গত বছর হজ মৌসুমে মক্কায় হাজিদের জন্য ভাড়া করা একটি বাড়ি পরিদর্শনে যান হজ প্রশাসনিক দলের সদস্য শাহ মো. কামরুল হুদা। বাড়ি কাক্সিক্ষতমানের না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট এজেন্সি ‘মিম ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’র লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করে তিনি প্রতিবেদন দেন। কিন্তু প্রতিবেদনটি মক্কা থেকে গায়েব করে দেয়া হয়।
এজেন্সি মালিকের কাছ থেকে এক হাজার সৌদি রিয়াল ‘ঘুষ’ নিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তিন কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিবেদনটি গায়েব করেছেন বলে দেশে ফিরে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন ওই কর্মকর্তা। বিষয়টি তদন্ত করতে মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম-সচিবকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে চলছে তোলপাড়। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ধর্ম সচিব মো. আনিছুর রহমান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে মন্ত্রণালয়। একজন যুগ্ম-সচিবকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এখনও প্রতিবেদন পাইনি। প্রতিবেদন পাওয়ার পরই জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সর্বোচ্চ সেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হজযাত্রী সংগ্রহ করলেও কিছু এজেন্সি মক্কা-মদিনায় হাজিদের রাখেন নিুমানের বাড়িতে। হেরেম শরিফের কাছে রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে কয়েক কিলোমিটার দূরে অধিকাংশ হাজিদের রাখা হয়। কখনও পাহাড়ের ওপর সস্তা বাড়িতে রাখা হয়। নিুমানের খাবার দেয়া হয়। খাবার না দেয়ার নজিরও রয়েছে ভুরিভুরি।
এ ধরনের এজেন্সির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেও তেমন প্রতিকার মেলে না। এমনকি হজ প্রশাসনিক দলের প্রতিনিধিদের সরেজমিন পরিদর্শন প্রতিবেদনও চলে যায় হিমাগারে। কারণ সংশ্লিষ্ট এজেন্সি মালিকের যোগসাজশে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে গড়ে তোলা সিন্ডিকেট অধিকাংশ অভিযোগই গায়েব করে দেয়। চক্রটি হজকে কেন্দ্র করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। অসাধু এজেন্সি মালিকদের সঙ্গে মিলেমিশে তারা হজ ব্যবস্থাপনায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছর হজ মৌসুমে মক্কায় হাজিদের জন্য ভাড়া করা একটি বাড়ি পরিদর্শনে যান হজ প্রশাসনিক দলের সদস্য শাহ মো. কামরুল হুদা। মিম ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের (হজ লাইসেন্স-১০২৮) অধীনে যাওয়া হাজিদের জন্য ভাড়া করা বাড়ি কাক্সিক্ষতমানের না হওয়া এবং নানা অভিযোগ থাকায় ধর্ম সচিব মো. আনিছুর রহমানের একান্ত সচিব (পিএস) কামরুল হুদা ওই এজেন্সির লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেন। সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রারেও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু রহস্যজনকভাবে মক্কা থেকে প্রতিবেদনটি গায়েব হয়ে যায়।
জানা গেছে, এ ঘটনায় ধর্ম সচিবের পিএসকে ‘ম্যানেজ’ করার কথা বলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ডেসপাস রাইডার মো. আমিন রসুল ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবুল কাশেম ভূঁইয়া মিম ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক আবদুল হামিদ বিশ্বাসের কাছ থেকে এক হাজার রিয়াল (বাংলাদেশি টাকায় কমবেশি ২৩ হাজার টাকা) নেন। তাদের সহায়তা করেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইয়াকুব আলী জুলমাতি। এ প্রতিবেদন গায়েবের সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।
