সাইবেরিয়া প্রায় সমগ্র উত্তর এশিয়া নিয়ে গঠিত একটি বিস্তীর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চল। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে সাইবেরিয়া রাশিয়ার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। সাইবেরিয়া পূর্বে উরাল পর্বতমালা থেকে পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর ও উত্তর মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। এর উত্তরে উত্তর মহাসাগর এবং দক্ষিণে কাজাখিস্তান, মঙ্গোলিয়া ও চীন সীমান্ত। সাইবেরিয়ার আয়তনকে একটি দেশ হিসেবে তুলনা করা হয় তবে এর আয়তন প্রায় কানাডার কাছাকাছি। অর্থাৎ সাইবেরিয়া যদি কখনো নিজেকে রাশিয়ার থেকে আলাদা করতে চায় তবে এটি বিশ্বের বৃহত্তম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হবে।
রাশিয়ার পূর্ব সাইবেরিয়ার ওইমিয়াকন হচ্ছে পৃথিবীর শীতলতম জায়গা যেখানে মানুষের বসতি আছে। এখানে শীতের সময় তাপমাত্রা সাধারণত থাকে মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডেরও নিচে। খুব জরুরি কোন দরকার না থাকলে সেখানকার লোক শীতে ঘর থেকে বেরোয় না।
সাইবেরিয়ার সম্পর্কে জানতে হলে জানা বিষয়েই জানতে হয়, যদিও প্রতিটা তথ্যই বিস্ময়ে ভরা। প্রথমত বলা যায় বৈকাল হ্রদ এর কথা। বৈকাল হ্রদ পৃথিবীর গভীরতম (১৬৪২/১৬৩৭ মিটার) বিশুদ্ধ পানির হ্রদ যা সাইবেরিয়ায় অবস্থিত। এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম হ্রদ ও বটে। পৃথিবীর সমগ্র বিশুদ্ধ পানির ২০% শুধুমাত্র এই হ্রদেই বিদ্যমান। জীববৈচিত্রের এক স্বর্গ বলা হয় বৈকাল হ্রদকে। হাজারো প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণীর আবাসস্থল এটি। এসব জীববৈচিত্রের ৬০ শতাংশই বৈকাল হ্রদ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। হ্রদের পানিতে প্রায় ১৪৫৫ প্রজাতির এন্ডেমিক প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যায় যেগুলো পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। অবশ্য প্রতিটি গবেষণাতেই এই সংখ্যা বাড়তে থাকে।
চেলিয়াবিনস্কের আকাশের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে এক উল্কাপিণ্ড। বিস্ফোরণটি ৫০০ কিলোটন টিএনটির সমান শক্তির ছিল। শক্তির একক জুলের হিসেবে এটা হবে ২০০০ টেরা জুলস বা ২x১০১৫ জুল। হিরোশিমায় যে পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছিল সেটির শক্তি ছিল ১৬ কিলোটন টিএনটি বা ৬৭ টেরা জুলস। দেখা যাচ্ছে, এ উল্কার বিস্ফোরণে হিরোশিমার চেয়ে ৩০ গুণ বেশি শক্তি নির্গত হয়েছে। কিন্তু হিরোশিমার মতো কোনো ধ্বংসযজ্ঞই তো চেলিয়াবিনস্কে হয়নি? এর মূল কারণ হচ্ছে যে, হিরোশিমার বোমাটি মাটি থেকে মাত্র ৬০০ মিটার ওপরে বিস্ফোরিত হয়। যদি উল্কাটি মাটি থেকে ২৫ কিলোমিটার ওপরে বিস্ফোরিত হত, তবে (৬০০/২৫,০০০)২ x ৩০ ~ হিরোশিমা বোমার ২% শক্তি মাটিতে পৌঁছুত যদি বায়ুমণ্ডল না থাকত। যেহেতু