০১. বহু বিবাহের সংজ্ঞা-
‘বহু বিবাহ’ (Polygamy) অর্থ এমন এক বিবাহ পদ্ধতি, যেখানে একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকে। বহু বিবাহ দুই প্রকার হতে পারে। এক প্রকার হল, (Polygamy) যেখানে একজন পুরুষ একাধিক মহিলাকে বিবাহ করতে পারে। আর অপরটি হল- (Polyandry) যখন একজন মহিলা একাধিক পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ইসলামে সীমিত পর্যায়ে ‘বহু বিবাহ’ (Polygamy) অনুমোদিত। অথচ একজন নারীর জন্য একই সাথে একাধিক বিবাহ করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
এবার মূল কথায় আসছি। ইসলামে একজন পুরুষকে একাধিক স্ত্রী রাখার অনুমতি কেন দিয়েছে?
০২. ‘আল-কোরআনই পৃথিবীতে একমাত্র ঐশীগ্রন্থ, যে নির্দেশ করে, ‘একটি মাত্র বিবাহ করো’
‘আল-কোরআনই পৃথিবীতে একমাত্র ধর্মগ্রন্থ যাতে এই সমন্ধে এ শব্দগুচ্ছ রয়েছে যে, ‘একটি মাত্র বিবাহ করো’। {সূরা নিসা, আয়াত-০৩, এখানে সীমিত বহুবিবাহ এবং একটি মাত্র বিবাহের কথা বলা হয়েছে। এব্যাপারে বিস্তারিত সামনে আসছে*} এছাড়া আর কোন ধর্মগ্রন্থে এমন নেই যাতে একটি মাত্র বিবাহের নির্দেশ রয়েছে। এক স্ত্রী গ্রহন সম্পর্কে বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বাইবেল, তালমুদ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের যেকোন একটি ধর্মগ্রন্থেও বহুবিবাহ বা স্ত্রীদের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়নি। এসব ধর্মগ্রন্থ অনুসারে একজন পুরুষ যত ইচ্ছে বিয়ে করতে পারে। হিন্দু পুরোহিত ও খ্রিষ্টান পাদ্রিগন অনেক পরে স্ত্রীদের সংখ্যা ‘এক’-এ সীমিত করে দিয়েছেন।
অনেক হিন্দুধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব তাদের ধর্মগ্রন্থের অনুসারে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করেছেন। রামের পিতা রাজা ‘দশরথ’-এর একাধিক স্ত্রী ছিল। একইভাবে ‘ভগবান শ্রী কৃষ্ণের’ও কয়েকজন স্ত্রী ছিল। আগেরকার খ্রীষ্টানদের জন্যে যতো ইচ্ছে স্ত্রী গ্রহনের অনুমোদন ছিল। কেননা বাইবেলে স্ত্রী সংখ্যার ব্যাপারে কোন বিধি-নিষেধ ছিল না। মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে খ্রিষ্টান পাদ্রিরা স্ত্রী সংখ্যা একজনে সীমিত করে দেয়।
ইহুদী ধর্মে একাধিক স্ত্রী রাখার অনুমোদন আছে। তালমুদের বিধান অনুসারে আব্রাহাম অর্থাৎ হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ৩ জন স্ত্রী ছিল এবং সলেমান অর্থাৎ হযরত সুলায়মান (আঃ)-এর শতাধিক স্ত্রী ছিল। ইহুদী রাব্বী জারসম বেন ইয়াহুদাই পর্যন্ত (৯৬০খ্রি.-১০৩০ খ্রি.) বহু বিবাহের এই ধারা জারি ছিল। অতঃপর তিনি এর বিরুদ্ধে একটি ফরমান জারি করেন।
