মহানবী (সা.)-কে বিশ্ব মানবতার উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে। তিনি যেমন আরবের নবী, তেমনি আমেরিকার নবী, তেমনি আফ্রিকার নবী, তেমনি বাংলাদেশের নবী, তেমনি ভারতের নবী, তেমনি চীনের নবী।
তিনি গোটা বিশ্বের নবী। ইরশাদ হয়েছে, 'পরম কল্যাণময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফয়সালার গ্রন্থ অবর্তীণ করেছেন, যাতে সে বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারে । ' (সুরা ফুরকান, আয়াত : ১)
অন্য আয়াতে এসেছে, 'বলে দাও, হে মানবমন্ডলী। তোমাদের সবার প্রতি আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসুল, গোটা আসমান ও জমিনে যাঁর রাজত্ব। ' (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৫৮)
প্রশ্ন হলো, মহানবী (সা.) যদি বিশ্বের নবী হন, তাহলে শুধু আরবে কেন এসেছেন? এর কয়েকটি কারণ রয়েছে।
প্রথমত, ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে মক্কা ও আরব উপদ্বীপ এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্যস্থলে অবস্থিত। মক্কানগরী পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় মহান আল্লাহ কাবাঘর মক্কায়ই স্থাপন করেন। ভৌগোলিকভাবে সৌদি আরবই পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। পৃথিবীর প্রথম ভূমিই মক্কা বা বাক্কা।
ইসলাম আসার বহু আগ থেকে মক্কা ঐতিহাসিক নগরী। বহু নবী-রাসুলের পদচিহ্ন লেগে আছে এই পুণ্যভূমিতে। কাবার নিচের অংশটুকু পৃথিবীর প্রথম জমিন। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকেই চতুর্দিকে বিস্তৃতি লাভ করেছে। প্রথমে একটি বিশাল মহাদেশ সৃষ্টি হয়। এ কারণে মক্কা শরিফকে উম্মুল কুরা বা নগরীগুলোর মূল বলে অভিহিত করা হয়েছে। (তারিখে তাবারি : ১/৪৯; আল-বাদউ ওয়াত্তারিখ : ৪/৮১-৮২)
উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালক ড. খালিদ বাবতিনের নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণায় এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে সৌদি আরবে অবস্থিত পবিত্র কাবাই পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। (আল আরাবিয়া : ২৩ জুলাই, ২০১২)
আরেকটি বিষয় আমরা জানি যে বছরের বিশেষ একটি দিন দুপুরে সূর্য ঠিক মাথার ওপর থাকে। তখন পবিত্র কাবা বা মক্কায় অবস্থিত কোনো অট্টালিকায় ছায়া দৃষ্টিগোচর হয় না। যেমন—২০১৪ সালের ২৮ মে দুপুর ১২টা ১৮ মিনিটে সূর্য ছিল পবিত্র কাবার ঠিক মাথার ওপরে। (কালের কণ্ঠ : ২৮ মে, ২০১৪)
পৃথিবীর আর কোথাও এমনটি হয় না। এ জন্যই মহানবী (সা.)-কে আরবে পাঠানো হয়েছে, যাতে পৃথিবীর চারদিকে সত্যের আওয়াজ সমানতালে দ্রুত পৌঁছে যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর এভাবেই আমি তোমার ওপর আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল করেছি, যাতে তুমি মূল জনপদ ও তার আশপাশের বাসিন্দাদের সতর্ক করতে পারো, আর যাতে একত্রিত হওয়ার দিনের ব্যাপারে সতর্ক করতে পারো, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। ’ (সুরা : শুরা, আয়াত : ৭)
দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্যের দিক থেকেও মক্কানগরী মানবসভ্যতার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। এ নগরীতে হাজেরা (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত সাফা-মারওয়া, জমজম কূপ ও জান্নাতি পাথর হাজরে আসওয়াদসহ আল্লাহ তায়ালার অনেক নিদর্শন রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৫৮)
এজন্য মহানবী (সা.)-কে আরবে পাঠানো হয়েছে।
এজন্য মহানবী (সা.)-কে আরবে পাঠানো হয়েছে।