অনেকখানি শক্তি বায়ুতে শোষিত হয়েছে তাই শেষাবধি মাটিতে অনেক কম আঘাত অনুভূত হয়েছে। এ শক্তির অভিব্যক্তিই আমরা দেখেছি যখন একটা বিশাল জায়গা জুড়ে সবগুলো দালানের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে গেছে। ১৯০৮ সনে সাইবেরিয়ার তুঙ্গুস্কায় যে উল্কাটি পড়েছিল, ধারণা করা হয় সেটির শক্তি ছিল ১৫ মেগাটন টিএনটি যা কিনা ১৫ ফেব্রুয়ারির ঘটনার ৩০ গুণ বেশি। কাকতালীয়ভাবে সে সময়ই সারা পৃথিবী ৫০ মিটার ব্যাসের ‘২০১২ ডিএ১৪’ নামের একটি গ্রহাণুর পৃথিবীর নিকট দিয়ে উড়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। অনেকেই ভেবেছিল, সাইবেরিয়ার গ্রহাণু বোধহয় এর সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত। নাসা থেকে পাওয়া এ ছবিতে সূর্যের চারদিকে ‘২০১২ ডিএ১৪’ ও চেলিয়াবিনস্কের উল্কার কক্ষপথের পার্থকটা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। ‘২০১২ ডিএ১৪’ ও এর কক্ষপথটি ছোট, এবং উল্কার কক্ষপথটি বড়। ১৫ ফেব্রুয়ারি সাইবেরিয়ার উল্কাটি যখন পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছুটে যাচ্ছিল, ‘২০১২ ডিএ১৪’ তখন ভ্রমণ করছিল দক্ষিণ থেকে উত্তরে। কাজেই এ দুটি গ্রহাণু একে অন্যের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, চেলিয়াবিনস্কের উল্কার ব্যাস হচ্ছে ১৭ মিটারের মতো। এ ধরনের গ্রহাণুখণ্ড কি আগেই আবিষ্কার করা সম্ভব নয়?আমাদের কি অন্তত ২৪ ঘন্টা আগে কোনো সতর্কবাণী দেওয়া যায় না? আমরা জানি, ওই একই সময়ে ৫০ মিটার ব্যাসের ‘২০১২ ডিএ১৪’কে বিজ্ঞানীরা অবলোকন করছিলেন।তিন বছর আগে জ্যোতির্বিদরা এটি আবিষ্কার করেন।
পারমাফ্রোস্ট অর্থাৎ ভূগর্ভস্থ চিরহিমায়িত অঞ্চল, সাইবেরিয়ার আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। রাশিয়া একটি অত্যন্ত শীতল দেশ, সাইবেরিয়া ও তাই। রাশিয়ার প্রায় ৬৫% অঞ্চল অধিকাংশ সময় হিমায়িত থাকে। রাশিয়ার অধিকাংশ স্থলভূমি পারমাফ্রোস্ট দিয়ে গঠিত। এবং অধিকাংশ পারমাফ্রোস্টই সাইবেরিয়াতে। পারমাফ্রোস্ট এর অভ্যন্তরীণ ভাগে জমা রয়েছে প্রচুর মিথেন গ্যাস। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের দরুন বরফ গলে এই মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ছে। এটি এখন ছোট মনে হলেও, ভবিষ্যতে এর প্রভাব অনেক ভয়াবহ হবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
বিশ্বের দীর্ঘতম নদী নীলনদ মিশরে থাকলেও, বিশ্বের প্রথম ১০টি দীর্ঘতম নদীর ৪টিই রয়েছে সাইবেরিয়াতে। নদীগুলো হচ্ছেঃ অব , আমুর, লেনা এবং ইয়েনিসেই । তবে সাইবেরিয়ার নদীগুলোর মধ্যে বিখ্যাত একটি হচ্ছে ডাল্ডিকেন । এটি দৈর্ঘ্যে অন্যগুলোর চেয়ে বড় নয়, কিন্তু এটি বিখ্যাত হওয়ার কারন হল একবার এই নদীতে রক্তলাল পানি প্রবাহিত হওয়া শুরু হয়েছিল।