মক্কার বিভিন্ন দাফতরিক প্রতিবেদনসহ দলিল-দস্তাবেজ দাফতরিকভাবে কাউন্সিলর (হজ) কর্তৃক তদন্তের জন্য ঢাকায় পাঠানো হলেও রহস্যজনকভাবে প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়নি। অথচ এর আগে ও পরে প্রতিবেদন ঠিকই পাঠানো হয়েছে। আর এসব প্রতিবেদন নথিভুক্ত করে ঢাকায় পাঠানোর দায়িত্বে ছিলেন ইয়াকুব জুলমাতি।
এর আগে মক্কায় থাকাকালে ওই প্রতিবেদন না পেয়ে তা খুঁজে বের করতে একাধিকবার তাগিদ দেন হজ প্রশাসনিক দলের সদস্য শাহ মো. কামরুল হুদা। কিন্তু এতে কোনো ফল হয়নি।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, ইয়াকুব ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিবেদন অন্তর্ভুক্ত না করে মিম ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। মূলত তিনিই প্রতিবেদন গায়েব করে টাকা গ্রহণকারী দু’জনকে টাকার বিনিময়ে হজ লাইসেন্স বাঁচিয়ে দেয়ার কাজে সহায়তা করেছেন। তবে ভুক্তভোগীদের দাবি, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা প্রতি বছরই ঘটে হজ মৌসুমে সৌদি আরবে।
তাদের মতে, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মচারী এখনও হজকে কেন্দ্র করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছু একাধিক এজেন্সি মালিক যুগান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, ঢাকায় অভিযোগ এলে তদন্ত হয়। সংবাদপত্রে খবরও হয়। অভিযুক্তদের লাইসেন্স বাতিল, কালো তালিকাভুক্ত, জামানত বাজেয়াফতসহ কয়েক কোটি টাকা জরিমানার মুখোমুখি হতে হয়। সৌদি আরবে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের যে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী হজ প্রশাসনিক দল, চিকিৎসক দল, সহায়ক দল, টেকনিক্যাল দলসহ বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি হয়ে যান তারাই অভিযোগ গ্রহণ ও পরিদর্শন দলে থাকেন। তাদের কোনোভাবে ‘ম্যানেজ’ করতে পারলে কোনো ঝুঁকি থাকে না। অল্পতেই টেনশনমুক্ত থাকা যায়।
‘আপনারাই হজে অনিয়ম ও দুর্নীতির ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের উৎসাহী করছেন’- এমন অভিযোগের জবাবে তারা দাবি করেন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত তারা সৌদি আরবেই অভিযোগের সুরাহা করার পরামর্শ দেন। বিনিময়ে তাদের খুশি করতে হয়। বরং এ অনিয়ম ও দুর্নীতির পথ এজেন্সি মালিকদের তারাই শেখান।
যা বললেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টরা : বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মু. আ. হামিদ জমাদ্দার। যিনি অভিযুক্ত আবুল কাশেম ভূঁইয়ার সরাসরি ডেস্ক অফিসার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিবেদন দেয়ার আগে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে বলে তিনি জানান।
তবে অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবুল কাশেম ভূঁইয়া। যুগান্তরকে তিনি বলেন, আমি কোনো টাকা-পয়সা নিইনি। মিম ট্যুরসের মালিক আবদুল হামিদ বিশ্বাস তার এজেন্সির কয়েকজন অসুস্থ হাজির বিষয়ে সহায়তা চাইলে ডেসপাস রাইডার গোলাম রসুলকে সাহায্য করতে বলি। মিম ট্যুরসের মালিক খুশি হয়ে গোলাম রসুলকে এক হাজার রিয়াল দিয়েছেন বলে শুনেছি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। আশা করি তদন্তে সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে।
অভিযুক্ত অপর দু’জন গোলাম রসুল ও ইয়াকুব আলী জুলমাতি এ প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
গোলাম রসুলকে এক হাজার রিয়াল দেয়ার কথা স্বীকার করে মিম ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক আবদুল হামিদ বিশ্বাস বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো অভিযোগ করিনি। আমার এজেন্সির বিরুদ্ধে কোনো হাজিও অভিযোগ করেননি। লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ কেন করা হল তাও আমার জানা নেই। বরং আমার এজেন্সির সেবার মান ভালো হওয়ায় ‘গুড এওয়ার্ড’ দেয়া হয়েছে। হতে পারে এটা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে থাকা গ্রুপিংয়ের ফল।
No comments:
Post a Comment