আজকের দিনে ব্রাজিল খাদ্যনিরাপত্তার দিক থেকে সামনের সারিতে থাকলেও, সত্তরের দশকের আগেও অনাহার আর অর্ধাহার দেশটির দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। কৃষি উৎপাদন হতো অনেক কম। উৎপাদনশীলতাও ছিল তলানির দিকে। সে সময় দেশটির গোটা কৃষি ব্যবস্থাই ছিল মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত। ফলে খাদ্য সরবরাহে সংকট দেখা দিত প্রায়ই। গ্রামীণ দারিদ্র্য ছিল প্রকট। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশটিতে কৃষি খাতের অনেক সম্ভাবনা থাকলেও তা কাজে লাগানোর মতো কোনো নীতিমালা ছিল না
বৈশ্বিক কৃষিপণ্য রফতানিতে ব্রাজিলের অবস্থান তৃতীয়। ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাপী কৃষিপণ্য রফতানিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রের পরের অবস্থানেই ছিল দেশটি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৮ হাজার ৮০০ কোটি ডলার মূল্যের কৃষিপণ্য রফতানি করেছে দেশটি। এ সময়ে আগের বছরের তুলনায় দেশটির রফতানি বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। অন্যদিকে, দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানাচ্ছে, এ সময় দেশটির কৃষিপণ্য রফতানি বাবদ আয় হয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৬০০ কোটি ডলার (এর মধ্যে বনজ সম্পদও যোগ করা হয়েছে), যার মধ্যে শুধু বাণিজ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ ৮ হাজার ১০০ ডলারের বেশি।
আজকের দিনে ব্রাজিল খাদ্যনিরাপত্তার দিক থেকে সামনের সারিতে থাকলেও, সত্তরের দশকের আগেও অনাহার আর অর্ধাহার দেশটির দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। কৃষি উৎপাদন হতো অনেক কম। উৎপাদনশীলতাও ছিল তলানির দিকে। সে সময় দেশটির গোটা কৃষি ব্যবস্থাই ছিল মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত। ফলে খাদ্য সরবরাহে সংকট দেখা দিত প্রায়ই। গ্রামীণ দারিদ্র্য ছিল প্রকট। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশটিতে কৃষি খাতের অনেক সম্ভাবনা থাকলেও তা কাজে লাগানোর মতো কোনো নীতিমালা ছিল না। সে সময় ব্রাজিল মূলত কফি আর আখ উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবেই পরিচিত ছিল। সেখান থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে আজকের দিনে কৃষি খাতে পৃথিবীর সবচেয়ে সফল দেশগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে ব্রাজিল। কোনো আলাদিনের চেরাগ নয়, বরং সরকারের কৃষিবান্ধব নীতিমালা, নিরন্তর গবেষণার সুযোগ, কৃষির বৈচিত্র্যায়ণ এবং আধুনিকীকরণ ও যান্ত্রিকীকরণের মধ্য দিয়েই এ সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে দেশটি।