১৯৫৭ সালে সাইবেরিয়ার গভীরে একটা বিজ্ঞাননগরী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় সোভিয়েত সরকার। শহরের নাম দেওয়া হয় অ্যাকাডেমিক সিটি বা আকাদেমগোরোদক। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় শিক্ষাবিদদের শহর নামে পরিচিত হয়ে ওঠা ওই শহরে কাজ করতে যাবেন হাজার হাজার বিজ্ঞানী। অ্যাকাডেমিক সিটিতে প্রথম যেসব বিজ্ঞানী কাজ করতে গিয়েছিলেন তাদের একজন ছিলেন ভিক্টর ভারান্ড। 'সেখানে সবকিছুই ছিল আলাদা। বাড়িগুলো একেবারে জঙ্গলের মাঝখানে। চারদিক নিঝুম। বাতাস খুব পরিষ্কার। নভেম্বরে যখন তুষার পড়ত, রাস্তাঘাট সব সাদা হয়ে যেত- একদিন-দুইদিন- এক সপ্তাহ পর্যন্ত বরফ গলত না। কখনো কখনো এক মাস পর্যন্ত বরফ থাকত।' ভিক্টর ভারান্ড সেখানে গিয়েছিলেন তার স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে নিয়ে। ১৯৬২ সাল থেকে সেখানে তিনি কাজ করেছিলেন ৪৬ বছর। ইনস্টিটিউট অব ইনঅরগ্যানিক কেমিস্ট্রি সংস্থায় রসায়ন বিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে তিনি সেখানে কাজে যোগ দেন। ওই নতুন শহর যার নাম দেওয়া হয় আকাদেমগোরোদক বা অ্যাকাডেমিক সিটি, সেখানে বাসিন্দা তখন ২৫ হাজার, যাদের প্রায় সবাই হয় বিজ্ঞানী, নয় বিজ্ঞানী হতে যাচ্ছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করছেন তাদের গড় বয়স তিরিশের নিচে। শহর গড়ে তোলা হয়েছে একেবারে সাইবেরিয়ার বরফঢাকা বিরানভূমির মাঝখানে, গহীন জঙ্গলে, জীবনধারণ যেখানে কঠিন। কিন্তু ভিক্টর ভারান্ডের মতে ওই গহীন জঙ্গলের মাঝে বিজ্ঞানীদের জন্য শহর বানানোর একটা যৌক্তিকতা ছিল। 'সেখানে গভীর বনজঙ্গলে ছিল প্রচুর গাছগাছালি, খনিজ সম্পদ ছিল অঢেল। এসব সম্পদের সন্ধান এবং কীভাবে সেসব আহরণ করতে হয় ব্যবহারের জন্য- তা জানা দরকার ছিল। এ কারণে ওই বনভূমিতে তৈরি হয়েছিল আকাদেমগোরোদক।'
হঠাৎ শুরু লাল রংয়ের বৃষ্টি। হাজারো মানুষের মুখে চিন্তার ছাপ! মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল খবর! পোস্ট হতে লাগল একের পর এক ছবি যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একটি কারখানার কার পার্কিং-এ জমে থাকা জলের রং টকটকে লাল!কিন্তু জলের রঙ তো লাল হয় না! তাহলে কী এ রক্ত? এই প্রশ্নই ঘোরাফেরা করছিল রাশিয়ার সাইবেরিয়া প্রদেশের শিল্পশহর নরিলস্ক-এর বাসিন্দাদের মনে। কেন হল এমন ‘ব্লাড রেইন’ বা রক্ত বৃষ্টি? অনেক জল্পনা-কল্পনার শেষে জানা গেল সত্যিটা। এই ঘটনার দায়ভার বর্তায় ‘নরনিকেল’ নামে একটি কারখানার উপর। সেখানকার আধিকারিকরা জানান, বাতাসে মিশে থাকা আয়রন অক্সাইডের ধূলিকণার সঙ্গে বৃষ্টির জল মিশে ওই লাল রং তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি তাঁদের কারখানায় মেঝে এবং ছাদ মেরামতির কাজ চলছিল। সমস্ত বর্য পদার্থ একটি জায়গায় জমা করা হচ্ছিল। কিন্তু কোনওভাবে সেটি ঢেকে রাখতে ভুলে যান কর্মচারীরা। ঝোড়ো হাওয়ার কারণে তা বাতাসে মিশে যায়। আর বাতাসে ভাসতে থাকা ওই ধুলোর কারণেই এই ‘রক্ত–বৃষ্টি’-র সৃষ্টি!
ছবি ও তথ্য – ইন্টারনেট
No comments:
Post a Comment