ইহুদী শেফারডিক সম্প্রয়দায় যারা মুসলিম দেশসমূহে বসবাস করে, তারা বেশীরভাগ বহুবিবাহের এই প্রথাকে নিকট অতীতের ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চালু রাখে। তারপর ইসরাইলের প্রধান রাব্বী একটি সংশোধণী বিধি জারির মাধ্যমে একের অধিক স্ত্রী রাখা নিষিদ্ধ।
যদি ভারতের দিকে তাকাই,তাহলে দেখা যায় যে, ১৯৬১ সাল পর্যন্ত হিন্দুদের শতকরা ৫.০৬ ভাগ ছিল বহুপত্নীক, আর মুসলিমদের মধ্যে ৪.৩১ ভাগ।{তথ্যসূত্রঃ ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত ‘কমিটি অভ দ্য ষ্ট্যাটাস অভ উমেন ইন ইসলাম এর ৬৬-৬৭ পৃষ্ঠা} বর্তমানে ‘হিন্দু বিবাহ আইন’ (১৯৫৪সালে পাস হয়) অনুযায়ী হিন্দুদের একাধিক স্ত্রী রাখা নিষিদ্ধ। কিন্তু এটা তাদের ধর্মগ্রন্থের বিধান নয়। সরকারের জারি করা বিধান। তাহলে দেখা যাচ্ছে মুসলিম ও হিন্দু উভয় ধর্মগ্রন্থে বহু বিবাহের বিধান আছে। তবে ইসলাম ধর্মে ‘সীমিত বহুবিবাহ’-কে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
৩. আল-কোরআন ‘সীমিত বহু বিবাহ’-কে অনুমোদন করে
আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে পৃথিবীতে আল-কোরআনই একমাত্র ধর্মগ্রন্থ যা নির্দেশ করে- ‘কেবল একটি বিবাহ করো’। এর সমর্থনে পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার ৩ নং আয়াতে রয়েছে-
“আর যদি তোমরা ভয় কর যে, এতীম মেয়েদের হক যথাথভাবে পুরণ করতে পারবে না, তবে সেসব মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন, কিংবা চারটি পর্যন্ত| [/highlight]আর যদি এরূপ আশঙ্কা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায় সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে, একটিই অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে; এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা|”
*এখানে ‘সীমিত বহুবিবাহ’ ও সুবিচার করতে না পারলে একটি বিবাহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আল-কোরআন নাযিলের আগে বহু বিবাহের কোন ঊর্ধতন সীমা বা সংখ্যা ছিল না। অনেক লোক স্ত্রী-র সংখ্যার ব্যপারে প্রতিযোগীতা চালাতো, কেউ কেউ শতাধিক স্ত্রী গ্রহন করতো। শুধুমাত্র ইসলামই চারজন স্ত্রী রাখার ঊর্ধতম সীমা নির্ধারন করে দেয়। ইসলাম ২/৩/৪ পর্যন্ত স্ত্রী রাখার অনুমোদন দেয় এই শর্তেই যে, সে (স্বামী) তাদের মধ্যে সুবিচার করতে সমর্থ হবে।
#একই অধ্যায়ে অর্থাৎ সূরা নিসার ১২৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
”আর স্ত্রীদের মধ্যে পুরোপুরি ইনসাফ করা তোমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”