ব্রাজিলের প্রাচীন আদিবাসীরা ঠিক কবে পুরোদস্তুর শিকারি-সংগ্রহবৃত্তি ছেড়ে কৃষিকাজে মন দিয়েছিল, তা বলা মুশকিল। তবে এর পেছনে যে জলবায়ু পরিবর্তনসহ আবহাওয়াগত কিছু বিষয় কাজ করেছিল, সে বিষয়ে মোটামুটি নিঃসন্দেহ বিশেষজ্ঞরা। তাদের অনুমান, ব্রাজিলে কৃষিকাজের সূচনা ঘটে প্রায় ১২ হাজার বছর আগে। দেশটিতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের কৃষিকাজের সবচেয়ে বেশি নিদর্শন পাওয়া গেছে রিও ডি জেনেরিও এসপিরিতো সানতো অঞ্চলে। চার হাজার বছরের পুরনো কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বলছে, অঞ্চলটিতে শস্য ফলানোর পাশাপাশি শৈল্পিক কাজেও কৃষিপণ্যের ব্যবহার হতো। এছাড়া ছাউনি তৈরিতে ব্যবহার্য খড়েরও জোগান দিত কৃষিকাজ। সে সময় দেশটির আদিবাসীরা মূলত কাসাভা, বাদাম, মিষ্টি আলু ও ভুট্টা উৎপাদন করত। এছাড়া পেকি ও বাবাসু নামে দুটি গাছ থেকে নির্যাস বের করা হতো। ফলের জন্য চাষ করা হতো জাবুতিকাবা, কাজুবাদাম ও পেয়ারা।
ওই সময় অ্যামাজোনিয়া অঞ্চলের (আমাজন অববাহিকা অঞ্চল) প্রধান খাদ্যশস্য ছিল ভুট্টা। কৃষিকাজের পাশাপাশি শিকার-সংগ্রহবৃত্তিতেও নিয়োজিত ছিল ব্রাজিলীয় আদিবাসীরা। সে সময় আদিবাসীরা আবাদের জন্য জমি প্রস্তুত করত বন পুড়িয়ে। সাম্প্রতিক কালের অনেকে বিষয়টিতে নাক সিটকালেও, প্রকৃতপক্ষে বিশেষভাবে জমি প্রস্তুতের এ কায়দাটি ছিল বেশ পরিবেশবান্ধব। কারণ এ পদ্ধতিতে পাওয়া ছাই আসলে কাজ করত সার ও জমির আচ্ছাদন হিসেবে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় পাওয়া ফলাফল বলছে, ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ আমাজন বন তার বিশালতা পেয়েছিল আদিবাসী কৃষকদের কল্যাণে। এখন আমাজন রেইন ফরেস্টের যেসব এলাকায় আগে কখনো মানুষের পা পড়েনি বলে ধারণা করা হয়, সেসব এলাকার ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধিতেও ছিল তাদের বড় ভূমিকা।
কয়েকজন প্রত্নতত্ত্ববিদ, পরিবেশবিদ ও উদ্ভিদতাত্ত্বিকের সমন্বয়ে গঠিত ওই গবেষণা দলের বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, ওই অঞ্চলের আদিবাসীদের কৃষি ও আগুন ব্যবস্থাপনাই আমাজনের আজকের এ বিশালতার কারণ। বনের নিত্যনতুন এলাকা পরিষ্কার না করেই নিবিড় চাষাবাদ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষি উৎপাদনের উপায় উদ্ভাবন করেছিলেন ওই অঞ্চলের কৃষকরা। ব্রাজিলের পূর্বাঞ্চলের বৃক্ষসম্পদ ও কৃষির ইতিহাসের সন্ধানে সেখানকার বনাঞ্চলের মাটিতে চারকোল, পরাগরেণু ও বৃক্ষের অবশিষ্টাংশ পরীক্ষা করে দেখেন গবেষকরা। গবেষণার ফলাফল দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েন তারা। পরীক্ষায় উঠে আসা প্রমাণ বলছে, প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে ওই এলাকায় ভুট্টা, কাসাভা ও স্কোয়াশের আবাদ করা হতো। জমিতে গাছ পুড়িয়ে ছাই ফেলার পাশাপাশি এতে খাদ্যের অবশিষ্ট মেশানো হতো, যা একই সঙ্গে সার ও জমির আচ্ছাদন হিসেবে কাজ করত। এ কারণেই বনাঞ্চলের এ অংশে বর্তমানে ভোজনযোগ্য গাছের ঘনত্ব তুলনামূলক বেশি।
এছাড়া তাদের কৃষি ব্যবস্থাপনার আরেকটি অংশ ছিল, জমি এমনভাবে নির্বাচিত করা, যাতে তা ঘন গাছগাছালি দিয়ে আবৃত থাকে। এ প্রসঙ্গে গবেষকদের অন্যতম ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটারের বিশেষজ্ঞ ড. ইয়োশি মায়েজুমির মন্তব্য হচ্ছে, ‘প্রাচীন অধিবাসীরা বন থেকে কিছু ছোটখাটো গাছ ও আগাছা সাফাই করেছে সত্যি। কিন্তু তারা কৃষিজমির আচ্ছাদন হিসেবে আশপাশে ভোজনযোগ্য গাছের আচ্ছাদন ব্যবহার করত। বর্তমানের কৃষি ব্যবস্থার তুলনায় এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেখানে সয়াবিন উৎপাদন ও পশুপালনের জন্য নির্বিচারে আমাজন কেটে সাফ করা হচ্ছে। আশা করি, প্রাচীন এ ভূমি ব্যবস্থাপনা থেকে আজকের সংরক্ষণবিদরা শিক্ষা নিতে পারবেন এবং বন সংরক্ষণ করে কৃষি উৎপাদনের বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বোঝাতে পারবেন।’
দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য অঞ্চলের মতো আমাজনেও কৃষিসহ সনাতন সব ব্যবস্থাকেই ধসিয়ে দিয়েছিল ইউরোপীয়দের আগমন। তারাও এসে নির্বিচারে বন পোড়াতে শুরু করে। কিন্তু আদিবাসীদের পুড়িয়ে বন পরিষ্কার করার সঙ্গে এর আকাশপাতাল ব্যবধান। যেখানে আদিবাসী কৃষি ছিল সংরক্ষণমুখী। সেখানে ইউরোপীয়দের হাতে চালু হওয়া কৃষি ব্যবস্থা হয়ে পড়ে পুরোপুরি ধ্বংসাত্মক। এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদ ডারসি রিবেইরোর মন্তব্য হলো, ‘...এভাবেই তারা (আদিবাসীরা) কৃষিকাজ করে এসেছে হাজার হাজার বছর ধরে, যতদিন না তারা আক্রমণাত্মক ও জটিল জীবনযাত্রার মাধ্যমে তৈরি হওয়া অলৌকিক ভারসাম্যকে পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়ার মতো শক্তিধর আমাদের সভ্যতার সশস্ত্র প্রতিনিধির মুখোমুখি হলো।’
মূলত ব্রাজিলউড নামে কাষ্ঠল এক ধরনের বৃক্ষের প্রাচুর্যের কারণে ব্রাজিলের দখল নিতে চেয়েছিল ইউরোপীয়রা। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা দস্যুদের মধ্যে পর্তুগিজরাই ব্রাজিলের দখল নিতে সক্ষম হয়। নির্বিচারে বন পুড়িয়ে একমুখী শস্য উৎপাদনের মতো সর্বনাশা ব্যবস্থারও সূত্রপাত ঘটে তাদের হাত দিয়ে।
ব্রাজিলের কৃষি ব্যবস্থায় আরেক দফা আমূল পরিবর্তন আসে আখ চাষের সূত্রপাতের মাধ্যমে। আখের প্লান্টেশন গড়ে সে সময় ইউরোপীয়দের ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেলেও, ব্রাজিলের আসল অধিবাসীদের তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। বরং এ আখ চাষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্রাজিল ও ব্রাজিলের কৃষির ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় দাসপ্রথার নাম।
শুরুর দিকে ইউরোপীয় আখচাষীরা আদিবাসীদের বন্দি করে দাস হিসেবে খাটিয়ে নেয়ার প্রয়াস চালায়। ফলে বারবার বিদ্রোহ করতে থাকে আদিবাসীরা। এছাড়া ইউরোপীয়দের সঙ্গে করে নিয়ে আসা রোগও তাদের বেশ নাজুক অবস্থানের দিকে ঠেলে দেয়। একপর্যায়ে জেসুইটদের ক্রমাগত বিরোধিতায় আদিবাসীদের জোরপূর্বক দাস বানানো যাবে না মর্মে আইন প্রণীত হয়। অনেক স্থানে এ আইনের প্রতি ন্যূনতম সম্মান দেখাত না ইউরোপীয় আখ প্লান্টাররা।
এক পর্যায়ে ইউরোপীয়রা আফ্রিকা থেকে দাস আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়ে। ওই সময় বিশ্বের অন্যতম প্রধান দাস আমদানিকারক দেশ হয়ে ওঠে ব্রাজিল। ১৫০১ থেকে ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলে আফ্রিকা থেকে ধরে আনা দাসের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০ লাখের কাছাকাছি। এদের অধিকাংশকেই ধরে আনা হতো লুয়ান্ডা (অ্যাঙ্গোলা) ও নাইজেরিয়া থেকে। ধরে নিয়ে দাসদের অধিকাংশকেই নিয়োজিত করা হতো কৃষিকাজে।
