Social Icons

Sunday, December 10, 2017

অর্থনৈতিক কারণেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছে বাংলাদেশীরা

অনটনের মধ্যেই কোনোমতে কলেজের গণ্ডি পেরোন নাহিদ ইসলাম। এরপর রোজগারের তাগিদ থাকলেও কাজের সুযোগ হয়নি। এ অবস্থায় তাকে টানতে থাকে প্রতিবেশী বেলালের ইতালি গিয়ে সচ্ছলতা ফেরানোর গল্প। পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের উৎসাহে ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনিও। এজন্য প্রথমেই যান লিবিয়ায়। সেখানে আট মাস থাকার পর ইতালির উদ্দেশে পাড়ি জমান ভূমধ্যসাগর। সম্প্রতি পৌঁছান ইতালির অ্যাপুলিয়ায়।
লিবিয়া থেকে ইতালি পৌঁছাতে চট্টগ্রামের বাসিন্দা নাহিদকে উঠতে হয়েছিল একটি কাঠের নৌকায়। এজন্য তার খরচ হয় ১ হাজার ইউরো। নাহিদের ভাষায়, নৌকায় সোমালিয়াসহ আফ্রিকার আরো দেশের নাগরিকরাও ছিল। যাত্রাটাও ছিল ভয়ঙ্কর। সাঁতার জানি না, তার পরও সমুদ্র পাড়ি দেয়ার ঝুঁকিটা নিয়েছিলাম শুধু আর্থিক সচ্ছলতার আশায়।
অর্থনৈতিক কারণে নাহিদের মতো হাজারো বাংলাদেশী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) প্রতিবেদন বলছে, ঝুঁকি জেনেও অবৈধ পথে ইউরোপে পাড়ি জমানো বাংলাদেশীদের মধ্যে ৭২ শতাংশই যাচ্ছে শুধু অর্থনৈতিক কারণে। যদিও কাঙ্ক্ষিত দেশে পৌঁছানোর পর অনেকেরই স্থান হচ্ছে কারাগারে।
ইতালি, গ্রিস, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, সার্বিয়া ও মেসিডোনিয়ায় অবস্থান করা ৮ হাজার ২৪৬ জন অভিবাসীর সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে আইওএম। ইতালিতে সাক্ষাত্কার নেয়া হয়েছে ৫২টি স্থানে অবস্থানরত ৪ হাজার ২৮৬ অভিবাসনপ্রত্যাশীর। আর সার্বিয়া, গ্রিস, মেসিডোনিয়া, হাঙ্গেরি ও বুলগেরিয়ার ৩৪টি ট্রানজিট, এক্সিট ও এন্ট্রি পয়েন্টে সাক্ষাত্কার নেয়া হয়েছে ৩ হাজার ৯৬০ জনের। এর ভিত্তিতে ‘মিক্সড মাইগ্রেশন ফ্লোজ ইন দ্য মেডিটারিনিয়ান অ্যান্ড বিয়ন্ড ফ্লো মনিটরিং ডাটা অ্যানালাইসিস: জুলাই ২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রকাশ করেছে আইওএম।
এতে দেখা গেছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়া বাংলাদেশীদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই শুধু অর্থনৈতিক কারণে ভয়ঙ্কর এ পথ বেছে নিচ্ছে। এরপর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছে সহিংসতার কারণে। পাশাপাশি মৌলিক সেবার সীমাবদ্ধতা ও মানবিক সহায়তার অভাবের কারণেও বিপজ্জনক এ পথ বেছে নিচ্ছে কেউ কেউ। অনেকে আবার একাধিক কারণেও এ পথে হাঁটছেন। অন্যান্য দেশের নাগরিকরা অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিলেও মুখ্য কারণ অর্থনৈতিক নয়। সহিংসতার কারণেই মূলত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে অভিবাসী হওয়ার চেষ্টা করছে তারা। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়া পাকিস্তানি নাগরিকদের মধ্যে ৯১, নাইজেরিয়ার ৫৬ ও গিনির ৪৭ শতাংশই সহিংসতার কারণে ভয়াবহ এ পথ বেছে নিচ্ছে। এসব দেশের নাগরিকরাও অর্থনৈতিক কারণে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছে। তবে তা দ্বিতীয় প্রধান কারণ।
বাংলাদেশীদের ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে পাড়ি দেয়ার প্রক্রিয়াটা অনেক দিন ধরেই চলছে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছলতার হাতছানিই এর অন্যতম কারণ। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের ওইসব দেশে গিয়ে সচ্ছলতার খবরে আকৃষ্ট হয়েই এ পথ বেছে নিচ্ছে তারা। যদিও দেশগুলোয় প্রবেশ করতে গিয়ে প্রতিবছরই বিভিন্ন সীমান্তে ধরা পড়ছে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী। এটা বন্ধে সবার আগে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি বিদেশী কারাগারগুলোয় যারা আটক আছে, তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
