থলের বিড়াল বেড়িয়ে গেছে’- জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণার নিন্দা করবে না মোদীর সরকার। ট্রাম্পের ঘোষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব, রাশিয়া, চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
কিন্তু ভারত জেরুজালেম বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলছে, এ নিয়ে ভারতের অবস্থান স্বাধীন এবং দৃঢ়। নিজস্ব মত এবং আগ্রহের জায়গা থেকেই এই অবস্থান তৈরি হয়েছে। কোনো তৃতীয় দেশের অবস্থান দেখে তা তৈরি হয়নি।
গ্লোবাল ভিলেজ স্পেসের এক নিবন্ধে এম কে ভদ্রকুমার লিখেছেন, এরকম কৌশলে পরিহার করার কপটতা কেন ভারতের? মোদী সরকারের উচিত প্রবল বৈশ্বিক মতামতের পাশে থাকা অথবা তাকে স্বীকার করে নেয়ার সাহস দেখাতে হবে যে ভারত একটি ইহুদিবাদী নীতিমালা অনুসরণ করছে।
এখানে আসলে লুকনোর মত কিছু থাকার কথা নয়, প্রধানমন্ত্রী মোদী ইসরাইল সফরে প্রকাশ্যেই প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে নিয়ে জায়নবাদ প্রতিষ্ঠাতার সমাধিতে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছেন।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং জায়নবাদ নীতিগতভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত। এই নৈতিক উভয়সঙ্কট অন্য কোনোভাবে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু মোদী সরকারের জন্য এখন রাজনৈতিক যৌক্তিকতা নৈতিকতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তারা এখন কোনোভাবেই মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বিরক্ত করতে চায় না। এছাড়াও নেতানিয়াহু আশা করেন যে মোদী তার পাশে দাঁড়াবেন। কারণ, অনেক জল্পনার পর ইসরাইল ও ভারতীয় কোম্পানিগুলো উন্নত ড্রোন তৈরির জন্য যৌথ উদ্যোগের যুগে প্রবেশ করছে।
কিন্তু তারপরেও এখানে একটি তীব্র আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব জড়িত। জেরুজালেম নিয়ে ট্রাম্পের ঘোষণায় মোদীর সরকারের অনেক কিছু পাওয়ার আছে।
মোদী সরকার তার নিজস্ব ‘জেরুজালেম ঘোষণার’ প্রস্তুতি নিচ্ছে। তা হল অযোধ্যায় হিন্দু মন্দির নির্মাণ (যেখানে বাবরি মসজিদ ছিল)।
পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু প্রতীকী অর্থটি একেবারে একই – একটি ‘নিষ্পন্ন কার্য’ তৈরি করে প্রতিদ্বন্দ্বীকে জোর পূর্বক তার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য করা।
জেরুজালেম ও অযোধ্যা উভয়ই বিস্ফোরক বিষয়। বিশ্ব যেখানে বিভিন্ন ধরনের উত্তেজনা এবং বিভিন্ন ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা নিয়ে জর্জরিত করা সেখানে আরো বিষ ছড়ানোর সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
এ ধরণের বিষাক্ত আচরণ নিরর্থক এবং ঝুঁকিপূর্ণ যদি না তা সম্মিলিতভাবে একটি বৃহত্তর কাঠামো ও ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে করা হয়।
তবে ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন উভয়ের জন্য এটি তাদের ক্ষমতার ‘মূল সমর্থকগোষ্ঠী’কে শান্ত করতে এবং বিদ্যমান বা শীঘ্রই প্রত্যাশিত বাধা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে গেছে।
স্পষ্টতই, কংগ্রেস ট্রাম্পকে অভিশংসনের চেষ্টা করলে নিজেকে উদ্ধার করতে ইহুদি লবি এবং তার খৃস্টান সমর্থক বেসের উপর নির্ভর করবেন ট্রাম্প।
যদি মাইকেল ফ্লিন এফবিআই স্পেশাল প্রসিকিউটর মুয়েলারের কাছে স্বীকার করেন যে ট্রাম্পের জামাতা জ্যরেড কুশনার (যে কিনা একজন ইহুদী) প্রচারাভিযানের সময় ট্রাম্পে নির্দেশে রুশদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তাহলে অভিশংসন খুব দূরে নয়।
ভারতেও, ক্ষমতাসীন অভিজাতদের ‘মূল সমর্থকগোষ্ঠী’র অবস্থা এখন আশাব্যঞ্জক নয়। দাউদ ইব্রাহিম এখনো পাকিস্তানে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ খুব বেশি সাফল্য পাচ্ছে না।
এখন সেরা বিকল্প হল ট্রাম্পের কৌশল অনুসরণ করা সমর্থন বেসের আস্থা বাড়ানোর এবং জনমত বিক্ষিপ্ত করে তোলা। অদ্ভুত ঘটনা হল, জেরুজালেম নিয়ে ট্রাম্পের ঘোষণা এবং অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের ২৫তম বার্ষিকী একই দিনে, ৬ ডিসেম্বর।
ট্রাম্পকে আন্তর্জাতিকভাবে বেশ উপহাস করা হচ্ছে এবং মার্কিন ‘মধ্য প্রচ্য নীতি’ এখন আমূল পরিবর্তিত হয়েছে। তবে ট্রাম্প অন্তত ভারতের সমর্থন পাবেন আশা করা হচ্ছে। কথায় বলে ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’।
তবে এখানে বড় জয়ী পক্ষটি হবে চীন। বেইজিং সম্ভবত এটি প্রত্যাশা করছিল।
এই ৬ ডিসেম্বর ট্রাম্প ঘোষণার আগেই বেইজিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা রিপোর্টটি লক্ষ করেছি এবং প্রাসঙ্গিক অগ্রগতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা ওই অঞ্চলে সম্ভাব্য উত্তেজনা বেড়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন। জেরুজালেম একটি জটিল এবং সংবেদনশীল বিষয়। সব দলই আঞ্চলিক শান্তি ও শান্তি বজায় রাখবে, সাবধানতা অব্যাহত রাখবে এবং দীর্ঘমেয়াদে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের জন্য বা অঞ্চলের নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়িয়ে চলবে বলে আমরা আশা করি।’
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আরো বলেন, ‘চীন দৃঢ়ভাবে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সমর্থন করে। ফিলিস্তিনী জনগণের বৈধ ন্যায্য অধিকার পুনর্বহাল এবং ১৯৬৭ সালের সীমান্ত অনুসারে পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে আমরা ফিলিস্তিনের আইনসঙ্গত দাবী সমর্থন করি। আমরা সব পক্ষকে আলোচনার মধ্য দিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি এবং জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিকাশের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার আহ্বান জানাই।’
চীন এবং মুসলিম বিশ্বের মধ্যে দূরত্ব নেই। কিন্তু, এখন থেকে ভারত ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে শুধু দূরত্ব নয় বিরোধও তৈরি হতে পারে।
No comments:
Post a Comment