ইউরোপীয়দের আগমনের এক শতাব্দীর মধ্যে ব্রাজিলে দাসের সংখ্যা স্থানীয় আদিবাসীদের ছাড়িয়ে যায়। বর্বর নির্যাতন ও শোষণ ছিল এদের নিত্যসঙ্গী। সামান্য অজুহাতে মারধর থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় নানা ধরনের বর্বর নির্যাতন এদের সহ্য করতে হতো নিয়মিত। জবাবে বারবার বিদ্রোহ করতে থাকে নিরুপায় দাসরা। এসব বিদ্রোহ দমন করা হতো অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে। নিরুপায় হয়ে যেসব দাস পালিয়ে যেত শুধু তাদের ধরে আনার জন্যই গড়ে উঠেছিল নতুন এক পেশা— বাউন্টি হান্টার। এসব বাউন্টি হান্টারদের হাতে ধরা পড়ার পর পলাতক দাসদের জোরপূর্বক বেঁধে আনা হতো প্লান্টেশনে। এরপর তাদের কপালে জুটত আরো অমানুষিক অত্যাচার। আবার এ দাসদের ছাড়া চিনিকল বা আখের প্লান্টেশনগুলোর মালিকরা এক পাও ফেলতে পারত না। সমসাময়িক এক বিবরণের ভাষ্যমতে, ‘চিনিকলগুলোর হাত ও পা হলো দাসেরা। কারণ ব্রাজিলে তাদের ছাড়া কৃষি খামার গড়ে তোলা, ধরে রাখা বা সম্প্রসারণ করা অথবা মিল চালানো কোনোমতেই সম্ভব না।’
দাসদের অন্যতম প্রধান কাজ ছিল বন পুড়িয়ে কৃষিজমি সম্প্রসারণ। বিশেষ করে ব্রাজিলে কফি উৎপাদনের জন্য প্লান্টেশন গড়ে উঠতে থাকলে দাসদের চাহিদা অনেকাংশে বেড়ে যায়। অষ্টাদশ শতকে ব্রাজিল পরিণত হয় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কফি রফতানিকারক দেশে। ১৮২২ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর ব্রাজিলের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কফি উৎপাদন বাড়তে থাকে। বিশেষ করে সাও পাওলো অঞ্চলকেন্দ্রিক কফি উৎপাদন ক্রমেই জোরালো হয়। ১৮০০ সালের শুরুর দিকে ব্রাজিলের বার্ষিক গড় কফি রফতানি ছিল ১৯ দশমিক ৬ টন। অন্যদিকে ১৮৮০-৯০ সাল পর্যন্ত দশ বছরে মোট ৩০ লাখ ৬৩ হাজার ৬৬০ টন কফি রফতানি করে দেশটি। আর এতে প্রধান ভূমিকাই ছিল আফ্রিকা থেকে ধরে আনা দাসদের। শেষ পর্যন্ত ১৮৮৮ সালে উচ্ছেদ হয় এ ঘৃণ্য দাসপ্রথা।
কফি উৎপাদনের এ বিশাল প্রবৃদ্ধি সে সময় কফি ব্যারন নামে পরিচিত ব্যবসায়ীদের জন্য এক পর্যায়ে গলার কাঁটা হয়ে ওঠে। কারণ চাহিদার অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে পণ্যটির দাম এক সময়ে মারাত্মক আকারে হ্রাস পায়। শেষ পর্যন্ত এ ‘কফি ব্যারনদের’ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ব্রাজিল সরকার উদ্বৃত্ত কফি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত ও ধ্বংস করার নিয়ম চালু করে আইন করা হয়। আবার মুনাফায় ফিরে আসে ব্রাজিলের কফি উৎপাদন।
কফির মতো রাবারও একসময় ব্রাজিলের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ছিল। কিন্তু ১৮৭০ সালের ব্রিটিশ কিছু চোরাকারবারি ব্রাজিল থেকে রাবারের চারা চুরি করে আনে। ১৮৯৫ সালের মধ্যেই এশিয়ায় রাবার উৎপাদন শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে কৃত্রিম রাবারও চলে আসে বাজারে। ফলে ১৯১০-১৯২০ সালের মধ্যে রাবারের বিশ্ববাজার থেকে পুরোপুরি ছিটকে পড়ে ব্রাজিল।
ব্রাজিলের কৃষিতে আধুনিকায়নের পথ খুলে গিয়েছিল প্রথম দেশটির কৃষি শিক্ষা স্কুলগুলোর মাধ্যমেই। ১৮৮৭ সালেই কৃষিবিদ তৈরির জন্য প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলে ব্রাজিল। ক্রুজ দা আলমায় খোলা স্কুলটি স্বীকৃতি পেতে সময় নেয় আরো ৩৫ বছর। অন্যদিকে কৃষিবিদের পেশার প্রথম স্বীকৃতি মেলে ১৯৩৩ সালে।
