ব্রাজিল থেকে মাংস আমদানিতে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীন, চিলি ও মিসর। এ সুবাদে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল।
খবর রয়টার্স ও এএফপি।
ব্রাজিলের রফতানিকৃত মাংসের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার চীন। দেশটি থেকে মাংস আমদানিতে চীনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়টিকে ব্রাজিলের মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সংহতির স্বীকৃতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন দেশটির কৃষিমন্ত্রী ব্লেয়ারো ম্যাগগি।
আন্তর্জাতিক বাজারে গরু ও মুরগির মাংসের বৃহত্তম রফতানিকারক ব্রাজিল। সয়া ও আকরিক লোহার পর ব্রাজিলের রফতানি আয়ের তৃতীয় বৃহত্তম উত্স হচ্ছে মাংস। গত বছর দেশটি গরু, মুরগি ও শূকরের মাংস রফতানি থেকে ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার আয় করেছে। চীনের সিদ্ধান্তে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ব্রাজিলিয়ান অ্যানিমেল প্রোটিন অ্যাসোসিয়েশন (এবিপিএ) বলেছে, ব্রাজিলের প্রাণিজ প্রোটিন খাতের জন্য চীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাজার।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, শনিবার থেকে চীনের বন্দরগুলোয় ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত মাংসের চালান খালাস করা শুরু হয়েছে। একই দিন ব্রাজিল থেকে মাংস আমদানিতে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে মিসর ও চিলি। দেশ দুটি যথাক্রমে ব্রাজিলের মাংসজাত পণ্যের তৃতীয় ও ষষ্ঠ বৃহত্ ক্রেতা।
বেইজিং, সান্তিয়াগো ও কায়রোর কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত ব্রাজিলের রুগ্ণ অর্থনীতির জন্য বিরাট সুখবর। প্রেসিডেন্ট মিশেল তেমার ও একাধিক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ব্রাজিলে অনেকের মনে অনাস্থার জন্ম দিয়েছে। উপরন্তু শতবছরের সবচেয়ে ভয়াবহ মন্দার কবল থেকে দেশটি মুক্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ব্রাজিলে একমাত্র মাংস রফতানি খাতটি সংকোচন এড়াতে পেরেছে। কিন্তু সপ্তাহখানেক ধরে এ খাতে বিরাট অনিশ্চয়তা ভর করেছিল।
ব্রাজিলের ফেডারেল পুলিশ ১৭ মার্চ মাংস প্রক্রিয়াকরণ খাতের ২১টি কোম্পানি ও কারখানার বিরুদ্ধে তদন্তের ঘোষণা দেয়। স্থানীয় কোম্পানিগুলো পচা মাংস বিক্রি এবং পণ্য প্রক্রিয়াকরণের যথাযথ মানদণ্ড ও বিধিনিষেধ অনুসরণ করছে না, এ মর্মে অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তদন্ত শুরু করে। বিশ্বে গরুর মাংসের বৃহত্তম রফতানিকারক জেবিএস ও মুরগির মাংসের বৃহত্তম রফতানিকারক বিআরএফের কয়েকটি কারখানাও পুলিশের তদন্তের আওতায় আসে। পুলিশের তল্লাশি ও তদন্তের খবরে কোম্পানি দুটির শেয়ারমূল্যে ধস নামে।
অপারেশন উইক ফ্লেশ শিরোনামের এ তদন্তের খবরে সবচেয়ে বড় ধসের মুখোমুখি হয় ব্রাজিলের সার্বিক মাংস রফতানি। ১৫০টির বেশি দেশে মাংস রফতানি করে ব্রাজিল। দেশটি গরু ও মুরগির মাংসের বৈশ্বিক রফতানির যথাক্রমে ২০ ও ৪০ শতাংশ জোগান দেয়। পচা মাংস বিক্রির অভিযোগ প্রকাশের পর ২৫টি দেশ ব্রাজিল থেকে মাংস আমদানিতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে।
পুলিশি অভিযানের পরদিন ব্রাজিল থেকে মাংস কেনা বন্ধের ঘোষণা দেয় বিশ্বে পণ্যটির বৃহত্তম আমদানিকারক ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। জাপান ও মেক্সিকো একই পদক্ষেপ নেয়। এর পর চীন, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ ব্রাজিল থেকে মাংস আমদানি স্থগিতের ঘোষণা দেয়। ব্রাজিলের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, ১৭ মার্চ থেকে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত চারদিনে মাংস রফতানি ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ হ্রাস পায়।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্রাজিল সরকার জরুরি পদক্ষেপ নেয়। ব্রাজিলের কৃষিমন্ত্রী ব্লেয়ারো ম্যাগগিসহ পদস্থ কর্মকর্তারা বিশ্বের নানা প্রান্তে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ফোনালাপ, ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন। সে দেশের প্রেসিডেন্ট মিশেল তেমার ব্রাসিলিয়ায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ১৬৩টি সদস্য দেশের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে ব্রাজিল সরকার সে দেশের বিরাট নির্ভরতার খাতটিতে ‘একতরফা’ নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করার আবেদন জানায়। এছাড়া দেশে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগসাজশের বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ৩৩ জন পরিদর্শকের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেয়।
ব্রাজিলের জোরালো বাণিজ্য কূটনীতি ও যোগাযোগের প্রতিদান মিলছে। চিলি, মিসর ও চীন আগেকার ঢালাও স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে শুধু তদন্তাধীন ২১টি মাংস প্রক্রিয়াকরণ কারখানাকে নিষিদ্ধ তালিকায় রেখেছে। এর আগে দক্ষিণ কোরিয়া একই পদক্ষেপ নিয়েছে।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট মিশেল তেমার আজকালের মধ্যে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলবেন। চীনের সিদ্ধান্তটি ব্রাজিলের জন্য বিশেষ গুরুত্ববহ। ব্রাজিলের গরুর মাংসের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার চীন। এছাড়া দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির মুরগির মাংসের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও শূকরের মাংসের তৃতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক চীন।
চীনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ব্রাজিল ভাগ্যেরও কিছুটা সুবিধা পেয়েছে। ব্রাজিলের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো চীনের বিরাট চাহিদা মেটাতে সমর্থ নয়। চীনে গরুর মাংসের দ্বিতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারক অস্ট্রেলিয়া গতবারের খরার পর এখনো নিজেদের গরুর পাল গুছিয়ে নিতে পারেনি। অস্ট্রেলীয় রফতানিকারকরা চীনা বাজারের বর্ধিষ্ণু চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
মুরগির মাংসের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এক্ষেত্রে চীনের আমদানি চাহিদার ৮৫ শতাংশ জোগান দেয় ব্রাজিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের পোলট্রি উত্পাদকরা বার্ডফ্লুর কারণে আগে থেকেই চীনে নিষিদ্ধ হয়ে আছে। বিকল্প উেসর অনুপস্থিতিও চীনের সর্বশেষ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট মিশেল তেমার চীনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ‘আশা করছি, অন্য দেশগুলোও চীনের মতো পদক্ষেপ নেবে’।
No comments:
Post a Comment