সুতরাং বহু বিবাহ কোন বিধিবদ্ধ বিধান নয় বরং একটি ব্যতিক্রমী বা বিকল্প ব্যবস্থা মাত্র। অনেক লোকেরই এই ভূল ধারণা রয়েছে যে, একজন মুসলিম পুরুষের জন্যে একাধিক স্ত্রী রাখা একটি বাধ্যতামূলক বিধান। এটা স্পষ্ট যে ইসলামে ‘করো’ বা ‘করো না’ অর্থাৎ আদেশ সম্পর্কিত বিষয়গুলো ৫ শ্রেণীতে বিভক্ত। যথা-
১. ফরজ অর্থাৎ আবশ্য পালনীয় যা বাধ্যতামূলক।
২. মুস্তাহাব অর্থাৎ অনুমোদিত বা উৎসাহিত।
৩. মুবাহ অর্থাৎ অনুমোদনযোগ্য বা গ্রহনযোগ্য।
৪. মাকরুহ অর্থাৎ অনানুমোদিত বা নিরুৎসাহিত।
৫. হারাম অর্থাৎ বে-আইনি বা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
‘বহু বিবাহ’ এই শ্রেণীবিভাগের মধ্যে মধ্যম বা ৩য় শ্রেণীতে পড়ে। অর্থাৎ বহু বিবাহ ইসলামী বিধানে অনুমোদনযোগ্য বা বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহনযোগ্য। এটা সরাসরি বলা সঙ্গত হবে না যে, মুসলিমের তিনজন বা চারজন স্ত্রী আছে, বরং বলা উচিত হবে- যার একাধিক স্ত্রী আছে, তার চেয়ে ঐ ব্যক্তি উত্তম যার একজন স্ত্রী আছে। (চলবে………Wink ২. মুস্তাহাব অর্থাৎ অনুমোদিত বা গ্রহনযোগ্য।
৪. পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের গড় আয়ু অধিকঃ
প্রকৃতিগতভাবে নারী ও পুরুষের জন্মহার প্রায় সমান। একটি পুরুষ শিশুর চেয়ে একটি নারী শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী। একটি নারী শিশু রোগ-জীবাণু ও বিভিন্ন রোগ-ব্যধির সাথে বেশী লড়াই করতে পারে। আর এই জন্যেই মেয়ে শিশুর তুলনায় ছেলে শিশুদের মৃত্যুর হার বেশী। যুদ্ধকালীন অবস্থায় নারীদের তুলনায় পুরুষরাই অধিক হারে নিহত হয়। দূর্ঘটনায় ও বিভিন্ন রোগ ব্যধিতে নারীদের চেয়ে পুরুষদের মৃত্যু বেশী হয়। এসব কারনে পুরুষদের তুলনায় নারীদের গড় আয়ু বেশী। এবং কালের যে কোন যুগে বিপত্নীক পুরুষদের চেয়ে বিধবাদের সংখ্যা অধিক খুঁজে পাওয়া যায়।
৫. একটি উদাহরণঃ
উদাহরন হিসেবে পরস্পর প্রতিবেশী কয়েকটি রাষ্ট্রের মধ্যে ভারতই একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে পুরুষ জনসংখ্যার চেয়ে নারী জনসংখ্যা কম। কেন………..? কারণ ভারতে উচ্চহারে নারী শিশু হত্যা করা হয় এবং প্রকৃত সত্য হল, অভিশপ্ত যৌতুক প্রথার কারণে ভ্রুণ চিহ্ণিত করে ভারতে প্রতিবছর কমপক্ষে ১০ লক্ষ নারী শিশুর ভ্রুণ গর্ভপাত করা হয়। এই অশুভ প্রবণতা যদি বন্ধ করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে, ভারতেও পুরুষের তুলনায় নারীদের সংখ্যা বেশী হয়ে গেছে।
৬. বিশ্বে পুরুষ জনসংখ্যার তুলনায় নারী জনসংখ্যা অধিকঃ
যদি আমেরিকা যক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকানো হয় তাহলে আমরা দেখতে পাই যে, সেখানে পুরুষদের তুলনায় নারীসংখ্যা