২০১৭ সালের প্রথম সাত মাসে ইতালি, গ্রিস, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, সার্বিয়া ও মেসিডোনিয়ায় ঢোকা যেসব অভিবাসীর সাক্ষাত্কার নেয়া হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাইজেরীয়— ১৪ শতাংশ। এছাড়া পাকিস্তানি রয়েছে ৯, গিনিয়ান ৮, গাম্বিয়ান ৮ ও বাংলাদেশী ৭ শতাংশ। অবশিষ্ট ৫৪ শতাংশ ৩০টি ভিন্ন ভিন্ন দেশের নাগরিক।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচটি প্রধান দেশ থেকে আসা অভিবাসীর অধিকাংশের বয়স ২০ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী গিনি ও গাম্বিয়ার অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। তাদের গড় বয়স ২০ বছর। আর সবচেয়ে বেশি বয়স পাকিস্তানি অভিবাসীদের, গড়ে ২৭ বছর। এছাড়া নাইজেরিয়ানদের গড় বয়স ২৪ ও বাংলাদেশীদের ২৩ বছর।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের শিশু হিসেবে ধরা হয়েছে। এ বয়সীরা মোট অভিবাসনপ্রত্যাশীর ২০ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে ১৪-১৭ বছর বয়সীদের হার গড়ের চেয়েও বেশি— ২২ শতাংশ। এছাড়া এ বয়সী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে গাম্বিয়ার নাগরিক রয়েছে ৩৩, গিনির ৩২, নাইজেরিয়ার ৮ ও পাকিস্তানের ৩ শতাংশ।
তবে অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশীদের বয়সের বিষয়টিতে দ্বিমত পোষণ করেন অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়া ২২ শতাংশ বাংলাদেশী শিশু বলে আইওএম যে তথ্য দিচ্ছে, সেটি আসলে ঠিক নয়। কারণ এ পথে যারা যাচ্ছে, তাদের প্রকৃত বয়স অনেক সময় তারা নিজেরাও জানে না। বয়সের প্রমাণপত্রও তাদের কাছে থাকে না।
আইওএম বলছে, প্রায় ৫২ শতাংশ অভিবাসী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার আগে অন্য কোনো দেশে এক বছর অবস্থান করে। পরবর্তীতে তারা ইউরোপের পথে পাড়ি দেয়। বাংলাদেশীদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ এ পন্থায় ইউরোপে পাড়ি দেয়। এছাড়া পাকিস্তানি ৫০ শতাংশ, ৩৯ শতাংশ নাইজেরিয়ান, ৩৭ শতাংশ গিনিয়ান এবং ৩৬ শতাংশ গাম্বিয়ান।
জানা গেছে, সুসংগঠিত মানব পাচার চক্রগুলো অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশীদের প্রথমে আকাশপথে ইস্তাম্বুল অথবা দুবাই হয়ে লিবিয়ায় নিয়ে রাখে। লিবিয়ায় অবস্থানকালীন এ সময়টায় ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হতে হয় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের। পরবর্তীতে ইউরোপের উদ্দেশে ভূমধ্যসাগরের বিপজ্জনক পথে ছেড়ে দেয়া হয় তাদের। প্রতিদিন শখানেক নৌকা লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগরের উদ্দেশে ছাড়ে, যেগুলোর প্রতিটিই অভিবাসনপ্রত্যাশীতে ঠাসা থাকে। বাংলাদেশের পাশাপাশি চক্রটির নেটওয়ার্ক রয়েছে পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, আইভরি কোস্ট ও গিনির মতো দেশেও।
পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে কেউ যাতে সাগরপথে পাড়ি না দেন, সেজন্য এলাকাভিত্তিক প্রচারণা চালানো হচ্ছে বলে জানান জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. সেলিম রেজা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সরকার সমুদ্রপথে বিদেশ পাড়ি না দেয়ার জন্য প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। সেসঙ্গে বিদেশে চাকরির নামে কেউ যাতে দালালের খপ্পরে না পড়ে, সে ব্যাপারেও জনসচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে। তার পরও দালালদের প্ররোচনায় সাগরপথে ইতালি পাড়ি দেয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে অনেকে।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বিদেশ গমন প্রতি বছরই বাড়ছে। ২০১৫ সালে বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়ে ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ জন বাংলাদেশী বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমালেও ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জনে। আর চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছে ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৭৭৩ জন বাংলাদেশী।

No comments:

Post a Comment

 

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি

সম্পাদকীয় কার্যলয়

Rua padre germano mayar, cristo rio -80040-170 Curitiba, Brazil. Contact: +55 41 30583822 email: worldnewsbbr@gmail.com Website: http://worldnewsbbr.blogspot.com.br

সম্পাদক ও প্রকাশক

Jahangir Alom
Email- worldnewsbb2@gmail.com
worldnewsbbbrazil@gmail.com
 
Blogger Templates