দেশটির কৃষি খাতে উল্লম্ফনের সবচেয়ে বড় সুযোগ তৈরি হয় ১৯৭৩ সালে। সে সময় প্রতিষ্ঠা করা হয় দেশটির কৃষি গবেষণা সংস্থা দ্য ব্রাজিলিয়ান এন্টারপ্রাইজ ফর এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (ইএমবিআরএপিএ)। দেশটিতে কৃষির বৈচিত্র্যায়ণের সূত্রপাতই ঘটে সংস্থাটির হাত ধরে। প্রাথমিকভাবে সয়াবিন, তুলা ও শিমজাতীয় ফসল অল্প অল্প করে উৎপাদন শুরু করে সংস্থাটি। অন্যদিকে দেশটির সবুজ বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে চেক বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী জোহানা দোবেরেনিয়েরের হাত ধরে।
১৯৬০ সালে যেখানে ব্রাজিলের প্রধান রফতানিমুখী কৃষিপণ্যের সংখ্যা ছিল চারটি, ১৯৯০ সালে এসে তা দাঁড়ায় ১৯টিতে। একই সঙ্গে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হয়ে ওঠে দেশটি। ষাটের দশকে দেশটি থেকে রফতানি হওয়া অপ্রক্রিয়াজাত পণ্যের সংখ্যা ছিল মোট কৃষিপণ্য রফতানির ৮৪ শতাংশ। ১৯৯০ সালের মধ্যেই তা নেমে আসে মাত্র ২০ শতাংশে। এছাড়া গত কয়েক দশকে কৃষিতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি, কৃষকবান্ধব অর্থায়ন ব্যবস্থাকেও বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছে ব্রাজিল। নিরন্তর গবেষণা ও বিনিয়োগের সুবাদে ৯০-এর দশকের পর থেকে দেশটিতে কৃষির যান্ত্রিকীকরণও হয়েছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। এরই ফলে আজ বৈশ্বিক কৃষি রফতানিতে তৃতীয় স্থানে উঠে আসতে পেরেছে দেশটি।
বর্তমানে ব্রাজিলে যেসব কৃষিপণ্য উৎপাদন হয় তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে কফি, সয়াবিন, গম, ধান, ভুট্টা, আখ, কোকো, সিট্রাসজাতীয় ফল ও গরুর মাংস।
বর্তমানে ব্রাজিলের দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলেই মূলত কৃষি উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকাটি সহনশীল তাপমাত্রা ও পরিবেশের কারণে বেশি উৎপাদনশীল। এছাড়া উর্বর জমি ও প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণেও এ এলাকা শস্য উৎপাদনের জন্য আদর্শ।
অন্যদিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কৃষি এলাকার জমি তুলনামূলক বেশি শুষ্ক ও খরাপ্রবণ। এছাড়া অবকাঠামো ও মূলধনের অভাবের পাশাপাশি মাটিও তুলনামূলক কম কৃষি উপযোগী হওয়ায় এখানে কৃষি উৎপাদন হলেও তা অনেক কম।
অন্যদিকে দেশটির মধ্যাঞ্চলকে এতদিন কৃষি অনুপযোগী বলে ধরা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে এখানে নিবিড় চাষাবাদ শুরু হয়েছে। তবে এ এলাকা মূলত পশুপালনের উপযোগী।
বর্তমানে দেশটির অন্যতম প্রধান শিল্প হচ্ছে পশুপালন। দেশটি থেকে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে গরুর মাংস রফতানি হচ্ছে। অন্যদিকে সয়াবিন উৎপাদনে দেশটির অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। মোটামুটি বিশ্বের সবখানেই সয়াবিন রফতানি করছে দেশটি। পাশাপাশি আখ উৎপাদনে দেশটির অবস্থান এখন বিশ্বে শীর্ষে। প্রতি বছর ৬০ কোটি টনেরও বেশি আখ উৎপাদন করছে দেশটি।
No comments:
Post a Comment