুই তিন বছর পরে অবৈধ হয়ে গেলে তখন তাদের লুকিয়ে থেকে কাজ করতে হয়। দেশে বাবা-মা ভাই বোনদের প্রত্যাশা পূরণ করতে প্রবাসে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয় তাদের।’
আমাদের দেশের মানুষগুলো বিদেশে গিয়ে যে ধরণের সমস্যার সম্মুখিন হয় সেই সমস্যার মূল রয়েছে দেশেই। কোন মতে একটু পড়াশুনা করে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি দিতে পারলে যেন অর্থের জন্য আর কোন চিন্তা করা লাগবে না। ব্যাপারটা এমন যেন তারা এক এক জন অর্থ উপার্জনের যন্ত্র। কিন্তু তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হতে খুব বেশি সময় লাগে না। কাজ শেষে প্রথম মাসের বেতন পেয়ে নিজের খরচের পর বাড়ীতে টাকা পাঠানো যখন কষ্টকর হয়ে উঠে তখন চাকরি পরিবর্তন করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়। কিন্তু ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটে না। সমস্যা বাড়তেই থাকে।
এ ধরণের সমস্যার সমাধান কি হতে পারে? এ বিষয়ে ভয়েস বাংলার সঙ্গে কথা বলেন মেহবুবা আফতাব সাথী। তিনি বলেন, ‘আমাদের সবার আগে মানুষের প্রতি মানবিক থাকতে হবে। সরকারী, বে-সরকারী উভয় পর্যায়েই এ বিষয়ে দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত। বিদেশে অদক্ষ শ্রমের বাজার এখন আর আগের মত নেই। এই সত্যটি সবাইকে বুঝতে হবে। যে কাজে দেশের বাইরে যাব সেই কাজে দক্ষ না হয়ে আমরা যেন না যাই। সরকারের পাশাপাশি রিক্রুটিং কোম্পানীগুলোর শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করা উচিত।’
তিনি আরো বলেন, ‘আর একটি বিষয় আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যারা যায় তারা আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ। এই মানূষগুলো বোঝেও না কোথায় গিয়ে কিভাবে কার সঙ্গে কথা বলতে হবে। সেজন্য আমি মনে করি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যারা রাষ্ট্রদূত হবে তাদের সাধারণ মানুষের মত হতে হবে। তাদেরকে প্রবাসীদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় আমাদের সাধারণ শ্রমিকরা এম্ব্যাসীতে লাইনে দাড়িয়ে কয়েক দিন পার করে দেয়। এ জন্য আমাদের রাষ্ট্রদূতদের একটু সদয় হতে হবে। বিদেশে কোন কোম্পানীতে আমাদের নাগরিকরা সমস্যায় পড়লে সঙ্গে সঙ্গে দূতাবাসের কাউকে পাঠিয়ে খোঁজ নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন আমাদের রাষ্ট্রদূতরা। সমস্যা হলে প্রয়োজনে রিক্রুটিং কোম্পানীকে ডেকে সমাধান করাবেন।’
সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা নানাবিধ সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছেন। তাছাড়া মাঝে মধ্যে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় বাংলাদেশিদের। সাম্প্রতিক সময়ে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের উপর যে ধরণের নির্যাতন হচ্ছে তা নজিরবিহীন। অবৈধ শ্রমিকদের ধরার নামে বৈধ অবৈধ সবাই হচ্ছেন নির্যাতিত। আর ট্যুরিস্ট ভিসায় ভ্রমণ করতে গিয়েও রেহাই পাচ্ছেন না বাংলাদেশিরা। কোনো কারণ ছাড়াই বাংলাদেশি টুরিস্টদের আটক করে জেলহাজতে পাঠানো হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশি ট্যুরিস্টসহ শ্রমিক থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ীদেরও আটক অবস্থায় থাকতে হচ্ছে। আর কিডন্যাপের মত ঘটনা তো ঘটে হরহামেশাই।
এছাড়া অন্যান্য দেশের প্রবাসী বাংলাদেশিদের অত্যাচারের খবর পাওয়া যায় নিয়মিত। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অবস্থাও ভয়াবহ। এর মধ্যে সৌদিতে অবস্থানরত বাংলাদেশিরাও ভালো নেই। বাস্তবতা হলো যেখানে সৌদিতে যেতে খরচ হওয়ার কথা এক দেড় লাখ টাকা সেখানে খরচ হয় সাত থেকে আট লাখ টাকার মত। এর পেছনে বড় বিষয় হলো বিভিন্ন সেক্টরে দালালের দৌরাত্ব। ফলে অনেক জায়গায় দিতে হয় টাকা।
প্রবাসীদের এই নানাবিধ সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে সেসব দেশের দূতাবাসের দায়িত্বশীল আচরণ সবার আগে দরকার। আর তা হলে আমাদের প্রবাসীরা পাশে পাবে সাহায্যের হাত। দেশের বাইরে তারা ভালো থাকবে। এজন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রদূতকে হতে হবে প্রবাসীদের বন্ধু।
No comments:
Post a Comment