তৃতীয়ত, মহানবী (সা.)-এর সময়ে পৃথিবীর মধ্যে নামিদামি ও আলোচিত জাতি ছিল চারটি। রোম, পারস্য, গ্রিক ও হিন্দুস্তানি। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসব দেশে সভ্যতার কিছুটা হলেও ছোঁয়া লেগেছিল।
ভারতে সিন্ধু সভ্যতা। রোম ও পারস্যে রাজা-বাদশাহ ও সাম্রাজ্যবাদী কর্মতৎপরতা ছিল। গ্রিক দর্শন ছিল গ্রিসে। কিন্তু আরবে কোনো সভ্যতার ছোঁয়া লাগেনি। তারা ছিল একেবারে আদিম ও অজ্ঞ। মহনবী (সা.)-এর সময়ে মাত্র ১৭জন শিক্ষিত মানুষ ছিল গোটা আরবে।
মহানবী (সা.)-কে সেখানে পাঠানো হয়েছে নতুন সভ্যতার জন্ম দেওয়ার জন্য। তিনি আরব সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন, একজন মহামানব কিভাবে একটি পতিত জাতিকে বিশ্বের প্রথমসারীর জাতিতে পরিণত করেছেন। তিনি কারো কাছ থেকে সভ্যতার জ্ঞান শিখেননি। তিনি কারো কাছ থেকে কপিপেস্ট করেছেন, এ কথা যেনো কেউ বলতে না পারে, তাই তাঁকে অজ্ঞদের মধ্যে পাঠানো হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, 'তিনিই (আল্লাহ) নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ, তাদের পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত। ' (সুরা জুমুআ, আয়াত : ২)
চতুর্থত, আরবি প্রাচীন ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশেই আরবি ভাষা ব্যবহূত হয়। যেমন—সৌদি আরব, কুয়েত, ইরাক, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন ও মিসরসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরও বেশ কয়েকটি দেশে এ ভাষাভাষীর সংখ্যা অনেক বেশি। এটি সেমিটীয় ভাষা পরিবারের জীবন্ত সদস্যগুলোর অন্যতম। প্রাচীন কবিদের কবিতা কিংবা সাহিত্যে আরবি ভাষার ব্যবহার ছিল লক্ষ করার মতো। মধ্যযুগে আরবি গণিত, বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রধান বাহক ভাষা ছিল। বিশ্বের বহু ভাষা আরবি থেকে শব্দ ধার করেছে। মহান আল্লাহ চেয়েছেন, তাঁর প্রিয় হাবিবকে এ ভাষাভাষী করে পাঠাবেন। তাই তিনি মহানবী (সা.)-কে আরবি ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছেন।
কোরআনের ভাষা আরবি হওয়ার কারণ
এক. আদিপিতা হজরত আদম (আ.) জান্নাতে অবস্থানকালে তাঁর ভাষা ছিল আরবি, দুনিয়ায়ও তিনি আরবিতেই কথা বলতেন।
দুই. আদম (আ.) থেকে শুরু করে মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত পৃথিবীর সব নবী-রাসুলের জন্য যেসব সহিফা বা কিতাব নাজিল হয়েছে, সবই ছিল আরবি। দেশ, কাল ও জাতির কথা বিবেচনা করে জিবরাইল (আ.) প্রত্যেক নবীর কাছে তাঁদের ভাষায় অনুবাদ করে ওহি নাজিল করেছেন। অর্থাৎ সব আসমানি গ্রন্থের মূল ভাষা ছিল আরবি। (আল-ইতকান ফি উলুমিল কোরআন)
তিন. দুর্বল সূত্রে বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, জান্নাতের ভাষা হবে আরবি।
চার. আরবি ভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এ ভাষায় ভাব প্রকাশ করার অসংখ্য উপায় আছে।
পাঁচ. প্রকৃতিগতভাবে আল্লাহ তাআলা সব মানুষকে আরবি ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিয়েছেন। ফলে প্রত্যেকেই নিজেদের প্রয়োজনমাফিক ভাষাটি সহজেই শিখে নিতে পারে। তাই ইসলামের দাওয়াত নিয়ে সাহাবায়ে কেরাম যখনই কোনো নতুন অঞ্চলে গেছেন, সেখানকার মানুষ ইসলাম কবুলের সঙ্গে সঙ্গে ওই ভাষাও আয়ত্ত করে নিয়েছে। ফলে মক্কা-মদিনার সীমানা ছাড়িয়ে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো, সুদান, মৌরিতানিয়া, মিসর, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশের জাতীয় ভাষা হয়ে ওঠে আরবি। অথচ এসবের কোনোটিতেই আরবি তাদের জাতীয় ভাষা ছিল না। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই কোরআনের ভাষা হিসেবে আরবিকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
No comments:
Post a Comment