৭.৮ মিলিয়ন অর্থাৎ ৭০ লক্ষ ৮০ হাজার বেশী (বর্তমানে আরও বেশী হতে পারে)। নিউইয়র্ক শহরে পুরুষদের তুলনায় নারীসংখ্যা ১০ লক্ষ বেশী এবং এ পুরুষ জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ আবার সমকামীতায় আগ্রহী। এর অর্থ লোকগুলো কোন নারীকে বিবাহ করতে আদৌ ইচ্ছুক নয়। গ্রেট বিটেনে পুরুষদের অপেক্ষা ৪০ লক্ষ নারী বেশী রয়েছে। জার্মানীতে পুরুষদের অপেক্ষা ৫০ লক্ষ নারী বেশী। আর রাশিয়াতে পুরুষদের অপেক্ষা ৯০ লক্ষ নারী বেশী। এমনকি আমাদের বাংলাদেশেও নারীদের সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় শতকরা ৭ ভাগ বেশী। এখন সারা বিশ্বে পুরুষদের তুলনায় নারীর সংখ্যা কত বেশী হবে, তা মহান আল্লাহ তা’য়ালাই ভাল জানেন।
৭. ‘একজন পুরুষের জন্যে একজন স্ত্রী’- প্রত্যেকের জন্যে এমন বিধি আরোপ করা বাস্তব সম্মত নয়ঃ
একজন পুরুষ কেবল একজন স্ত্রী গ্রহন করলে শুধুমাত্র আমেরিকাতেই ৩ কোটি নারীর ভাগ্যে কোন স্বামী জুটবেনা (এখানে মনে রাখতে হবে আমেরিকায় ২কোটি ৫০ লক্ষ সমকামী পুরুষ রয়েছে)। এমনিভাবে গ্রেট বিটেনে ৪০ লক্ষ, জার্মানীতে ৫০ লক্ষ ও রাশিয়ায় ৯০ লক্ষ নারী উল্লেখিত বিধান জারি করলে কোন স্বামী পাবেনা।
মনে করুন, আমার অথবা আপনার বোন আমেরিকায় বসবাসকারী একজন অবিবাহিতা মহিলা। উপরোক্ত অবস্থায় তার সামনে দুটো পথ খোলা আছে-
ক. তাকে হয়তো এমন একজন পুরুষকে বিবাহ করতে হবে, যার আরেকজন স্ত্রী আছে।
খ. অথবা তাকে গন সম্পদে পরিণত হতে হবে। (গন সম্পদ= আমেরিকার ফ্রি-সেক্স/ বিবাহ বহির্ভূত যৌনাচার ) এর কোন বিকল্প নেই।
এক্ষেত্রে যেকোন রুচিবান নারীই প্রথমটি গ্রহন করবে। অর্থাৎ যে পুরুষের একজন স্ত্রী আছে তার ২য় স্ত্রী হতে আপত্তি করবেনা।
পশ্চিমা সমাজে একজন পুরুষের একাধিক নারীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা একটি সাধারণ ব্যপার; অথবা একাধিক বিবাহ বহির্ভূত যৌনাচার সেখানে একান্তই স্বাভাবিক। আর এ জন্যেই সেখানে নারীরা অতৃপ্ত ও যৌন নিরাপত্তাহীন জীবনযাপন করে। অথচ একই সমাজ একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকার ব্যপারটি গ্রহন করতে পারেনা। যেখানে হতে পারতো নারী তার সমাজে সম্মানজনক ও মর্যাদার অধিকারিণী এবং যাপন করতো নিরাপদ জীবন।
যা হোক, যেখানে নারীকে এমন দুটো ব্যবস্থার একটাকে গ্রহন করতে হবে যে, দুটোর বিকল্প কোন পথ নেই- হয়তো তাকে এমন একজন পুরুষকে বিবাহ করতে হবে যার আরেকজন স্ত্রী আছে, অথবা তাকে গন সম্পদে পরিণত হতে হবে। সেক্ষেত্রে/ এই অবস্থায় ইসলাম নারীকে প্রথম ব্যবস্থাটি গ্রহনের অনুমতি দেয়, দ্বিতীয় ব্যবস্থা গ্রহনের অনুমতি দেয় না।
সবশেষে এটাই পরিষ্কার হয় যে, ইসলাম যে সীমিত আকারে “বহু বিবাহ”-কে অনুমোদন দেয় তার প্রধান উদ্দেশ্য হল- নারীর সম্মান-সম্ভ্রমকে রক্ষা করা।
No comments:
Post a Comment